যুদ্ধাপরাধ মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷ তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে একাত্তরে হত্যা ও গণহত্যাসহ ৯টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চট্টগ্রামে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক নিধনে অংশ নেয়া এবং নির্যাতন কেন্দ্র চালানোর অপরাধে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে বিএনপির সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বা সাকা চৌধুরীকে মঙ্গলবার ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দিয়েছে আদালত৷ প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামীর বাইরে এই প্রথম অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় রায় দেয়া হলো৷
২০১০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সাকা চৌধুরীকে হরতালে গাড়ি ভাঙচুরসহ আরো কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখান হয় ২০১১ সালের ১৭ই জানুয়ারি৷ তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনাল ১-এ তার বিরুদ্ধে মোট ২৩টি অভিযোগের বিচার শুরু হয়৷ সাক্ষ্য গ্রহণ এবং যুক্তি তর্ক শেষ হয় গত জুলাই মাসে৷ এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৪১ জন সাক্ষী দেন৷ আর সাকা চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষী দেন মোট চারজন৷
মামলাটি এরপর থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষমান ছিন৷ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় ঘোষণা করেন৷
ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে৷ এ বছর প্রথম রায়ে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন অভিযাগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য আবুল কালাম আযাদকে৷
ছবি: AP
কাদের মোল্লার ‘বিজয়প্রতীক’, দেশজুড়ে বিক্ষোভ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিতি পাওয়া কাদের মোল্লাকে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় এবং রায়ের পর কাদের মোল্লা আঙুল উঁচিয়ে বিজয়প্রতীক দেখানোয় শুরু হয় বিক্ষোভ৷
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে প্রবল অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ দেখা দিলে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়৷ এর আগে শুধু আসামিপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল৷ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের পর জামায়াতে ইসলামীও বিক্ষোভে নামে৷ দলটি মনে করে, এ রায় যথার্থ হয়নি৷ সেই থেকেই শুরু রায়ের প্রতিবাদে হরতাল৷
ছবি: Reuters
সাঈদির ফাঁসির আদেশ
জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অপরাধে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইবুনাল৷ প্রতিবাদে হরতাল ডাকে জামায়াতে ইসলামি৷ জামায়াত এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপক তাণ্ডব চালায়৷ সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির লুট, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ স্টেশনে হামলা,অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ – সবই ঘটেছে, অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে তখন৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তি দাবি
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার কয়েকজন ব্লগারের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজত-এ ইসলাম৷ ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁদের ‘নাস্তিক’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়৷ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমর্থন এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে৷ চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখে সরকার৷
ছবি: Reuters
অবশেষে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ
মঙ্গলবার সংশোধিত আপিল আইনের আওতায় গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসি দিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেয় আপিল বিভাগ৷রায় ঘোষণার আগে সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
উৎসবের আনন্দ
এ রায়ে আবার জেগে ওঠে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর৷ ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ শুনে সেখানে আবার নামে মানুষের ঢল৷ অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি হতে চলেছে – এটাই তাঁদের আনন্দ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
জামায়াতের হরতাল, বিক্ষোভ
কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী৷ রায়কে ‘ভুল’ দাবি করে, অভিযুক্ত সব নেতার মুক্তির দাবিতে এ হরতাল ডেকেছে তারা৷ আবার বিক্ষোভে নেমেছে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা৷কাদের মোল্লার আইনজীবী জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ডের রায় পর্যালোচনার জন্য আবেদন করা হবে৷ তবে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ রায় পর্যালোচনার কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
9 ছবি1 | 9
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট ২৩টি অভিযোগ ছিল৷ এর মধ্যে মুক্তিযদ্ধ চলাকালে একাত্তর সালের ১৩ই এপ্রিল চট্টগ্রামের কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকাণ্ড; চট্টগ্রামের গহিরা, জগন্নাথপাড়া, সুলতানপুর, বণিকপাড়া, ঊনসত্তরপাড়া, শাকপুর প্রভৃতি স্থানে গণহত্যা অন্যতম৷ অভিযোগে বলা হয়, চট্টগ্রামের গুডসহিলে সাকা চৌধুরীর পৈত্রিক বাড়ি ছিল একাত্তরে টর্চার সেল৷ অনেক ব্যক্তিকে সেখানে ধরে নিয়ে নির্যাতন এবং হত্যা করা হয়েছে৷ এছাড়া, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিপীড়নে পাকিস্তানি সেনাদের সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে, যা মঙ্গলবার প্রমাণিত হয়৷
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ডয়চে ভেলেকে বলেন, তাঁরা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে হত্যা, গণগত্যা, নির্যাতনের ঘটনা সাক্ষী এবং তথ্য দিয়ে প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন৷
এদিকে, সাকা চৌধুরীর রায় ঘোষণার কারণে ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে৷ মঙ্গলবার সাকা চৌধুরীর রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে সপ্তম রায় দিল ট্রাইব্যুনাল৷ এর আগে অন্য ছয়টি রায়ে জামায়াত নেতাদের শাস্তি হয়৷