রোজিনা ইসলাম আটক হওয়ার একদিন পর বিবৃতি দেয় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন৷ একইভাবে অবাক করে রোজিনা আটক হওয়ার সময়ে কোনো সাংবাদিক নেতাকে দেখা না যাওয়ায় তাই আবারও প্রশ্ন উঠেছে- সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো কী করে, কার স্বার্থে কাজ করে?
বিজ্ঞাপন
রোজিনা ইসলামকে ১৭ মে দুপুরে সচিবালয়ে আটকের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাত পর্যন্ত তেমন কোনো সাংবাদিক নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি৷ শুধু সক্রিয় দেখা গেছে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতা দীপ আজাদসহ কয়েক জনকে৷ সংগঠনগুলোর কোনো কোনো নেতা অবশ্য ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়ে পোস্ট দিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন৷ তবে সাধারণ ও মাঠের সাংবাদিকরা শুরু থেকেই প্রতিবাদমুখর ছিলেন৷ সারা রাত তারা থানায় অবস্থান করেন৷
মাঠের সাংবাদিকদের এই ঐক্যবদ্ধ অবস্থান দেখে পরদিন বিকেলে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন একটি বিবৃতি দেয়৷ সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান দাবি করেন, ‘‘সাংগঠনিকভাবে বিবৃতিতে দিতে হলে একটি প্রক্রিয়ায়র মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে কারণে একটু দেরি হয়েছে৷’’
আর সংঠনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই মাঠের সাংবাদিকদের সঙ্গে অবস্থান নেয়া ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ দীপ আজাদ বলেন, ‘‘সাংবাদিক নেতারা এবং সিনিয়র সাংবাদিকরা যদি শুরু থেকেই তৎপর হতেন তাহলে পরিস্থিতি হয়ত ভিন্ন হতে পারতো৷ আমার মনে হয় প্রথম আলো যেহেতু তাদের সংবাদকর্মীদের সাংবাদিক ইউনিয়ন করাকে নিরুৎসাহিত করে এবং ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে তারা অংশ নেয় না, তাই তারাও একটু ধীরে চলো নীতিতে গিয়েছেন৷ আর প্রথম আলোর ভূমিকা নিয়ে ইউনিয়নের মধ্যে নানা সময়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ সেকারণেই হয়ত এরকম হয়েছে৷’’
‘সাংবাদিক নেতাদের রাজনৈতিক বিভক্তি এবং সুবিধা নেয়ার প্রবণতা তীব্র হয়েছে’
দীপ আজাদ অবশ্য ওই দিন কয়েকজন সাংবাদিক নেতাকে ফোনে যোগাযোগ করেও তাদের সাড়া পাননি বলে জানান৷
শুরু থেকেই প্রতিবাদ আর আন্দোলনে সক্রিয়দের মধ্যে আরেকজন হলেন একাত্তর টিভির সিনিয়র রিপোর্টার নাদিয়া শারমিন৷ তিনি নিজেও ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন৷ আর তাকে বরাবরই সাংবাদিকদের জন্য মাঠে থাকতে দেখা যায়৷ তিনি বলেন, ‘‘যখন আমরা ইউনিয়ন বা সাংবাদিক নেতাদের সহায়তা পাই না, তখন আমরা মাঠের সাংবাদিকরাই নেমে যাই৷ তাদের জন্য অপেক্ষা করি না৷ আমাদের কথা তো আমাদেরই বলতে হবে৷ কারুর দিকে তাকিয়ে থাকলে তো চলবে না৷’’
২০১২ সালে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সময়ও দেখা গেছে নেতারা আগে এগিয়ে আসেননি৷ পরে সবাই এগিয়ে এলেও এখন তাদের মৃত্যুবার্ষিকীতেই কর্মসূচি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে৷ হত্যাকাণ্ডের বিচার তো দূরের কথা এত বছরে চার্জশিটও হয়নি৷
রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের প্রভাব বলয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া
বাংলাদেশের মিডিয়া হাউজগুলোর বেশিরভাগ পৃষ্ঠপোষক বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান৷ এই প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ হয়েছে ‘হু ওনস দ্য মিডিয়া ইন বাংলাদেশ’ গবেষণা থেকে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বসুন্ধরা গ্রুপ
বসুন্ধরার ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের তিনটি সংবাদপত্র কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং ডেইলি সান৷ আছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম এবং টিভি চ্যানেল নিউজ ২৪৷ এছাড়া এফএম রেডিও স্টেশন রেডিও ক্যাপিটালও তাদের৷ এই মিডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেক্সিমকো গ্রুপ
এই গ্রুপের টেলিভিশন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি৷ মালিক বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
স্কয়ার গ্রুপ
এই গ্রুপের টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা টেলিভিশন৷ এর কর্ণধার স্কয়ার গ্রুপের অধীনে থাকা স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইমপ্রেস গ্রুপ
টেলিভিশন চ্যানেল, চ্যানেল-আই এর মালিকানা ইমপ্রেস গ্রুপের৷ এর কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশান কোম্পানি
টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলা এবং এটিএন নিউজ এই কোম্পানির৷ এর কর্ণধার মাহফুজুর রহমান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইত্তেফাক গ্রুপ অফ পাবলিকেশনস লিমিটেড
সুপরিচিত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক এই কোম্পানির৷ এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী৷ বর্তমানে ইত্তেফাকের সম্পাদক জাতীয় পার্টি নেতা, সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্ত্রী তাসমিমা হোসেন এবং প্রকাশক মঞ্জু-তাসমিমা দম্পতির কন্যা তারিন হোসেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
এইচআরসি গ্রুপ
বাংলা পত্রিকা যায় যায় দিন এবং ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউএজ এই গ্রুপের৷ এর মালিক আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর ভাই সাঈদ হোসেন চৌধুরী৷ সাবের হোসেন চৌধুরী কর্ণফুলি গ্রুপের মালিক৷ সেই সুবাদে দেশ টিভির কর্ণধার তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সিটি পাবলিশিং হাউজ লিমিটেড
এই কোম্পানির পত্রিকা দৈনিক দিনকাল৷ এর মালিক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হামিম গ্রুপ
চ্যানেল-২৪ টেলিভিশন এবং সমকাল পত্রিকার মালিক৷ এর কর্ণধার আওয়ামী লীগ নেতা একে আজাদ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ট্রান্সকম গ্রুপ
বাংলাদেশের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের মালিক এই গ্রুপ৷ প্রয়াত শিল্পপতি লতিফুর রহমান এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা৷ প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের অনলাইন সংস্করণও রয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেঙ্গল গ্রুপ
টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির মালিক বেঙ্গল গ্রুপ৷ এর কর্ণধার মোর্শেদ আলম এমপি৷
ছবি: Rtv
এনটিভি
বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালু এর মালিক৷ তিনি একজন ব্যবসায়ী৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার
জনকণ্ঠ পত্রিকার মালিক এই শিল্প পরিবার৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
রূপায়ন গ্রুপ
দৈনিক পত্রিকা দেশ রূপান্তর এই গ্রুপের৷ রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সিটি গ্রুপ
সময় টেলিভিশনের মালিক এই গ্রুপ৷ সবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের ভাই এর কর্ণধার৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মেঘনা গ্রুপ
একাত্তর টেলিভিশন এই গ্রুপের৷ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান মোস্তাফা কামাল এই গ্রুপের কর্ণধার৷ তবে সাংবাদিক মোজাম্মেল হক বাবু’র শেয়ার রয়েছে এতে৷
ছবি: Sanjay Kumar
শ্যামল বাংলা মিডিয়া
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশন এই মিডিয়া কোম্পানির৷ এর কর্ণধার আবদুল হক৷ তবে নেপথ্যে মালিকানায় বিএনপির প্রয়াত সাংসদ সাদেক হোসেন খোকার নাম শোনা গেলেও নথিপত্রে তার নাম নেই বলে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে৷
ছবি: Ahasanul Haque
যমুনা গ্রুপ
দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা এবং যমুনা টেলিভিশন এই গ্রুপের৷ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের মৃত্যুর পর থেকে তার স্ত্রী সালমা ইসলাম এই গ্রুপের চেয়ারম্যান৷ সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য তিনি৷ (‘হু ওনস দ্য মিডিয়া ইন বাংলাদেশ’ গবেষণা প্রতিবেদনটির লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ এবং গবেষক মো. সাজ্জাদুর রহমান৷ প্রকাশক সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ,ঢাকা)
ছবি: Ahasanul Haque
18 ছবি1 | 18
আর এর কারণ হিসেবে সাংবাদিক নেতা ও সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক বিভক্তি ও সুযোগ-সুবিধার লোভকেই দায়ী করেছেন সয়ং সাংবাদিক নেতারাই৷ এমনকি এখন সাংবাদিকরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদ পদবিও গ্রহণ করেন৷ আর সাংবাদিক ইউনিয়ন অনেক দিন ধরেই আওয়ামী লীগ ও বিএনটি-জামায়তপন্থি এই দুই ভাগে বিভক্ত৷ তারা কথা বলেন কোন দলের সরকার ক্ষমতায়, তা দেখে৷
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান মনে করেন, ‘‘সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর রাজনৈতিক বিভক্তি এবং কিছু সাংবাদিক নেতার বৈষয়িক স্বার্থ এর জন্য দায়ী৷ যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের কাছ থেকে প্লট, আর্থিক সুবিধাসহ নানা স্বার্থের বিষয় থাকে৷ এমনকি ক্ষমতাসীনদের সুনজরে থাকলে সংবাদমাধ্যমে ভালো চাকরি পাওয়া যায়৷ উল্টোটা হলে চাকরি হারাতে হয়৷’’
তবে তিনি স্বীকার করেন, এরশাদের আমল থেকেই এই প্র্যাকটিস শুরু হয়েছে৷ তারপর সাংবাদিক নেতাদের রাজনৈতিক বিভক্তি এবং সুবিধা নেয়ার প্রবণতা তীব্র হয়েছে৷
দুই গ্রুপের সাংবাদিক নেতাদের কেউ কেউ সরাসরি আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পদে আছেন৷ এটাকে দুঃখজনক বলে মনে করেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের কেউ কেউ এটা করে অনেক ধন-সম্পদের মালিক হয়েছে৷ যদি স্বাধীন তদন্ত করা হয়, তাহলে তাদের চেহারা প্রকাশ পাবে৷'' ইলিয়াস খান ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সদস্য৷
‘সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দলের সদস্য হতেই পারেন’
তবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের আরেক অংশের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান মনে করেন, ‘‘সাংবাদিকরা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত বা রাজনৈতিক দলের সদস্য হতেই পারেন৷ এটা তাদের অধিকার৷ কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে তাকে পেশাদার ও সাংবাদিকদের স্বার্থ এবং অধিকারের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে৷ এটার জন্যই আমরা চেষ্টা করছি৷’’
তার দাবি , ‘‘ঢাকা সংবাদিক ইউনিয়ন সব সময়ই সাংবাদিকদের পক্ষে কাজ করছে৷’’