মুম্বাই সন্ত্রাসীকাণ্ডের হোতা হাফিজ সাঈদকে গৃহবন্দি করেছে পাকিস্তান৷ তবে দিল্লি মনে করছে, এটা লোকদেখানো৷ লস্কর-ই-তৈয়বা ও জামাত-উদ-দাওয়ার প্রধান হাফিজকে কয়েকবার আটক করেও ছেড়ে দেওয়ার অতীত মনে করেই দিল্লির এই সন্দেহ৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের কূটনৈতিক চাপে বা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের তাপে পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক প্রশাসন লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) এবং জামাত-উদ-দাওয়া (জেইউডি) জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রধান হাফিজ সাঈদ ও আরও চারজনকে নিবর্তনমূলক আটক আইনে গৃহবন্দি করে রাখেনি কিংবা তাঁদের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি৷ সব কিছুই করা হয়েছে আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের ধমকে৷ কার্যত পাকিস্তানের কাছের বন্ধু চীনসহ আন্তর্জাতিক চাপে৷ কাজেই ভারতের উল্লসিত হবার কারণ নেই৷ পাকিস্তানের সন্ত্রাস-বিরোধী পদক্ষেপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও সংশয় রয়ে গেছে দিল্লির মনে৷ জইসে মহম্মদ জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রধান মাসুদ আজহারকে রেহাই দেওয়া হয়েছে কেন?
দ্বিতীয়ত, ২০০৮ সালে ২৬/১১-এর মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার পর এর মূল হোতা হাফিজের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবার জন্য ক্রমাগত বলে এসেছে ভারত এবং তথ্যপ্রমাণও তুলে দিয়েছে পাকিস্তানের হাতে, কিন্তু কাজ হয়নি৷ কিছুদিন আটক থাকার পর দিব্যি ছাড়া পেয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে৷ একবার নয়, একাধিকবার৷ আর ভারতের বিরুদ্ধে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলায় মদত দিয়ে গেছে৷ তা সে পাঠানকোট বিমান ঘাঁটি হোক বা জম্মু-কাশ্মীরের উরি সেক্টরে হোক৷ এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না৷ কাজেই এতে ভারতের উত্ফুল্ল হবার তেমন কারণ নেই৷ এ বিষয়ে পাকিস্তানের যদি সত্যিই আন্তরিক সদিচ্ছা থাকে, তাহলে পাকিস্তানের মাটি থেকে জঙ্গি ঘাঁটিগুলি উত্খাত করছে না কেন? ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র বিকাশ স্বরুপ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে দিল্লির নীতি ‘ওয়েট অ্যান্ড সি'৷ ঘটনার গতি প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রাখা৷''
বিশ্বের ভয়ংকর পাঁচ জঙ্গি সংগঠন
তথাকথিত জঙ্গিদের কারণে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷ অনেকেরই ধারণা তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-ই সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি গোষ্ঠী৷ কিন্তু বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচি বা গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স কিন্তু বলছে ভিন্ন কথা৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Lieman
বোকো হারাম
ইসলামিক স্টেট বা আইএস নয়, বিশ্বের ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়ার বোকো হারাম৷ ২০১৫ সালে আবু বকর শেকাউ-এর নেতৃত্বে এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি ৬ হাজার ৬৪৪ জন মানুষকে হত্যা করেছে৷ তাদের হামলায় আহত হয়েছে ১,৭৪২ জন৷ বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক৷ এছাড়া হাজারো কিশোরীকে অপহরণ করেছে বোকো হারাম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S.Alamba
ইসলামিক স্টেট
যদিও বোকো হারাম আইএস-এর তুলনায় বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, কিন্তু আতঙ্ক সৃষ্টির দিক থেকে সবচেয়ে উপরে আছে আইএস৷ বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলা হচ্ছে আইএসকে৷ ২০১৫ সালে তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৭৩ জন মানুষ এবং আহত হয় ৫ হাজার ৭৯৯ জন৷ ১০৭১টি হামলা চালিয়েছে তারা বিশ্ব জুড়ে৷ আবু বকর আল-বাগদাদির নেতৃত্বে সংগঠনটি সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক ও ইউরোপ জুড়ে এখনো হামলা চালিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তালেবান
১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলার সময় এই জঙ্গি সংগঠনটির আবির্ভাব৷ বিশ্বের সবচেয়ে অভিজ্ঞ জঙ্গি সংগঠন বলা হয় এদের৷ ২০১৫ সালে তালেবানের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৩ হাজার ৪৭৭ জন এবং আহত হয়েছে ৩ হাজার ৩১০ জন৷ গত বছর বিশ্ব জুড়ে ৮৯১ টি হামলা চালিয়েছে তারা৷ হিবাতুল্লাহ আকন্দজাদা এখন তালেবানের নেতৃত্বে রয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Noorullah Shirzada
ফুলানি জঙ্গি গোষ্ঠী
বিশ্বব্যাপী এদের তেমন পরিচিতি নেই৷ এরা নাইজেরিয়ার ফুলা সম্প্রদায়ের মানুষ৷ এদের লক্ষ্য ফুলানির ভূমি মালিকদের হত্যা করা৷ ২০১৫ সালে ১৫০ টি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে ফুলানি, তাদের হামলায় মারা গেছে ১ হাজার ২২৯ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Lieman
আল-শাবাব
বোকো হারামকে যদি আইএস-এর সাথে তুলনা করা হয়, তবে আল শাবাবকে তুলনা করা যায় আল-কায়েদার সঙ্গে৷ পূর্ব আফ্রিকায় এদের আধিপত্য অনেক বেশি৷ সোমালিয়াকে ইসলামিক রাষ্ট্র বানানোই তাদের মূল লক্ষ্য৷ গত বছর জঙ্গি গোষ্ঠীটি ৪৯৬টি হামলা চালিয়েছে, হত্যা করেছে ১ হাজার ২১ জন মানুষকে, আহত হয়েছে ৮৫০ জন৷
ছবি: A. Ohanesian
5 ছবি1 | 5
প্রশ্ন যেটা উঠেছে তা হলো, হঠাৎ ইসলামাবাদের অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাবার কারণ কী ? কূটনৈতিক এবং পর্যবেক্ষক মহলের মতে, প্রথমত ট্রাম্পকে খুশি করা৷ সদর্থক বার্তা দিয়ে বলতে চায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তান ট্রাম্প সরকারকে সব রকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত৷
কারণ, এ মাসেই বসছে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে অর্থ জোগানের পথ বন্ধ করতে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স, সংক্ষেপে এফএটিএফ-এর পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বৈঠক৷ হাফিজের জঙ্গি গোষ্ঠী জামাত-উদ-দাওয়ার জন্য জেহাদি তহবিলে অর্থ সংগ্রহ শাখা ফালাহ-ই-ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপে যে রিপোর্ট পেশ করা হয়, তাতে আরও বেশি নার্ভাস পাকিস্তান৷
রিপোর্টে পাকিস্তানকে জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বলা হয়৷ আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে সাবধান করা হয়, এর বিহিত করতে সন্ত্রাসী কাণ্ডকারখানা চালাতে অর্থ জোগানদার সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে পাকিস্তান অবিলম্বে যদি উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে যে সাতটি মুসলিম মৌলবাদী দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন ট্রাম্প, তার সঙ্গে যুক্ত হবে পাকিস্তানের নামও৷ কালো তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবে পাকিস্তান৷ এতে দারুণভাবে মার খাবে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি৷ তার উপর ট্রাম্পের নতুন অভিবাসন নীতি বোঝার ওপর শাকের আঁটি৷ ট্রাম্প প্রশাসন থেকে এমন অভিযোগ উঠেছে, পাকিস্তানের মদত না পেলে ওসামা বিন লাদেনের মতো একজন সন্ত্রাসবাদী কিভাবে ছয় বছর পাকিস্তানে সপরিবারে এবং বহাল তবিয়তে লুকিয়ে থাকতে পারে?
‘ইসলামিক স্টেট’ আসলে কী?
আল-কায়েদার অখ্যাত এক উপদল থেকে প্রভাবশালী ‘মিলিট্যান্ট মুভমেন্টে’ পরিণত হয়েছে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস৷ জিহাদি এই গোষ্ঠীটির দখলে থাকা অঞ্চল থেকে আক্রমণের কৌশল – আইএস-এর এমন নানা দিক তুলে দেয়া হলো এই ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
আইএস কোথা থেকে এসেছে?
ইসলামিক স্টেট (আইএস) সুন্নী ইসলামিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী আল-কায়েদার একটি উপদল, যেটি আইএসআইএল, আইসিস এবং দায়েশ নামেও পরিচিত৷ ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর এটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন আবু বকর আল-বাগদাদি৷ জঙ্গি গোষ্ঠীটির লক্ষ্য হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া এবং অন্যান্যা অঞ্চল নিয়ে একটি ইসলামিক স্টেট বা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইএস কোথায় কাজ করে?
বিশ্বের ১৮টি দেশে আইএস সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷ ইরাক এবং সিরিয়ার কিছু অংশ এই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং এটি সিরিয়ার রাকা শহরকে রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে৷ তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন অবধি নিজেদের দখলে থেকে এক চতুর্থাংশ এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে৷
কারা তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে৷ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে তৈরি মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি ‘কোয়ালিশন’ আইএস অধ্যুষিত এলাকায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷ এই কোয়ালিশনে কয়েকটি আরব দেশও রয়েছে৷ অন্যদিকে সিরিয়া সরকারের পক্ষে সেদেশে বিমান হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া৷ তবে ভূমিতে তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে কুর্দিশ পেশমার্গার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো৷
ছবি: picture-alliance/abaca/H. Huseyin
আইএস-এর অর্থের উৎস কী?
জঙ্গি গোষ্ঠীটির অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে তেল এবং গ্যাস৷ এটি এখনো সিরিয়ার তেল উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ দখলে রেখেছে৷ আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জঙ্গি গোষ্ঠীর এই মূল্যবান সম্পদ৷ এছাড়া কর, মুক্তিপন এবং লুট করা পুরাকীর্তি বিক্রি করেও অর্থ আয় করে এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
আইএস কোথায় কোথায় জঙ্গি হামলা চালিয়েছে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস৷ চলত বছর সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলাটি চালানো হয়েছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে, যেখানে দু’শোর বেশি মানুষ নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে৷ আইএস-এর নেতারা জঙ্গি গোষ্ঠীটির আদর্শে বিশ্বাসীদের এককভাবে বিভিন্নস্থানে আঘাত হানতে উৎসাহ প্রদান করে৷
অন্যান্য আর কী কৌশল ব্যবহার করে আইএস?
নিজেদের ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে অনেক কৌশল ব্যবহার করে আইএস৷ জঙ্গি গোষ্ঠীটি ‘কালচারাল ক্লিনজিংয়ের’ নামে সিরিয়া এবং ইরাকের অনেক ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম লুট ও ধ্বংস করেছে৷ এছাড়া সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর কয়েকহাজার মেয়েকে ক্রীতদাসী বানিয়েছে৷ গোষ্ঠীটি নিজেদের ‘প্রোপোগান্ডা’ এবং নিয়োগের কাজে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
শরণার্থী হয়েছেন কতজন?
সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেদেশের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবেশী লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন৷ অনেক সিরীয় ইউরোপেও পাড়ি জমিয়েছেন৷ এছাড়া প্রায় ৩০ লাখ ইরাকে ইরাকের মধ্যেই অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
7 ছবি1 | 7
অন্যদিকে ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের দুজন অ্যাথলিটকে অ্যামেরিকার স্নো-শ্যু প্রতিযোগিতায় যোগ দেবার জন্য আমেরিকায় যাবার ভিসা মঞ্জুর করেনি নতুনদিল্লির মার্কিন দূতাবাস৷ যদিও আমন্ত্রণপত্র এবং অন্যান্য বৈধ কাগজপত্র ছিল তাঁদের কাছে৷ তারপরও ভিসা মঞ্জুর না করার কারণ জানতে চাওয়া হলে মার্কিন ভিসা অফিস থেকে বলা হয়, এদের দুজনের ক্ষেত্রে নতুন ভিসানীতি প্রযোজ্য বিশেষ কারণে৷ তবে সব ভারতীয়ের ক্ষেত্রে তা নয়৷ আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা জারির ভয়ে পাকিস্তান ক্রমশই নতজানু হচ্ছে এই অভিযোগে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা শরিফ সরকারের তীব্র নিন্দা করেছে৷ সাঈদের সমর্থকদের অভিযোগ, ভারতে মোদীর দক্ষিণপন্থী বিজেপি সরকারকে হাতে রাখতে ইসলামাবাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে ট্রাম্প৷