ফেব্রুয়ারি মাসের মাত্র দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই এক সাংবাদিকের মৃত্যু এবং অন্য এক সাংবাদিককে ‘গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত করা’র বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে৷
বিজ্ঞাপন
মোটরসাইকেলসহ ‘দুর্ঘটনা'য় পড়া ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি অবজাভার'-এর অপরাধবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মামুনুর রশীদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, একটি প্রাইভেট কার তাকে অনুসরণ করছিল৷ বেশ কয়েকবার চাপা দেওয়ারও চেষ্টা করেছে৷ কারওয়ানবাজার আন্ডারপাসের কাছাকাছি আসার পর আবারও তাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি দ্রুত পাশ কাটাতে যান৷ একটি শিশু চলে আসে গাড়ির সামনে৷ মামুনুর রশীদের দাবি, সেই শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে মোটরসাইকেল থেকে তিনি প্রায় ৬০ ফুট দূরে গিয়ে ছিটকে পড়েন এবং মারাত্মক আহত হন৷ বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন৷
তাঁর অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে৷ বাংলা ট্রিব্রিউন জানিয়েছে, ২৩ জানুয়ারি ডেইলি অবজারভারে ‘পুলিশ অ্যাওয়েট পিএম'স অর্ডার টু ক্র্যাকডাউন অন ড্রাগ লর্ডস' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ এতে সরকার দলীয় চারজন সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ করা হয়৷ ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরই পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও প্রতিবেদক মামুনুর রশীদের বিরুদ্ধে ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ১০ কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ জাতীয় সংসদেও তিনি ইকবাল সোবহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন৷ নিজাম উদ্দিন হাজারী ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানও বিষয়টি নিয়ে ইকবাল সোবহান চৌধুরীর সমালোচনা করেন৷
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
9 ছবি1 | 9
মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘‘আহত মামুন ভাই জানিয়েছে, রহস্যজনকভাবে কালো কাঁচের প্রাইভেটকারটি ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়৷ গাড়িটি ফার্মগেট থেকে ফলো করছিল৷ মামুন ভাইয়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন, যাতে উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন৷''
সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন, ‘‘যার জন্য আমরা রাজপথে আন্দোলন করছি, যার রিপোর্টের কারণে মাদক সিন্ডিকেটের সম্রাটরা সংসদে গলাবাজি করে, সাংবাদিক সমাজের অবিসংবাদিত নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে সংসদে বিষোদগার করে, সেই রিপোর্টার মামুন গুরুতর আহত৷ আসুন আমরা রুখে দেই সকল ষড়যন্ত্র৷''
সাংবাদিক হারুন উর রশীদ ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘‘কী কারণে প্রাইভেট কারটি তাকে ধাওয়া করেছে জানতে চাইলে মামুন বলেছেন তিনি বিভিন্ন সময় মাদক ও সন্ত্রাসীদের নিয়ে সংবাদ করেছেন৷ তবে এ কারণেই তার ওপর আক্রমণ করা হয়েছে কিনা তিনি নিশ্চিত না৷ তার মনে হচ্ছে, এটিও একটি কারণ হতে পারে৷''
এদিকে, সাংবাদিক শিমুল হত্যা মামলায় সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়র হালিমুল হক মিরুসহ ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ৷ গত ২ ফেব্রুয়ারি মেয়রের শটগানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল৷
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন৷ আদালত সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সাম্প্রতিক আন্দোলন নিয়ে রিপোর্ট করার কিছুদিনের মধ্যেই নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনসহ ছয়টি মামলা করা হয়৷
সাংবাদিক হারুন-অর-রশীদ ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘‘৫২ দিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন সাভারের সাংবাদিক নাজমুল হুদা৷পুলিশ তাঁকে ২৩ ডিসেম্বর আটকের পর তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দেয়৷ নাজমুলকে দু'দফা পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে৷'' তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, নাজমুলকে কেন এই হয়ারানি, কেন এই নির্যাতন? এর নেপথ্যে কারা আছেন?''