২০১৮ সালে নজিরবিহীন সাংবাদিক নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে৷ রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের হিসেবে এ বছর ৮০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, কারাদণ্ড ও জিম্মি করা হয়েছে অনেককে৷
বিজ্ঞাপন
সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-এর প্রকাশ করা রিপোর্ট বলছে, যে ৮০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের অর্ধেকেরও বেশিজনকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে৷ ২০১৭ সালের তুলনায় সাংবাদিক হত্যা বেড়েছে অন্তত ১৫ শতাংশ৷
এর বাইরেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩৪৮ জন সাংবাদিককে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে৷ ৬০ জন জিম্মি হয়েছেন বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে৷
ভয়ঙ্করতম বছর
‘‘২০১৮ সালের মতো এতটা ভয়াবহ নিপীড়ন ও নির্যাতনের মুখে আর কখনোই পড়েননি সাংবাদিকরা,'' রিপোর্টে উল্লেখ করেছে আরএসএফ৷
সাংবাদিকতায় সবচেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি আফগানিস্তানে বলে উল্লেখ করেছে আরএসএফ৷ এ বছর দেশটিতে ১৫ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে৷ এর পরেই রয়েছে সিরিয়া৷ সেখানে নিহত হয়েছেন ১১ জন৷
স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের শাস্তি যখন কারাদণ্ড এবং নির্যাতন
মারধর, কারাদণ্ড, হত্যা: এই পাঁচ সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক স্বাধীনভাবে তাঁদের মত প্রকাশের মূল্য দিচ্ছেন৷ ছবিঘরে জেনে নিই তাঁদের কথা৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
অসম্পূর্ণ তালিকা
বিশ্বব্যাপী কতজন সাংবাদিক, কবি এবং লেখক কারাবন্দি বা নিখোঁজ তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই৷ এমনকি লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পেন’-এর কাছে মামলার যে তালিকা রয়েছে, সেটাও পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়৷
ছবি: picture alliance/dpa
ওয়াইল আব্বাস: কারাবন্দি
ওয়াইল আব্বাস একজন মিশরীয় ব্লগার৷ তাঁর ব্লগে নিজ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, পুলিশের দ্বারা সহিংসতার কথা তুলে ধরতেন তিনি৷ এসব লেখার কারণে ২০১৭ সালের মে মাসে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এখনো তিনি কারাবন্দি৷ পুলিশ তাঁর লেখার সব সরঞ্জাম এবং ব্যক্তিগত অনেক জিনিস জব্দ করেছে৷
ছবি: Facebook
শহীদুল আলম: কারাবন্দি, পরে মুক্তি
বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলার সময় বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করে আল-জাজিরা টেলিভিশনে বক্তব্য দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী, লেখক ও অধিকার কর্মী শহীদুল আলম৷ আগস্টের ৫ তারিখে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের বিশেষ ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এখনো তিনি কারাবন্দি৷ ২০১৮ সালে মানবিকতার আলোকচিত্রের জন্য তিনি লুসি পুরস্কার পান৷ ২০ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান তিনি৷
ছবি: Munir Uz Zaman
মিরোস্লাভা ব্রিচ ভেলদুসিয়া: হত্যা
২০১৭ সালের মার্চ মাসে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে খুন হন মেক্সিকোর এই সাংবাদিক৷ তাঁকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তিনি দেশের রাজনীতিবিদ এবং মাদকপাচারকারীদের মধ্যে যোগসূত্র এবং দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করেছিলেন৷ ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে ৯৬ জন লেখক এবং সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে৷
ছবি: EPA
দাওইত ইসাক: নিখোঁজ
ইরিত্রিয়ান-সুইডিশ এই লেখকের ঘটনা খুবই হতাশাজনক৷ ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ইরিত্রিয়া থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি এবং কারাবন্দি হওয়ার পর তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি৷ গত ১৭ বছর ধরে কেউ তাঁর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারেনি৷ তিনি জীবিত আছেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে৷
ছবি: Kalle Ahlsén
ওলেগ সেন্তসভ: আটক এবং পুরস্কার বিজয়ী!
২০১৪ সালে ক্রাইমিয়ায় বিক্ষোভ চলাকালে রাশিয়ার বিরোধিতা করলে ইউক্রেনের লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ওলেগ সেন্তসভকে রুশ নিরাপত্তাকর্মীরা গ্রেপ্তার করে৷ রাশিয়ার সামরিক আদালত তাঁকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে৷ মুক্তচিন্তার বিকাশে ভূমিকা রাখায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বোচ্চ মানবাধিকার বিষয়ক পুরস্কার সাখারভ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP
6 ছবি1 | 6
সংঘাতপূর্ণ দেশ নয়, কিন্তু সাংবাদিক হত্যা করা হয়েছে, এমন দেশগুলোর মধ্যে ওপরে রয়েছে মেক্সিকো৷ ৯ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে সেখানে৷ এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে গত জুনে ক্যাপিটেল গ্যাজেট নিউজপেপারের ৫ জন বন্দুকের গুলিতে নিহত হন৷
আরএসএফ মহাসচিব ক্রিস্টোফ ডেলোয়ার বলেন, ‘‘পরিস্থিতি খুবই সঙ্গিন৷ বিবেকহীন রাজনীতিকরা, ধর্মীয় নেতারা ও ব্যবসায়ীরা প্রায়ই এখন খোলাখুলিভাবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ান৷ এ কারণেই সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে৷''
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
আরএসএফ-এর হিসেবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়৷ ২০১৭ সাল থেকে .ব্যাংকিংয়ে কোনো পরিবর্তন না হলেও রেটিংয়ে কিছুটা অবনতি হয়েছে৷ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬৷ স্কোর ৪৮.৬২৷ ২০১৭ সালে স্কোর ছিল ৪৮.৩৬৷
৭.৬৩ স্কোর নিয়ে তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে নরওয়ে৷ আর ৮৮.৮৭ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে নীচে আছে উত্তর কোরিয়া৷ সৌদি আরব ১৬৯ ও যুক্তরাষ্ট্র ৪৫ নম্বরে আছে৷
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন
চলতি বছর এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭৩ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী মারা গেছেন৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: Getty Images/C. McGrath
ভিক্টোরিয়া মারিনোভা, বুলগেরিয়া
৩০ বছর বয়সি এই টিভি উপস্থাপক সম্প্রতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নিয়ে টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিল নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত করছিলেন ঐ সাংবাদিকরা৷ সম্প্রতি মারিনোভাকে হত্যা করা হয়েছে৷
ছবি: BGNES
জামাল খাশগজি, সৌদি আরব
আল-আরব নিউজ চ্যানেলের সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলামনিস্ট খাশগজি তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ৷ নিখোঁজ হওয়ার আগে তিনি সৌদি কর্তৃপক্ষ তাঁকে মেরে ফেলতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন৷
ছবি: Reuters/Middle East Monitor
ইয়ান কুচিয়াক, স্লোভাকিয়া
সরকারের সঙ্গে ইটালির মাফিয়াদের সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত করছিলেন স্লোভাকিয়ার এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক৷ গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে তাঁর বান্ধবীসহ হত্যা করা হয়৷ সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাঁকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে৷ কুচিয়াক হত্যার পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে পদত্যাগে বাধ্য হন দেশটির প্রধানমন্ত্রী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Voijnovic
মারিয়ো গোমেজ, মেক্সিকো
সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে কাজ শুরুর পর থেকেই হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন গোমেজ৷ সেপ্টেম্বরে নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার পর সশস্ত্রদের গুলিতে প্রাণ হারান ৩৫ বছর বয়সি এই সাংবাদিক৷ চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মেক্সিকোয় ১০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Cortez
সামিম ফারামারাজ ও রমিজ আহমাদি, আফগানিস্তান
সেপ্টেম্বরে কাবুলে একটি বিস্ফোরণের পর সেখান থেকে লাইভ করছিলেন সামিম ফারামারাজ৷ ক্যামেরায় ছিলেন রমিজ আহমাদি৷ লাইভ শেষ করছিলেন এমন সময় কয়েক মিটার দূরে আরেকটি বিস্ফোরণ হলে প্রাণ হারান এই দুই গণমাধ্যমকর্মী৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Marai
মার্লোন ডি কারভালু আরায়ুজু, ব্রাজিল
দেশটির বাহিয়া আঞ্চলিক প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতি প্রকাশ করেছিলেন এই সাংবাদিক৷ গত আগস্টের এক ভোরে তাঁর বাড়িতে সশস্ত্র কয়েকজন ঢুকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/E. Sa
সুজাত বুখারি, কাশ্মীর
জুনে শ্রীনগরে তাঁর সংবাদপত্র অফিসের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইতেন ডয়চে ভেলের এই কন্ট্রিবিউটর৷
ছবি: twitter.com/bukharishujaat
দ্য ক্যাপিটাল, যুক্তরাষ্ট্র
গত জুনে এই সংবাদপত্র অফিসে গুলি করে সম্পাদক ওয়েন্ডি উইন্টার্স, তাঁর সহকারী রবার্ট হিয়াসেন, লেখক জেরাল্ড ফিশম্যান, সাংবাদিক জন ম্যাকনামারা ও বিক্রয় সহকারী রেবেকা স্মিথকে হত্যা করা হয়৷ হত্যার দায়ে যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই ব্যক্তি ঐ পত্রিকার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Ngan
8 ছবি1 | 8
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ১৩৮, পাকিস্তান ১৩৯, শ্রীলঙ্কা ১৩১, মালদ্বীপ ১২০, নেপাল ১০৬ ও ভূটান ৯৪তম স্থানে আছে৷
বাংলাদেশ বিষয়ে আরএসএফ বলছে, এখানেসংবিধান কিংবা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সমালোচনা করা যায় না, যদিও দেশটি কাগজে কলমে অসাম্প্রদায়িক৷ মুক্তমনা ব্লগার ও লেখকদের ঝুঁকি বলবৎ আছে বলে উল্লেখ করা হয় রিপোর্টে৷ বলা হয়, এখানে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ আছে, তবে সাংবাদিক ও মত প্রকাশের ওপর উপর্যুপরি আঘাতের কারণে সাংবাদিকরা ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ' আরোপ করেছেন৷ সাংবাদিকদের ওপর আঘাত বা আক্রমণের বিচার না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়েছে৷
বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে আইসিটি অ্যাক্ট নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পরও ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার অস্বচ্ছ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাশ করেছে৷