জনাব তালুকদার আবদুল খালেক আপনাকে অভিনন্দন৷ সাংবাদিক আবু তৈয়ব মুন্সীর বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে জেল হাজতে পুরে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আপনার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ও সুনাম আপনি উদ্ধার করতে পেরেছেন৷
বিজ্ঞাপন
এনটিভির খুলনা ব্যুরো প্রধান আবু তৈয়ব ফেসবুকে লেখালেখি করছিলেন আপনাকে নিয়ে, বলছিলেন মংলা কাস্টমসে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার কথা৷ আপনি মানী লোক, তাতে আপনার মান ইজ্জত আর থাকছিল না৷ আপনার ভাবমূর্তি ভেঙে পড়ছিল ভঙুর কাঁচ অথবা মুড়ি মুড়কির মতো৷
আপনার মতো মানী লোকের মান বাঁচাতেই তো সরকার কী দারুণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে৷ আর কেউ নিশ্চয়ই শুল্ক ফাঁকি বা ভোটের হিসাব গোলমাল নিয়ে কথা বলবেন না ফেসবুকে৷ সফেদ পাঞ্জাবিতে ধোয়া তুলসি পাতা হেন পবিত্র আপনারা, আপনাদের গায়ে দাগ লাগানো অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ৷
অবশ্য একটা বিষয় কী জানেন? আপনার যে ওই স্ট্যাটাসে বা ফেসবুকের তৎপরতায় মান গেছে, তা আমরা বুঝতে পারিনি৷ বুঝেছেন আপনি৷ তাই আমাদের কৌতূহল ঠিক কোন সময় বা কোন অবস্থায় আপনি বুঝতে পারলেন যে, আপনার সম্মানের হানি হচ্ছে? মানে, বিষয়টা খালি চোখে দেখা যায় না বলেই বুঝতে চেষ্টা করছি৷ নাকি কাউকে আপনি বলতে শুনলেন, এই দ্যাখ দ্যাখ, জনাব মুন্সীর লিখায় জনাব খালেকের ভাবমূর্তি ভেঙে গেল৷
যেসব অভিযোগে ডিজিটাল আইনে মামলা
করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে৷ কী অভিযোগে এসব মামলা হচ্ছে, জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: facebook.com/michelkumirthakur
মুশতাক আহমেদ
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে ২০২০ এর ৫ মে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব-৩৷ তাদের একজন মুশতাক আহমেদ৷ এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর৷ তিনিও গুজব ছড়িয়েছেন৷ এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷’’ ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে তার মৃত্যু হয়৷
ছবি: facebook.com/IamBangladeshi.71
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর
ব়্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের একজন কিশোর৷ তার ফেসবুক পাতায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে এজাহারে বলা হয়৷ এছাড়া তার ব্যবহৃত ফোনে তাসনিম খলিল, শায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানানো হয়৷ ৪ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান৷
ছবি: facebook.com/AKK30M
দিদারুল ভূঁইয়া
ব়্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার আরেকজন দিদার ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য৷ ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ বলছে, দিদার করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে বাংলাদেশ সরকার যে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে, তা মনিটর করার জন্য গঠিত একটি কমিটির সদস্য৷ নিজের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেস দিদার অভিযোগ করেন, সবচেয়ে গরিব মানুষেরাই সরকারি ত্রাণের সবচেয়ে কম অংশ পেয়েছেন৷ সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান৷
ছবি: Facebook/didarul.bhuiyan
তাসনিম খলিল
ব়্যাবের মামলার ১১ আসামির একজন সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল৷ তার সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়েছে, তার ফেসবুক আইডিতে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও বাহিনী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়াতে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট পাওয়া গেছে৷
ছবি: Facebook/tasneem.khalil
শফিকুল ইসলাম কাজল
২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ফটো সাংবাদিক কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন মাগুরা-১ আসনের সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর৷ যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে এই মামলা করেছিলেন তিনি৷ এছাড়া কাজলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও তেজগাঁও থানায়ও ডিজিটাল আইনে আরও দুটি মামলা হয়৷
ছবি: Facebook/Shafiqul Islam Kajol
বেরোবি শিক্ষক
ফেসবুকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের মৃত্যু নিয়ে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল আইনের মামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজুম মনিরাকে ২০২০ সালের ১৩ জুন গ্রেফতার করা হয়৷ পোস্টটি দেয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি তা মুছে দিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাবি শিক্ষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানকে গতবছর ১৮ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ পুলিশ কর্মকর্তা মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আজেবাজে কথা লিখে কটূক্তির অভিযোগে’ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ বলছে, ২ জুন প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন৷ যদিও নাসিমের নাম উল্লেখ করেননি৷ পোস্টটি তিনি পরে মুছেও দেন৷
ছবি: DW/A. Khanom
নবম শ্রেণির ছাত্র ইমন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলায় নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ইমনকে ২০২০ সালের ২০ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর তাকে কিশোর শোধনাগারে পাঠানো হয়৷ ভালুকার ওসি জানিয়েছেন, ইমন পরে পোস্টটি মুছে ক্ষমা চেয়েছিল৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সুশান্ত দাশ গুপ্ত
‘আমার হবিগঞ্জ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক৷ এই পত্রিকায় স্থানীয় সাংসদ আবু জাহিরের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ২০ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জাহির৷ এর পরদিন সুশান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৪ জুন তিনি জামিন পান৷
ছবি: Facebook/Sushanta.D.Gupta
9 ছবি1 | 9
আমাদের সাংবাদিকদের আপনি কী বার্তা দিলেন জনাব মেয়র, তা-ও একটু পরিষ্কার করবেন৷ আপনার বিরুদ্ধে লেখা যাবে না, এটাই কি? সত্য মিথ্যার কথায় বলা যায়, এই ডিজিটাল যুগে মিথ্যা সংবাদের প্রচার বাড়লেও প্রসার বাড়েনি৷ আলতো এক টিপেই সত্য আর মিথ্যা আলাদা করা যায়৷ তার জন্য পাইক বরকন্দাজ আর আলো ঝলমলে ডিজিটাল আইন সাধারণত লাগে না৷
আর ভাবমূর্তি বিষয়টাও দারুণ, যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদেরই তা থাকে৷ অন্যদের সম্পর্কে আপনি সত্য-মিথ্যা যা-ই বলেন, তাতে তাদের মান যায় না৷
সদাশয় সরকারকেও অভিনন্দন চমৎকার এই আইনটির জন্য৷ আপনাদের তুমুল জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এর চেয়ে বড় অস্ত্র তো আর হতে পারতো না৷
আপনারা অবশ্য মুখে বলেন, সাংবাদিকদের হয়রানি করার জন্য এই আইন নয়, বরং সাধারণ মানুষকে ডিজিটাল হয়রানি বন্ধ করার জন্যই এই আইন৷ আর এই আইন অবশ্যই বাক-স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক নয়৷
কিন্তু এসব কথা নিশ্চয়ই আপনাদের কৌশল এবং তা এর মধ্যেই দারুণ কার্যকর বলে বিবেচিত৷ সাধারণ মানুষকে ডিজিটাল হয়রানির জন্য লেখক মুশতাক মরে গেল, কার্টুনিস্ট কিশোর কারাগারে থাকলো এক বছর৷ আর খুলনার মেয়রসহ সংসদ সদস্য, মন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রী এইসব সাধারণ মানুষ হয়রানি বা ভাবমূর্তি হারানো থেকে মুক্ত থাকতে পারলেন৷