দুই জার্মান ছাত্র এবছর থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ক্রিসমাস কাটাবেন বলে ঠিক করেছেন৷ কিন্তু বিমানে নয়, ওঁরা যাচ্ছেন সাইকেলে চড়ে! এরই মধ্যে ঘুরে গেছেন কলকাতা৷ দেখেছেন অনেক কিছু৷
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণ জার্মানির ফ্রাইবুর্গের বাসিন্দা ২০ বছরের লুকাস ড্রেশার এবং ওঁর স্কুলের বন্ধু ২১ বছরের টিল ফিশার৷ স্কুলে পড়ার পালা সাঙ্গ হওয়ার পর, কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে ওঁদের হাতে ৯-১০ মাস মতো সময় ছিল৷ জার্মানি-সহ ইউরোপ এবং পশ্চিমের অন্যান্য দেশগুলোতে এই সময় অনেক ছাত্র-ছাত্রীই দেশ দেখতে রওনা হন৷ একইসঙ্গে চমৎকার ছুটি কাটানোও হয়, আবার বহির্বিশ্বের সঙ্গে ইতিহাস-ভূগোল বইয়ের বাইরে প্রাথমিক আলাপটাও হয়ে যায়, পরিচয় হয় বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গেও৷ লুকাস এবং টিল সেরকমটাই করবেন ভেবেছিলেন৷ তবে সাধারণ পর্যটক হিসেবে নয়, বরং অভিযাত্রী হিসেবে৷
স্কুলের পরীক্ষা শেষ করেই দুজনে রওনা দেবেন ভেবেছিলেন৷ তাই পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল অন্তত বছর খানেক আগে থেকেই৷ কোথায় যাবেন, তার থেকেও বেশি ওঁরা ভাবছিলেন, কীভাবে যাবেন৷ প্রথমে ওঁরা ভেবেছিলেন, বাসে চড়ে সড়কপথে ঘুরবেন৷ তার পর ওঁদের মনে হয়, যদি বাসের বদলে সাইকেলে চড়ে ওঁরা ঘোরেন, তা হলে যেমন এক একটা দেশ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাবেন, তেমন স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে আরও নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারবেন৷ যদিও লুকাস বা টিল, কেউই সে অর্থে সাইক্লিস্ট নন৷ ওঁদের কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না, এ ধরনের লম্বা সফরের জন্য কীরকম সাইকেল ব্যবহার করা ঠিক হবে৷
সুতরাং বেড়ানোর পরিকল্পনার পাশাপাশি শুরু হলো সাইকেল নিয়ে গবেষণা৷ অনেক দেখেশুনে ওঁরা কোগা মিনিয়েটা বলে এক বিশেষ ধরনের শক্তপোক্ত সাইকেল কিনলেন যা প্রায় সব ধরনের রাস্তাতে চলার উপযোগী৷ সঙ্গে কিনলেন হালকা তাবু, স্লিপিং ব্যাগ, গুছিয়ে নিলেন নিজেদের রুকস্যাক এবং রাস্তায় নেমে পড়লেন৷ লুকাসের থেকে বয়সে এক বছরের বড় টিল গত এক বছর ধরে একটা চাকরি করছেন৷ তিনি ওই চাকরির বেতন থেকে একটু একটু করে জমিয়ে রেখেছিলেন এই অভিযানের খরচ বাবদ৷ আর লুকাস সদ্য স্কুল ছেড়েছেন, তাঁর কোনও রোজগার ছিল না৷ কিন্তু তাঁর বাবা খুশি মনেই ছেলের এই অভিযানের খরচ জুগিয়েছেন৷ তবে বাবা হিসেবে একটু চিন্তা তো থাকেই৷ তাই লুকাসের বাবা ক্রিসমাসের কদিন আগেই পৌঁছে যাচ্ছেন ব্যাংকক৷ সেখানে তিনিই প্রথম ছেলেকে অভ্যর্থনা জানাতে চান৷ তাঁর সঙ্গে থাকবেন টিলের বান্ধবী৷ সবাই মিলে ক্রিসমাস পালন করবেন, এমনটাই পরিকল্পনা৷
কলকাতার হাতে টানা রিকশার একাল
কলকাতার কোনো কোনো জায়গায় এখনো হাতে টানা রিকশার চল রয়েছে৷ যদিও সংখ্যাটা দিনদিন কমছে৷ আর কতদিন থাকবে? চলুন জানার চেষ্টা করি এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
যবে থেকে শুরু
হাতে টানা রিকশার উদ্ভাবন ১৬ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, জাপানে৷ ১৯ শতকে যানটি গোটা এশিয়ায় বহুল ব্যবহৃত এক গণ-বাহন হয়ে দাঁড়ায়৷ ১৮৮০ সালে ভারতে প্রথম রিকশা চালু হয় হিমাচল প্রদেশের সিমলায়৷ সেখান থেকে হাতে টানা রিকশা চলে আসে কলকাতায়৷ ১৯১৪ সাল নাগাদ কলকাতায় ভাড়াটে রিকশার চলন হয়৷ এরপর এত বছর পরেও কলকাতার কোনো কোনো অঞ্চলে টিকে আছে এই হাতে টানা রিকশা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
প্রধান সড়ক থেকে গলিতে
কলকাতার প্রধান সড়কপথগুলোতে এখন অবশ্য আর রিকশা চলাচলের অনুমতি দেয় না পুলিশ৷ তার প্রথম কারণ রিকশার মতো ধীরগতির যানের কারণে রাস্তায় যানজট তৈরি হয়৷ তবে অন্য আর একটি কারণ হলো, আজকের দিনে রিকশার সওয়ারি হওয়া নিরাপদও নয়৷ ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই রিকশারা আশ্রয় নিয়েছে পুরনো কলকাতার গলি-ঘুঁজিতে, যেখানে ব্যস্ত ট্রাফিকের তাড়াহুড়ো নেই৷ রিকশায় চড়ে দুলকি চালে সফর করাও উত্তর কলকাতার অনেক বাসিন্দারই এখনও পছন্দসই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
এখনো ব্যবহারের কারণ
আধুনিক কোনো যন্ত্রচালিত যানের সঙ্গে গতি বা স্বাচ্ছন্দ্যে পাল্লা দিতে পারে না আদ্যিকালের রিকশা৷ তা-ও এটি কী করে কলকাতায় থেকে গেল, তার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে৷ এখনও অনেক বয়স্ক মানুষ রিকশা চড়তে পছন্দ করেন কারণ, এই যানটি তাঁদের জন্য যাকে বলে একেবারে হ্যাসল-ফ্রি৷ ঠিক একই কারণে অনেক বাড়ির বাচ্চারাও স্কুলে যাওয়ার সময় রিকশায় চড়ে যায়৷ তবে কলকাতা শহরে রিকশার সবথেকে বড় উপযোগিতা বোঝা যায় বর্ষায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
রিকশার ওয়ার্কশপ
যেহেতু শহরের রাস্তায় এখনও রিকশা চলে, মেরামতির জন্য রিকশার নিজস্ব হাসপাতালও নেই নেই করে এখনও দু-একটি টিকে আছে৷ এগুলো বিশেষভাবে হাতে টানা রিকশার মেরামতির জন্যই৷ অন্য কোনও কাজ এখানে হয় না৷ তবে আজকাল অসুবিধে হয়, কারণ রোজগার প্রতিদিনই কমছে৷ কাজ জানা লোকেরও অভাব৷ যদিও বা লোক পাওয়া গেল, তাদের দেওয়ার মতো যথেষ্ট কাজ পাওয়া যায় না৷ দোকানের মালিক শুয়ে বসেই দিন গুজরান করেন৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
কাঠ দিয়ে তৈরি চাকা
রিকশা তৈরি বা মেরামতিতে কিন্তু এখনও সেই পুরনো পদ্ধতিই বহাল৷ রিকশার চাকা যেমন এখনও কাঠ দিয়েই তৈরি হয়৷ মাঝখানের অংশটা যথারীতি লোহার, কিন্তু বাকি চাকার জন্য কারিগরদেরই জোগাড় করে আনতে হয় উঁচু মানের কাঠ যা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা শহরের খানা-খন্দে ভরা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে রিকশাকে গড়গড়িয়ে নিয়ে যাবে৷ সওয়ারিকে নিয়ে রিকশা যাতে ভেঙে না পড়ে, তার জন্য ভালো কাঠ বা লোহা যেমন দরকার, তেমনই দরকার ওস্তাদ কারিগর৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
খড় দিয়ে তৈরি বসার গদি
সওয়ারিদের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্যও রিকশাওয়ালারা সমান যত্নবান৷ যাত্রীদের বসার গদিটি যাতে ঠিকঠাক থাকে, এর জন্য নিয়মিত তার পরিচর্যা হয়৷ কাপড় আর রঙিন প্লাস্টিকের তৈরি এই গদির খোলে কী থাকে জানেন তো? না, তুলো বা ফোম নয়, নির্ভেজাল খড়৷ প্রকৃতি-বান্ধব উপাদান ব্যবহার করার এমন নমুনা কি আর কোনো শহুরে যানের ক্ষেত্রে দেখেছেন? রিকশা দূষণ ছড়ায় না, এটাও একটা খেয়াল রাখার মতো বিষয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
অমানবিক
তবু হাতে টানা রিকশা উঠে যাচ্ছে কলকাতা থেকে৷ কারণ, একজন মানুষ আর একজন মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এটা অনেকের কাছেই খুব অমানবিক মনে হয়৷ সাইকেল রিকশাতে যদিও একই ঘটনা ঘটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে চালক প্যাডেলের মাধ্যমে কিছুটা যান্ত্রিক সুবিধা পান৷ যদিও এই রিকশা নিয়ে রোমান্টিকতার কোনো শেষ নেই৷ পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির গোটা ক্লাইম্যাক্স সিনটিই গড়ে উঠেছে দুটি হাতে টানা রিকশার রেষারেষির মধ্য দিয়ে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
সময় কি বিদায় নেয়ার?
তাই দিনের শেষে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় যখন ছায়া দীর্ঘতর হয়, আর রাস্তার একধারে স্থবির হয়ে অপেক্ষায় থাকে সওয়ারি না পাওয়া একটি রিকশা, ব্যস্ত শহর তার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে তার কর্কশ কলরবে যেন বারবার মনে পড়িয়ে যায়, এবার সময় হয়েছে বিদায় নেওয়ার৷ আধুনিক সময়ের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না রিকশা৷ সে কারণেই রাজপথ থেকে সরে গিয়ে তাকে মুখ লুকোতে হয়েছে গলিতে৷ খুব শিগগিরই বোধহয় সেই আড়ালটুকুও যাবে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
8 ছবি1 | 8
লুকাস এবং টিলের সফরের প্রথম পর্বটা ছিল ইউরোপের মধ্য দিয়ে৷ দক্ষিণ জার্মানির ডোনাউশিঙ্গেন থেকে ডানিয়ুব নদীর পথ ধরে ওঁরা প্রথমে আসেন কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত, তার পর সেখান থেকে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া হয়ে ইস্তানবুল৷ তবে ওঁরা যেহেতু পোড় খাওয়া অভিযাত্রী নন, ইউরোপে যেমন মাঠে ঘাটে তাবু খাটিয়ে রাত কাটিয়েছেন, তেমন ইচ্ছে হলে হোটেলেও রাত্রিবাস করেছেন৷ সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রেও নিজেদেরকে চাপে রাখেননি৷ কখনও যেমন ৯-১০ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়েছেন, কখনও দু ঘণ্টাতেই থেমে গিয়েছেন৷ প্রয়োজনমত উঠেছেন ট্রেনে, বাসে বা বিমানে৷
ইস্তানবুল থেকে ওঁরা দুজন নেপাল এবং ভারতের ভিসা করিয়ে নিয়েছিলেন৷ প্রথম ওঁরা ইস্তানবুল থেকে বিমানে উড়ে যান নেপালের কাঠমান্ডু৷ সেখান থেকে প্রথমে ওঁরা ঠিক করেছিলেন সাইকেলে শিলিগুড়ি হয়ে, মিয়ানমার পার হয়ে একেবারে সোজা থাইল্যান্ড পৌঁছে যাবেন৷ তার পর ওঁরা জানতে পারেন, ভারত থেকে সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমার ঢোকা যায় না৷ তখন ওঁরা যাত্রাপথ বদলে, শিলিগুড়ির বদলে বিহারের যোগবাণী দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মালদায় চলে আসেন৷ কিন্তু তখন একটু ক্লান্ত লাগছিল দুজনেরই৷ তা ছাড়া রাস্তাও বেশ খারাপ ছিল৷ ওই রাস্তায় সাইকেল চালানোর ঝুঁকি না নিয়ে, একটা গাড়ি ভাড়া করে মালদা থেকে সোজা চলে আসেন কলকাতা৷
কলকাতায় জার্মান কনসুলেট ভবনে এসেছিলেন দুজনেই৷ জার্মান কনসাল জেনারেল রাইনার শ্মিডশেন ওঁদের কলকাতা দর্শনের একটা লম্বা লিস্ট বানিয়ে দিয়েছিলেন৷ সেই তালিকায় বেলুড় মঠ, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সবই ছিল৷ দেখেশুনে দুজনেই খুব খুশি৷ কলকাতা থেকে ট্রেনে দুদিনের জন্যে বারাণসী ঘুরে ফের ওরা যাত্রা শুরু করেছেন থাইল্যান্ডের দিকে৷ তবে জানিয়ে গিয়েছেন, থাইল্যান্ডেই ওঁদের অভিযান শেষ নাও হতে পারে!