সাংবাদিকতার নতুন চ্যালেঞ্জ ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো'
১২ অক্টোবর ২০২২সরকারের এই ঘোষণায় স্বাধীন বা মুক্ত সাংবাদিকতা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন সাংবাদিকেরা। কারণ যে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণা করা হল এর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান নানাভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ। সংবাদ মাধ্যমে এমন বহু রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। অনেক কর্মকর্তার শাস্তিও হয়েছে। এই ঘোষণার ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির খবর প্রচার করা আরও কঠিন হয়ে যাবে সাংবাদিকদের।
দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স এগেইনস্ট করাপশনের সভাপতি মহিউদ্দীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতির যে অনুসন্ধান করে তার অধিকাংশই সাংবাদিকদের রিপোর্টের ভিত্তিতে। দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট বন্ধ হলে কমিশনের কাজও বাধাগ্রস্ত হবে। আমি মনে করি, বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে এসে দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু কর্মকর্তা সরকারকে ভুল বুঝিয়ে এমন নির্দেশনা জারি করেছে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রত্যাহার করা উচিৎ।”
কী বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে?
গত ২১ সেপ্টেম্বর এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ধারা ১৫ অনুযায়ী সরকারি ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করা হলো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৫ ধারা অনুযায়ী, এ আইন দিয়ে সরকার কোনো কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক বা তথ্য পরিকাঠামোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড, সেতু বিভাগ, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, জাতীয় ডেটা সেন্টার (বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ (নির্বাচন কমিশন সচিবালয়), সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইমিগ্রেশন পুলিশ, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বাংলাদেশ, রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বে আইনিভাবে প্রবেশ করলে সাত বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। বেআইনিভাবে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন বা ক্ষতির চেষ্টা করলে ১৪ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডই দেওয়া যাবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম এখানে বলা হয়েছে, এগুলো তো পাবলিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্কে জানার অধিকার তো জনগনের আছে। এই ঘোষণায় ট্রান্সপারেন্সি নষ্ট হবে। জনগণ এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারবে না। সরকার প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে লেখা যাবে না সেটা তো হতে পারে না। এটা তো তথ্য আইনের পরিপন্থী। আমি মনে করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা উঠিয়ে দেওয়া উচিৎ। এটা কালো আইন। অথবা ওই আইনটার আমূল সংস্কার করা প্রয়োজন।”
ব্যাখা দিয়ে বিভ্রান্তি দূর করা চেষ্টা
আইসিটি বিভাগের এই প্রজ্ঞাপনের পর সাংবাদিকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে গত ৯ অক্টোবর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ বিস্তারিত ব্যাখা দিয়ে একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তথ্য পরিকাঠামো নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠান মনগড়া ও বানোয়াট তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কারণ, পরিকাঠামোগুলোর নিরাপত্তা সামান্য বিঘ্নিত হলে জনগণের বিপুল ক্ষতির কারণ হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হচ্ছে সরকার কর্তৃক ঘোষিত কোনো বাহ্যিক বা ভার্চ্যুয়াল তথ্য পরিকাঠামো, যা ক্ষতিগ্রস্ত বা সংকটাপন্ন হলে জননিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য, জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা বা সার্বভৌমত্বের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। ভারত, কোরিয়া, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোসমূহ চিহ্নিত আছে।
এই পরিকাঠামো ঘোষণায় তথ্য প্রাপ্তি বাধাগ্রস্থ হবে কিনা? জানতে চাইলে প্রধান তথ্য কমিশনার মরতুজা আহমদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিষয়টি নিয়ে এখনও আমরা আলোচনা করিনি। খুব শিগগিরই প্রজ্ঞাপনটি দেখে আমরা আলোচনা করব।”
ঘোষণার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন টিআইবির
তবে এই তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণা করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলেছে, এই তালিকা প্রশ্নবিদ্ধ ও বিভ্রান্তিকর। কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি সমর্থিত না হওয়ার পরেও এই তালিকা প্রকাশ বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ‘কোনো কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্ককে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো' হিসেবে ঘোষণা করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে। তারপরও ২৯ প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো বলা হচ্ছে। তবে কোন বিবেচনায় এই তালিকা করা হয়েছে, সেটা স্পষ্ট নয়। এর মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরও একটি দুর্বলতা সামনে চলে এসেছে। আইনে শুধু ‘বেআইনি প্রবেশ'-এর সাজার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। অথচ আইনি প্রবেশ সত্ত্বেও অননুমোদিত কার্য সম্পাদনের কথা বিবেচনা করা হয়নি। তাই এর অপব্যবহার বন্ধে ও সত্যিকারের কার্যকারিতা নিশ্চিতে দ্রুত আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন।
নজিরবিহীন অপপ্রয়োগ হয়েছে- আর্টিকেল নাইনটিন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি করার পর থেকেই সেটি সাংবাদিকতার জন্য বড় বাধা তৈরি করছে বলে গণমাধ্যম কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন বলেছে, গত চার বছরে ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা দমনে এই আইনের নজিরবিহীন অপপ্রয়োগ হয়েছে। আর্টিক্যাল নাইনটিন শুধু ২০২১ সালের উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এটার ফলে ট্রান্সপারেন্সি কমে যাবে। তথ্য প্রাপ্তিও বাধাগ্রস্থ হবে। তথ্য অধিকার আইনে যে তথ্য প্রাপ্তি কথা বলা আছে সেটাও বাধাগ্রস্ত হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আসলে সাধারণ মানুষের উপকারে লাগে এমন কিছু নেই। সরকারকে দমনপীড়নের অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির একটা সুরক্ষা তৈরি হবে বলেও আমরা আশঙ্কা করছি। এখন তারা দুর্নীতি করবে কি করবে না সেটা ভিন্ন বিষয়।”
সাংবাদিক নেতারা কী বলছেন?
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি মনে করি, স্বাধীন সাংবাদিকতার কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হয়েছে এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। যদিও দেশে এখন স্বাধীন বা মুক্ত সাংবাদিকতা নেই। তারপরও যতটুকু ছিল বা সাংবাদিকরা যতটুকু লেখার সুযোগ পেতেন এখন থেকে আর সেটা পাবেন না। দেশব্যাপী যে দুর্নীতির উৎসব চলছে তাতে দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দিতেই এটা করা হয়েছে। এরপর এমনও হতে পারে সচিবালয়ে কোন সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবেন না। সরকার সেদিকেই এগুচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে।”
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই ঘোষণা অবশ্যই স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী। এটা নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম বা দুর্নীতির চিত্র তুলে আনাই তো সাংবাদিকদের কাজ। এটা করতে না পারলে তো সাংবাদিকতাই থাকল না। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা ২২ অক্টোবর সমাবেশের ডাক দিয়েছি। দুর্নীতিবাজেরা নানাভাবে সাংবাদিকদের কাজে বাধার সৃষ্টি করছে। এইসব আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী এবং আমাদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলছে।”
মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার যা বললেন
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ডয়চে ভেলেকে বলেন,"এটা ডিজিটাল সিকিউরিটির প্রশ্ন। এখন সব তথ্য ডিজিটালি রাখা হয়। এই ডিজিটাল নিরাপত্তাটা তো থাকতে হবে। এখনই আমি একটা খবর পড়ছি, সুরক্ষা অ্যাপ থেকে জালিয়াতি করে ইচ্ছেমত টিকার সার্টিফিকেট নিয়ে নিচ্ছে। এগুলোর নিরাপত্তা বিধান করার বিষয় আছে না? মুক্ত সাংবাদিকতার সঙ্গে এই পরিকাঠামো ঘোষণার সম্পর্ক কী? এটা তো আমি নিজেই খুঁজে পাচ্ছি না। সাংবাদিকরা কী হ্যাকিং করে তথ্য সংগ্রহ হ্যাকিং করে? সেটা তো করা যাবে না। অন্য ১০টি প্রতিষ্ঠানের মতোই তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। এটা করা হয়েছে হ্যাকিংটাকে নিরাপদ করা। দুনিয়াতে কোন দেশে নেই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে পরিকাঠামো ঘোষণা করা হয়নি। যখন কেপিআই ঘোষণা করা হয়েছে তখন কী সাংবাদিকতা বন্ধ হয়েছে গেছে? তাই যদি না হয় তাহলে এখন কেন হবে? এটা তো সাইবার কেপিআই। এটার সঙ্গে তো তথ্য আদান প্রদানের কোন সম্পর্ক নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি ধারা পূরণ করা হয়েছে। এখানে সাংবাদিকদের উদ্বিগ্ন হওয়া কোন কারণ আমি দেখি না। সাংবাদিকেরা এটার ফলে বাধাগ্রস্ত হলে তখন বলতে পারে।”