সাইপ্রাসে যেভাবে দালালদের হাতে প্রতারিত হন বাংলাদেশিরা
১৯ জুন ২০২২সাইপ্রাসের লিমাসলে বসবাস করছেনবাংলাদেশের ইকবাল হোসেন৷ ২০১৬ সালে ছয় লাখ টাকার বেশি খরচ করে দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কাতার হয়ে আসেন তুরস্ক অধ্যুষিত নর্দার্ন রিপাবলিক অব টার্কিশ সাইপ্রাসে৷ এরপর সেখান থেকে আরেক দালালের মাধ্যমে আরো টাকা খরচ করে পৌঁছান ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ সাইপ্রাস রিপাবলিকে৷ দালাল তাকে কথা দিয়েছিল সাইপ্রাসে আনার পর বৈধ কাগজপত্র তৈরি করে দিয়ে ইউরোপের অন্য দেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিবে৷ কিন্তু সময় পার হওয়ার সঙে ইকবাল বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন৷ বাংলাদেশি সেই দালাল ততদিনে পাড়ি জমিয়েছেন দেশে৷
ইকবাল বলেন, ‘‘আমার মতো বহু লোককে দালাল এমন লোভ দেখিয়েছে৷ দালাল আমার কাছ থেকে পাঁচ লাখ ১৫ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছে৷ সে আমাকে বলেছে আমাকে বৈধ করে দিবে৷ কিন্তু সে আসলে টাকা নেয়ার ফন্দি করে৷ এই উপায়গুলো সবাই জানে৷ সে শুধু আমার টাকা নয় ৫০-৬০ জনের টাকা নিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছেন৷ তার বিরুদ্ধে এরইমধ্যে কুমিল্লা দক্ষিণ সদর থানায় জিডি করেছি৷''
‘অবৈধ উপায়ে আসলে মহাবিপদ'
সব মিলিয়ে ১২ লাখ টাকার বেশি খরচ করে আসা ইকবাল বলেন তার স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে৷ এখন তিনি ঋণ পরিশোধ করে দেশে ফিরতে চান৷ কিন্তু সমস্যা হলো আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে তিনি ভালো কোনো চাকরি পাচ্ছেন না৷ যেসব কাজ পাচ্ছেন সেগুলো তার পক্ষে করাও সম্ভব হচ্ছে না৷
ডয়চে ভেলের সংবাদকর্মী আরাফাতুল ইসলাম ও অনুপম দেব কানুনজ্ঞের কাছে প্রতারিত হওয়ার এমন নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সাইপ্রাসে বসবাসরত বাংলাদেশিরা৷
লিমাসলে বসবাস করা আরেক বাংলাদেশিশিবলি আহমেদ অবশ্য জানান তিনি বাংলাদেশের চেয়ে ভালো আছেন সেখানে৷ দেশটির শহরগুলোতে বসবাসরতরা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা রোজগার করতে পারেন৷ কিন্তু সেখানকার আইনের কারণে শরণার্থী বা আশ্রয়প্রাথীরা দীর্ঘদিন কাজের সুযোগ পাননি বলে জানান তিনি৷ এখন কতদিন কাজের সুযোগ পাবেন তা নিয়েও আশঙ্কা আছেন শিবলি৷ তিনি প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ করে বাংলাদেশ থেকে নর্থ সাইপ্রাসে আসেন৷ তাকেও দালালরা ভালো চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে আসেন৷ শিবলির মতে সেই প্রতিশ্রুতির কোনোটাই তারা পূরণ করেনি৷ ‘‘এখানে আসার পর আমরা খুব কষ্ট করেছি৷ আমি যেটা বুঝতে পেরেছি অবৈধ উপায়ে কেউ এ দেশে আসলেই মহাবিপদ৷ এখন যেটা হচ্ছে রাতের আঁধারে উত্তর সাইপ্রাস থেকে অভিবাসীরা দালালের মাধ্যমে সীমান্ত অতিক্রম করে৷ যদি পুলিশ ধরতে পারে তাহলে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর দুই তিন মাস পর দেশে প্রত্যাবর্তন করানো হয়,'' বলেন তিনি৷
এই অভিবাসীরা বলেন ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকেই সাইপ্রাসে বৈধ উপায়ে কাজের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারছেন অভিবাসীরা৷ কিন্তু বাংলাদেশিরা বাধ্য হচ্ছেন অনিয়মিতভাবে আসতে৷
বৈধ উপায়ে সাইপ্রাস
সাইপ্রাসের লিমাসলে গ্রিন ভ্যালি নামের একটি নার্সারিতে কাজ করছেন প্রায় ২৫ জন বাংলাদেশি৷ গোটা প্রতিষ্ঠানটিই বাংলাদেশিরা পরিচালনা করছেন৷ তাদের মধ্যে ১৩ বছর আগে এসেছেন মিজানুর রহমান৷ তারা সবাই কাজের ভিসা নিয়েই এসেছেন৷ তিনি বলেন, অনিয়মিত উপায়ে দালালের মাধ্যমে যারা দেশটিতে আসেন তারা প্রতারিত হন৷ তাদের এক কাজ দেয়ার কথা বলে অন্য কাজ দেয়া হচ্ছে৷ এমনকি বেতনের প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করা হচ্ছে না৷
দিদার নামে সেখানে কর্মরত আরেকজন জানান, তিনি শিক্ষার্থী হিসেবে আসার পর এক পর্যায়ে বাংলাদেশে ফিরে যান৷ পরে পূর্ব পরিচয়ে সূত্রে কাজের চুক্তিপত্রের ভিত্তিতে ভিসা নিয়ে আবারও বৈধ উপায়ে আসেন সাইপ্রাসে৷ বর্তমানে তিনি ভালো আছেন বলে জানান৷ তবে দিদার বলেন সাইপ্রাসে বাংলাদেশের কোন দূতাবাস না থাকায় কাগজপত্র নিয়ে তারা জটিলতায় পড়েন৷ এজন্য তাদের লেবানন দূতাবাসের মাধ্যমে কাজ করতে হয়৷ ২০১০ সাল থেকে বসবাসরত এই নার্সারির আরেক কর্মী রানা বলেন, ‘‘দূতাবাস করা হলে সাইপ্রাসে বাংলাদেশিদের কাজের সুযোগ অনেক বাড়বে৷ এতে বাংলাদেশও অনেক উপকৃত হবে৷ এখানে ব্যবাসা ও কাজের অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না দূতাবাস না থাকায়৷''
১৯ বছর ধরে সাইপ্রাসে আছেন রবিউল৷ তিন প্রথম এসেছিলেন শিক্ষার্থী হিসেবে৷ পড়াশোনা শেষ করে পরবর্তীতে ২০১৬ সালে দেশটির নাগরিকত্বও পান৷ এখন তিনি ব্যবসা করছেন সেখানে৷ রবিউল বলেন, ‘‘সাইপ্রাসে অনিয়মিত পথে অভিবাসনে ভূমিকা রাখছে দেশটির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও৷ অনিয়মিত পথে আসা অভিবাসীদের কাগজপত্র ছাড়াই কাজে লাগাচ্ছে তারা৷ তবে তার মতে প্রযুক্তি, জাহাজ শিল্প, পর্যটনসহ অনেক খাতেই বৈধ উপায়ে বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা দেশটিতে আসার সুযোগ আছে৷ কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ঘাটতি থাকায় তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না৷''
এফএস/আরকেসি