সাউথ আফ্রিকায় শেষ আফগান ‘স্বপ্নযাত্রা’
১০ নভেম্বর ২০২৩সাউথ আফ্রিকার সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল আগেই, আর আফগানিস্তানের সেমিফাইনাল স্বপ্নও এই ম্যাচের আগেই কার্যত শেষ৷ তবে আফগানদের সামনে সুযোগ ছিল এবার তাদের বিশ্বকাপ অভিযান জয় দিয়ে শেষ করার৷ আশা জাগিয়েও সেটা তারা পারেনি বটে, তবে বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে তারা বিদায় নিচ্ছে মাথা উঁচু করেই৷ সেমিফাইনালের স্বপ্নটা অধরা থেকে গেছে, তবে ভারত থেকে আরও বড় স্বপ্নের রেশ নিয়ে তারা ফিরতে পারছে দেশে৷
সত্যিকার অর্থে এই বিশ্বকাপে যদি কোনো চমকে দেওয়া দল থাকে, সেটা আফগানিস্তানই৷ আগের দুই বিশ্বকাপে যাদের মাত্র একটি জয়, তারাই এই বিশ্বকাপে হারিয়েছে তিন সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলংকাকে৷ সাথে নেদারল্যান্ডসসহ চার জয়ের পর সেমির স্বপ্নও ছিল বাস্তব৷ অস্ট্রেলিয়ার সাথে জয় পেলে হয়তো সেটাও হয়ে যেত, হয়নি গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় এক ইনিংসের জন্য৷ তবে ম্যাক্সওয়েল যে ধাক্কা দিয়েছেন, আফ্রিকার সাথে সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে তারা লড়াই করেছে এই ম্যাচেও৷ সেটার বড় কৃতিত্ব আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের৷
এই বিশ্বকাপের আগে আট ওয়ানডেতে ওমরজাইয়ের রান ছিল ১৩৭৷ তিনি আজ আরেকটু হলেই পেয়ে যেতেন নিজের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি৷ এই বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের হয়ে দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটাও পেতে পেতে পাওয়া হয়নি, ৯৭ রানে থামতে হয়েছে তাকে৷
সেঞ্চুরিটা ওমরজাইয়ের হয়তো প্রাপ্য ছিল৷ নিজের জন্য তো বটেই, আফগানিস্তানের জন্যও৷ নিজেদের দেশে এখন পর্যন্ত একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচও যারা খেলতে পারেনি, অনুশীলন-প্রস্তুতি সবকিছু নিতে হয় দূরের আমিরাতে- তাদের জন্য বিশ্বকাপে ভালো করাটাই তো দুর্দান্ত একটা ব্যাপার৷ আর নব্বই দশকের শুরুতেও যাদের কোনো ক্রিকেট বোর্ড ছিল না, যাদের সবচেয়ে বড় তারকা রশিদ খানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেট-কোচিং নেই, যাদের ক্রিকে্টের শুরুটাই শরণার্থী শিবিরের অনিশ্চিত ও টানাপোড়েনের দিনগুলো থেকে- তাদের জন্য এই বিশ্বকাপের অর্জন রীতিমতো রূপকথাই৷
তবে সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ হলে সেই রূপকথার গল্পটা আরও একটা ক্লাইম্যাক্স পেত৷ সেটা হয়নি, তবে আফগানরা বিনা লড়াইয়ে আত্মসমর্পণ করেনি৷ আফগান স্পিনাররা ভালোমতোই চেপে ধরেছিলেন প্রোটিয়া ব্যাটারদের৷ এই টুর্নামেন্টে রান তাড়া করতে গিয়ে একবার হেরেছে আফ্রিকা, আরেকবার হারতে হারতে জিতেছে৷ আজ আগের ম্যাচের মতো অতোটা খাবি খেতে হয়নি, কিন্তু জয়টা খুব সহজেও আসেনি৷ রেসি ভ্যান ডার ডুসেন না থাকলে আজ গল্পটা অন্যরকমও হতে পারত৷
ভ্যান ডার ডুসেন যখন ক্রিজে আসেন, তার আগে আফ্রিকা পেয়ে গিয়েছিল দারুণ একটা শুরু৷ ম্যাচটা যে এতদূর গড়াবে, কুইন্টন ডি ডক ও টেন্ডা বাভুমাদের শুরু কিন্তু সেটা বলছিল না৷ ডি কক স্বপ্নের মতো একটা বিশ্বকাপ কাটাচ্ছেন, আজও শুরু থেকে বড় কিছুর আভাস দিচ্ছিলেন৷ ওমরজাইকে ছয় মেরে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আজও তিনি ছন্দে আছেন৷ অন্য পাশে বাভুমা অবশ্য বেশ ভুগছিলেন তার হ্যামস্ট্রিংয়ের জন্য, দৌড়াতেই রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল তার৷ শেষ পর্যন্ত ২৮ বলে ২৩ রান করে মুজিব উর রেহমানকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে এলেন ডিপ স্কয়্যার লেগে৷ ১১ ওভারের মধ্যে তখন ৬৪ রান তুলে ফেলেছে আফ্রিকা৷
দুই ওভার পর উদযাপনের আরও বড় উপলক্ষ পেয়ে গেল আফগানরা৷ এবার ডি কক মোহাম্মদ নবীকে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে হলেন এলবিডব্লু, ফিরে গেলেন ৪১ রানে৷ আম্পায়ার অবশ্য আউট দেননি, কাজে এসেছে নবীদের রিভিউ৷ ভ্যান ডার ডুসেন আর এইডেন মার্করাম এরপর দলকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন৷ এমনকি ২৫ রান করে যখন মার্করাম আউট হলেন তখনও ঈশান কোনে মেঘ দেখতে পায়নি আফ্রিকা৷ সেটা একটু একটু দেখতে পেল ক্লাসেন ১০ রানে রশিদ খানের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হওয়ার পর৷ ১৩৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে আফ্রিকা তাদের সহজ লক্ষ্যটা তখন খানিকটা কঠিন মনে করাচ্ছিল৷
এরপর ডেভিড মিলার আর ডুসেন মিলে আর বিপদ হতে দেননি৷ দুজন যখন মোটামুটি থিতু তখন আবার নবীর আঘাত, এবার তাকে ২৪ রানে ফিরতি ক্যাচ দিলেন মিলার৷ ১৮২ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে এবার হয়তো কিছুটা অস্বস্তি আফ্রিকার ড্রেসিংরুমে৷
এরপর অ্যান্ডাইল ফেহলেকায়োকে নিয়ে ধীরেসুস্থে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ডুসেন৷ সিঙ্গেল নিয়েই একটু একটু করে জয়ের বন্দরে তরী ভেড়াচ্ছিলেন দুজন৷ শেষ ২৪ বলে ২৩ রান যখন দরকার, তখনও দুজন দেখেশুনেই খেলছিলেন৷ শেষ পর্যন্ত নাভিন উল হকের ৪৮তম ওভারকেই ম্যাচ শেষের জন্য বেছে নিলেন ফেহলেকায়ো৷ ছয়, চার, ছয় মেরে শেষ করে দিলেন আফগানদের সব আশা৷ তবে ডুসেনই ছিলেন দুই দলের আসল পার্থক্য৷ ৯৫ বলে ৭৬ রানের ইনিংসটা ম্যাচসেরার পুরস্কারও এনে দিয়েছে তাকে৷ এই বিশ্বকাপেই আগে দুই সেঞ্চুরি ছিল তার, তবে রান তাড়ায় ঠান্ডা মাথার এই ইনিংসটা পরিস্থিতির বিচারে সেঞ্চুরির মতোই মূল্যবান৷
আজকের ম্যাচের মূল নায়ক যদি ভ্যান ডার ডুসেন হন, তবে পার্শ্বনায়ক অবশ্যই দুজন৷ একজন আফ্রিকার জেরাল্ড কোটজিয়া, চার উইকেট নিয়ে যিনি আফগান ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছেন৷ আরেকজনকে অবশ্য ট্র্যাজেডির নায়ক বলাই ভালো, আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের ৯৭ রানের ইনিংসটাই স্বপ্ন দেখাচ্ছিল আফগানদের৷ দুর্ভাগ্য তাদের, সেটা জয়ের জন্য যথেষ্ট হয়নি৷
অথচ আফগান দুই ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজ ও ইব্রাহীম জাদরান শুরুটা ভালোই করেছিলেন, ৮ ওভারেই তুলে ফেলেছিলেন ৪১ রান৷ নবম ওভারেই স্পিনার কেশব মহারাজকে আক্রমণে নিয়ে এসেছিলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক টেন্ডা ওভারেই, প্রথম বলেই ব্রেকথ্রু মহারাজের৷ স্লিপে ক্যাচ প্র্যাকটিস করিয়ে ২২ বলে ২৫ রান করে ফিরে গেলেন গুরবাজ, আরো একটা ম্যাচে শুরু পেয়েও বড় স্কোর করতে পারলেন না৷
আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান ইব্রাহীম জাদরানও শুরুটা পেয়েছিলেন৷ কিন্তু সেটা আজ আর বড় করতে পারলেন না, কোটজিয়াকে হুক করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে, ফিরলেন ১৫ রান৷ অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহিদিও টিকলেন না বেশিক্ষণ, ৪৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে খানিকটা পথ হারিয়ে ফেলেছিল আফগানরা৷
এরপর রহমত শাহকে নিয়ে কিছুটা হাল ধরেছিলেন ওমরজাই৷ দুজনের ৩৯ রানের জুটি ভাঙে এনগিডির বলে রহমত ক্যাচ দিলে, ফেলতে ফেলতেও সেটি শেষ পর্যন্ত ধরে ফেলেন ডেভিড মিলার৷ ইকরাম আলী খিলও এরপর কোটজিয়ার বলে আউট হলে ১১২ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে আফগানরা৷ খানিক পর সেটা হয়ে যায় ১১৬ রানে ৬ উইকেট, যখন মোহাম্মদ নবীও ফিরে যান এনগিডির বলে৷
তবে ওমরজাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন টেল এন্ডারদের নিয়ে৷ প্রথমে তাকে সঙ্গ দিয়েছেন রশিদ খান, ৪৪ রান এসেছে দুজনের সপ্তম উইকেট জুটিতে৷ এর মধ্যে ৭১ বলে ওমরজাই পেয়েছিলেন ফিফটি, এই টুর্নামেন্টে এটি তার তৃতীয়৷ এরপর নূর আহমেদ এসে ২৬ রানের ইনিংস খেলে আরও এগিয়ে দিয়েছিলেন আফগানদের৷ নূরের ক্যাচ ধরেই এই ম্যাচে ষষ্ঠ ডিসমিসাল হয়ে গেছে কুইন্টন ডি ককের, ছুঁয়েছেন বিশ্বকাপে এক ম্যাচে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও সরফরাজ আহমেদের গড়া সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের রেকর্ড৷
এরপর মুজিব ও শেষ ব্যাটসম্যান নাভিনকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন ওমরজাই৷ ইব্রাহীমের পর দ্বিতীয় আফগান ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির খুব কাছাকাছিও চলে গিয়েছিলেন৷ শেষ ওভারে চার রান করলেই পেয়ে যেতেন ওয়ানডেতে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি, কিন্তু দুর্দান্ত এক শেষ ওভারে সেটা হতে দেননি রাবাদা৷ ৯৭ রানে অপরাজিত থেকে ‘এত কাছে, তবুও এতদূরের’ অতৃপ্তি নিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয়েছে ওমরজাইকে৷
দিন শেষে সেই অতৃপ্তি সঙ্গী হয়েছে আফগানিস্তানেরও৷ আজ জয় পেলে এই বিশ্বকাপের গল্পটা আরও রঙিন হতে পারত তাদের৷ তবে যা হয়েছে, তা নিয়ে তারা গর্ব করতেই পারে৷ স্রোতের সাথে তো সবাই বৈঠা বাইতে পারে, কিন্তু বিরুদ্ধে বৈঠা বেয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে কয়জন?
সংক্ষিপ্ত স্কোর
আফগানিস্তান ৫০ ওভারে ২৪৪ (ওমরজাই ৯৭*, নূর ২৬, রহমত ২৬; কোটজিয়া ৪/৪৪; মহারাজ ২/২৫, এনগিডি ২/৬৯)
সাউথ আফ্রিকা ৪৭.৩ ওভারে ২৪৭-৫ (ভ্যান ডার ডুসেন ৭৬*, ডি কক ৪১, ফেহলেকায়ো ৩৯; নবী ২/৩৫, রশিদ ২/৩৭)
ফল: আফ্রিকা ৫ উইকেটে জয়ী
ম্যাচসেরা: রেসি ভ্যান ডার ডুসেন