সাধারণ এক দুর্ঘটনা বড়সড় আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে কলকাতায়৷ এক কথায় যাকে বলা হচ্ছে ‘সাইকেল আন্দোলন'৷ শহরের দিকে দিকে ‘সাইকেল বে' তৈরির জন্য লাগাতার আন্দোলন চলছে৷
বিজ্ঞাপন
‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট' শব্দটির সঙ্গে পরিচিত এখন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ৷ পরিবেশ সংক্রান্ত যে কোনো আলোচনায় এই শব্দটির ব্যবহার সম্ভবত সর্বাধিক৷ কিন্তু কীভাবে এই কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো যায়? কীভাবে পরিবেশ বান্ধব সভ্যতা তৈরির দিকে এগনো যায়? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর তত সহজ নয়৷ সহজ হওয়ার কথাও নয় কারণ, দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর বুকে হানিকর গ্যাস উৎপাদন করে চলেছে মানব বিশ্ব৷ সেই সমস্ত গ্যাসের ব্যবহার দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়৷ কিন্তু ধীরে ধীরে পরিবেশ সহায়ক নানা ভাবনা ভাবছেন বিশেষজ্ঞেরা৷
সে দেশে সাইকেল শুধু সাইকেল নয়
কিউবার মানুষের প্রিয় বাহন হলো সাইকেল৷ এখন হাভানা ও অন্যান্য বড় শহরেও সাইকেলের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, তা দু’চাকার হোক বা তিন চাকার৷
বাইসাইকেল ট্যাক্সির নানা দেশে নানা নাম: ভেলো ট্যাক্সি, পেডিক্যাব, বাইক ক্যাব, বাইক ট্যাক্সি, নয়তো আমাদের সুপরিচিত রিকশা বা সাইকেল রিকশা৷ কিউবানরা বলেন ‘বাইসিট্যাক্সি’৷
...ট্যাক্সিতে চড়তে কোনো অসুবিধে নেই৷ ভাড়াও কম: ১০ থেকে ১৫ মিনিটের ট্রিপের জন্য ১০ থেকে ২০ কিউবান ডলার, যা কিনা এক মার্কিন ডলারের চেয়েও কম৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS.com/A. Cozzi
দু’চাকার সুভেনির শপ
কিউবার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়া, গান-বাজনার সংস্কৃতি, সুবিখ্যাত কিউবান সিগার আর পুরনো সব মার্কিন গাড়ি উপভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন মার্কিন টুরিস্টরা, সুভেনির বিক্রিও বেড়েছে সেই পরিমাণে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Büttner
টুরিস্টদের আশায়
কিন্তু মার্কিন প্রশাসন এখন আবার ওবামার আমলের পরিবর্তনগুলো ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে৷ ২০১৭ সালের জুন মাস থেকে মার্কিন নাগরিকদের একক কিউবা যাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Sputnik/M. Plotnikova
‘এল ট্র্যাক্টর আমারিল্লো’
এই রিকশাটির নাম রাখা হয়েছে কিউবার একটি সুপারহিট গানের নামে: ‘হলুদ ট্র্যাক্টর’৷
ছবি: picture-alliance/chromorange/H. Schunk
তিন চাকার ঠেলা
নাম ট্রাইসাইকেল, কিন্তু তার কাজ ঠেলাগাড়ির মতোই – মাল টেনে নিয়ে যাওয়া৷ কিউবায় এই তেচাকা ঠেলাগাড়ির খুব চল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Meinke-Carstanjen
জীর্ণদশা বাড়ির; সাইকেলের নয়
স্পেনীয়রা কিউবায় যে প্রথম সাতটি বসতি স্থাপন করেছিল, কামাগুয়ে ছিল তাদের মধ্যে একটি৷ কামাগুয়ের ঐতিহাসিক কেন্দ্রটি ২০০৮ সাল যাবৎ ইউনেস্কো হেরিটেজ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Büttner
টেলিভিশন কিনে সাইকেল রিকশায় বাড়ি
কিন্তু কিউবায় রেডিও-টেলিভিশন-খবরের কাগজ বা ইন্টারনেট, সবই সরকারের নিয়ন্ত্রণে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Büttner
ডাবল ক্যারি
সাধারণত কচিকাঁচাদেরই সামনের রডের ওপর বসিয়ে ডাবল ক্যারি করা হয়, বড়রা বসেন পেছনে ক্যারিয়ারের ওপর, তাই আমরা জানি৷ এখানে দেখা যাচ্ছে, তার ঠিক উল্টো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Büttner
সাইকেল চালানো শিখতে হয়...
...যদিও কার্দেনাসে টাট্টু ঘোড়ায় টানা টাঙ্গাই হলো মূল পরিবহণ৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images/R. Kiedrowski
সরকারও সাইকেলের মর্ম বুঝেছেন
২০১৩ সাল থেকে কিউবা সরকার মানুষজনকে সরকারি পরিবহণের ওপর নির্ভর না করে সাইকেল চড়তে বলছেন৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Ernesto
জনপ্রিয়তা বাড়ছে
চীনে এককালে এভাবেই হাজার হাজার সাইকেল চলত, আজ চলে গাড়ি৷ ভিয়েতনামে এককালে হাজার হাজার সাইকেল চলত, আজ চলে স্কুটার বা মোটর সাইকেল৷ কিন্তু কিউবায়...
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Hackenberg
ফাঁকা রাস্তায়...
...সাইকেল চালানোর আনন্দই আলাদা, টুরিস্টরাও যে রস পেয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/Bildagentur-online/AGF-Foto
সাইকেলের দেশ?
কিউবার সাইকেলের দেশ হয়ে উঠতে এখনও অনেক বাকি৷ তবে অর্থনীতি বা পরিবেশ, দু’দিক থেকেই সাইকেল একটা ভালো বিকল্প বৈকি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Büttner
14 ছবি1 | 14
সাইকেল তেমনই এক পরিবেশবান্ধব যান৷ পৃথিবীর বহু দেশই নতুন করে সাইকেলের ব্যবহার বাড়ানোর দিকে ঝুঁকেছে৷ ইউরোপে বহুকাল আগে থেকেই সাইকেলকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সাইকেল আরোহীদের জন্য আলাদা রাস্তা বা ‘বে' তৈরি করা হয়েছে৷ ডিজেল বা পেট্রোল গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে লোকে যাতে ইলেকট্রিক গাড়ি বা সাইকেলের প্রতি আরো আকৃষ্ট হন, তার জন্যও নানারকম পদক্ষেপ করা হচ্ছে৷ শেষ পরিবেশ সম্মেলনেও এ বিষয়ে বহু আলোচনা হয়েছে৷
ইউরোপ এখনো যা চেষ্টা করছে, কলম্বিয়া তা করে দেখিয়ে দিয়েছে৷ বোগোটার রাজপথ এখন সাইকেল আরোহীদের তীর্থক্ষেত্র৷ শহরের মেয়র থেকে উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক, সকলেই সাইকেলে চড়ে দপ্তরে যান৷ অফিস টাইমে লক্ষ লক্ষ সাইকেল দেখতে পাওয়া যায় রাজপথে৷ যা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে, অ্যামেরিকা এবং ইউরোপের কোনো কোনো শহরে বিশেষ বিশেষ রাস্তায় সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে সাইকেল ছাড়া আর সমস্ত যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
অর্থাৎ, সাইকেলের গুরুত্ব অনুধাবন করেছে বিশ্ব৷ সত্যিই কি করেছে?
ইউরোপ যা ভাবতে পারছে, কলম্বিয়া যা পারছে, এশিয়া কি তার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারছে? এশিয়ার হাতেগোনা কয়েকটি শহর ছাড়া রাজপথে সাইকেল চালানো কার্যত নিষিদ্ধ৷ সম্প্রতি কলকাতার একটি ঘটনা তা আরো একবার প্রমাণ করে দিল৷ তথ্য-প্রযুক্তি হাব হিসেবে এখন পরিচিত পূর্ব কলকাতার নিউটাউন অঞ্চল৷ দু'দশক আগে তৈরি হওয়া এই অঞ্চলে সভ্যতার সমস্ত উপাদান থাকলেও ‘সাইকেল বে' নেই৷ সম্প্রতি সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এক সাইকেল আরোহীর৷ অভিযোগ, এরপর পুলিশ সেই রাস্তায় সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ করা হবে বলে ঘোষণা করেছে৷ বস্তুত, কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে অধিকাংশ রাস্তাতেই সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ৷ পুলিশের দাবি, দুর্ঘটনা এড়াতেই এই ব্যবস্থা৷ শুধু কলকাতা নয়, রাজধানী দিল্লি, চেন্নাই, মুম্বই – কোথাও সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা রাস্তার ব্যবস্থা নেই৷
গরিবের বাহন সাইকেল?
সাইকেল চালানোর অনেক উপকারিতা আছে৷ এটা যেমন একটা ব্যায়াম, তেমনি সহজে যে কোনো জায়গায় যেতে সাইকেল উত্তম মাধ্যম৷ কিন্তু ব্রাজিলের অনেকে মনে করেন এটা গরিবের বাহন৷ আপনি কি মনে করেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্রাজিলের সাংসদদের সাইকেল প্রিয়তা
ব্রাজিলের অনেক সাংসদ এখন শহর এলাকায় সাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পক্ষে৷ এ লক্ষ্যে শহরের রাস্তাগুলোতে সাইকেলের জন্য আলাদা পথ তৈরি করছে ব্রাজিল৷ ছবিতে দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যটন শহর বালনেরিও’র একটি সাইকেল পথ দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Greta Hamann
২২ কিলোমিটার
বালনেরিও শহরের এক লক্ষ মানুষের জন্য ইতিমধ্যে ২২ কিলোমিটার সাইকেল-পথ নির্মিত হয়েছে৷ এ বছরের মধ্যে সেটা দ্বিগুন হতে পারে৷ যদিও শহরের বাসিন্দারা এখনো সাইকেল ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছেন না৷
ছবি: Greta Hamann
গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা
অনেক ব্রাজিলিয়ান মনে করেন সাইকেল হলো গরিব মানুষের বাহন৷ তাই সেখানকার মধ্যবিত্তরাও ‘স্ট্যাটাস’ বজায় রাখতে গাড়ি কিনছেন৷
ছবি: Greta Hamann
লক্ষ্য শরীর ঠিক রাখা
অ্যাভেনিডা আটলান্টিকাকে দেখা যাচ্ছে বালনেরিও বিচের ধারে সাইকেল চালাতে৷ শরীর ঠিক রাখতে প্রায়ই তিনি এভাবে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন৷ এর ফলে শারীরিক পরিশ্রম হওয়ার পাশাপাশি পাওয়া যায় সাগরের সতেজ হাওয়া৷
ছবি: Greta Hamann
সাইকেল স্ট্যান্ড নেই
বালনেরিও শহরে সাইকেল আরোহীর সংখ্যা বাড়ছে৷ তবে বিচগুলোতে সাইকেল রাখার এখনো কোনো ব্যবস্থা চালু হয়নি৷ তবে শিগগিরই সেটা হবে বলে জানা গেছে৷
ছবি: Greta Hamann
সাইকেল-বান্ধব সংস্কৃতি
এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চেষ্টা করে যাচ্ছে ব্রাজিল৷ যেমন ফার্নান্ডো রোজেনবাউম সাইকেলে চড়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন আগ্রহীদের৷
ছবি: Greta Hamann
মাত্র চার শতাংশ
ব্রাজিলের বড় শহরগুলোর মাত্র চার শতাংশ জনগণ এখন সাইকেলে চড়ছেন৷ তবে সরকার আশা করছে, বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার কারণে হয়তো ধীরে ধীরে সেটা বাড়বে৷
ছবি: Greta Hamann
বাংলাদেশের জন্যও কি প্রয়োজন?
ঢাকার যানজটে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকে এখন সাইকেল বেছে নিচ্ছেন৷ ফলে এই তিন চাকার বাহনে করে অফিসগামী লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে৷ কিন্তু সাইকেলের জন্য আলাদা পথ না থাকায় কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই তাদের সাইকেল চালাতে হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
ফলে সাইকেল নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সংস্কৃতিই গড়ে ওঠেনি অধিকাংশ শহরে৷ অথচ গ্রামাঞ্চলের চিত্র কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা৷ ভারতের গ্রামগুলিতে এখনো সাইকেল অন্যতম পরিবহনের ব্যবস্থা৷ স্টেশনগুলির বাইরে রয়েছে সাইকেল স্ট্যান্ড৷ অনেকেই সাইকেল নিয়ে স্টেশন পর্যন্ত এসে ট্রেন ধরে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছান৷ এ কোনো নতুন ঘটনা নয়, শতাব্দীকাল ধরে এভাবেই চলে আসছে ভারতের গ্রামগুলির যোগাযোগ ব্যবস্থা৷ এখনো তা যথেষ্ট সফল৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ যেমন প্রযোজ্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে৷ সেখানে গ্রামাঞ্চলে সাইকেলের বহুল ব্যবহার থাকলেও শহরের রাজপথে সভ্যতার চাপে সাইকেল কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ব এবং পশ্চিম দুনিয়ার মধ্যে তফাত ঠিক এইখানেই৷ সভ্যতা কীভাবে পরিবেশকে ধ্বংস করে পশ্চিম তা বুঝতে শুরু করেছে৷ কিন্তু পূর্ব এখনো সভ্যতার নামে পরিবেশ ধ্বংসের খেলায় মত্ত৷ ফলে সাইকেল নিয়ে ভাবার মতো অবকাশটুকুই তাদের নেই৷ সেখানকার রাষ্ট্রনেতারা ভাবতেই পারেন না, শুধুমাত্র সাইকেলের ব্যবহার বারিয়ে কত পরিমাণ ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট' কমানো যায়৷
প্রদীপের তলায় অন্ধকার ছায়া থাকলেও আলোর নিশানা থাকে৷ আশার কথা, ভারতের বিভিন্ন শহরে সাইকেল নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে৷ তৈরি হয়েছে বহু ছোটবড় সাইকেল ক্লাব৷ সাইকেল নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে বছরভর৷ যার অন্যতম, প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা থেকে ঢাকা সাইকেল যাত্রা৷ এছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকায় সাইকেল যাত্রার আয়োজন করা হচ্ছে৷ পূর্ব কলকাতার ওই ঘটনার পরেও বহু আন্দোলনকারী সরকারের সমালোচনা করেছে৷ সমস্যার গোড়ায় না গিয়ে রাস্তা থেকে সাইকেল তুলে দেওয়ার কড়া সমালোচনা করা হয়েছে৷ আশা করা যায়, তাদের সমালোচনা সরকারের কর্ণগোচর হবে৷ ভারতের বড় বড় শহরগুলিতে ফিরে আসবে সাইকেল৷ তৈরি হবে ইউরোপের মতো ‘সাইকেল বে'৷