এটা সম্ভবত যে কোনও বাংলাভাষী অঞ্চলের জন্যই খুশির খবর৷ কেরালাকে পেছনে ফেলে ভারতে সাক্ষরতায় সবার থেকে এগিয়ে প্রত্যন্ত রাজ্য ত্রিপুরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিজ্ঞাপন
সাক্ষরতা তো সাক্ষরতাই৷ সেটা যে কোনো ভাষার জন্যেই সাক্ষরতা৷ তা হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা দেশের মধ্যে সবথেকে স্বাক্ষর রাজ্য হয়ে উঠলে বাংলা ভাষার উল্লসিত হয়ে ওঠার কারণ কী?
অত্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন৷ কিন্তু তার জবাব খোঁজার আগে একবার ভারতে সাক্ষরতার হারের তথ্য-পরিসংখ্যানে নজর দেওয়া যাক৷ এতদিন পর্যন্ত ভারতের সবথেকে স্বাক্ষর রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে দক্ষিণ ভারতের কেরালা৷ এই নিয়ে কেরলবাসীর মনে নিশ্চিত গর্ব ছিল৷ ত্রিপুরা সেখানে ছিল সাক্ষরতা তালিকার অনেকটাই নীচে৷ ২০০১ সালে ৭৩.১৯ শতাংশ সাক্ষরতার হার নিয়ে ত্রিপুরার স্থান ছিল ১৪ নম্বরে৷
সব দেশেই শিক্ষার ধরণ আলাদা
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে, বিশেষকরে আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে৷
ছবি: Getty Images
সব স্কুল কি এক রকম?
সারা বিশ্বের ছাত্ররা একইভাবে পড়ালেখা শেখে? না, তবে প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে৷ কোনো দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা খোলা আকাশের নীচে মাটিতে পা মুড়ে বসে লেখাপড়া করে, কোথাও আবার স্কুল বেঞ্চে বসে৷ আবার কোনো কোনো দেশের ছাত্রদের রয়েছে নিজস্ব ল্যাপটপ৷
ছবি: AP
ডিজিটাল স্কুলের বই
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমে চলে৷ প্রতিটি ক্লাস রুমেই রয়েছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট৷ সরকারের ইচ্ছে সব স্কুল বই পুরোপুরিই ই-বুকে রূপান্তরিত করার৷ ডিজিটাল সিস্টেমে লেখাপড়া করতে কোনো ছেলে-মেয়ের যেন অসুবিধা না হয় এবং ডিজিটাল বইয়ের অভাবে যেন কারো লেখাপড়া বন্ধ না হয়, সেজন্য সরকার বিনা মূল্যে তাদের ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার দিয়ে থাকে৷
ছবি: AP
গ্রামের স্কুলে যাওয়ার অসুবিধা
অন্যভাবেও পড়াশোনা চলতে পারে৷ কোনোরকমে ঝুলানো একটি ব্ল্যাকবোর্ড এবং কয়েকটি কাঠের বেঞ্চই আফ্রিকার ঘানার এই স্কুলটির জন্য যথেষ্ট৷ এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখা পড়া করা যায়, যদিও কাগজে কলমে রয়েছে ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখপড়া বাধ্যতামূলক৷ পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় গ্রামের ছাত্রদের অনেকেরই লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
টাচপ্যাডের মাধ্যমে লেখা শেখা
তবে জার্মানির এই স্কুলটি ব্যতিক্রম৷ কাগজ, পেন্সিল ছাড়া ছাত্ররা পুরোপুরি স্মার্টবোর্ড এবং নেটবুকের মাধ্যমে লেখা শেখে৷ ডিজিটাল নেটওয়ার্কিং-এর ছাত্রদের যোগাযোগের কাজে সাহায্য করে এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়৷ জার্মানিতে এখনো দুই মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখতে পড়তে পারেন না, যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে জার্মানির সবাই লেখাপড়া জানেন৷
ছবি: AP
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই সুবিধা
শিল্পোন্নত দেশ মানেই সে দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যদেশের চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকা৷ এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও সেভাবেই তৈরি করা হয়, যেমন অ্যামেরিকার এই স্কুলটিতে৷ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলার শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ৭০ শতাংশ বাচ্চাই প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার আগে অনেককিছু শিখে ফেলে৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১০ জনের মধ্যে হয়ত তিনজন কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সুযোগ পায়৷
ছবি: AP
যেখানে শিক্ষা অর্থের জন্য বাঁধাগ্রস্থ
কেনিয়াতে সব ছাত্রই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারে৷ তারপরও অনেকে তার আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়৷ স্কুল ড্রেস, বই, খাতা, জুতো ইত্যাদি জোগাড় করা অনেক বাবা মায়ের জন্য কষ্টকর হয় দাঁড়ায়৷ সেখানে ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং পড়াশোনার মানও নিম্ন৷ যাঁদের সামর্থ রয়েছে সে রকম অনেক বাবা-মা তাঁদের বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠান৷
ছবি: DW/J.Bruck
স্কুল ড্রেস পরে লেখাপড়া
ইংল্যান্ডে স্কুল ড্রেস ছাড়া কেউ স্কুলে যায় না৷ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ কারণ স্কুল ড্রেস যার যার স্কুলের পরিচয় বহন করে এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী করে৷ দরিদ্র পরিবাররের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ড্রেসের জন্য স্কুল থেকে টাকা পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
খোলা আকাশের নীচে ক্লাসরুম
একটি পাবলিক পার্কে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের একটি স্কুলে৷ গরিব বাবা-মায়েরা পয়সার অভাবে এমন স্কুলেই তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন৷ পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, কারণ সরকার শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতে বেশি খরচ করে৷ যা ছাত্ররাও বুঝতে পারছে৷
ছবি: AP
কমপক্ষে মৌলিক শিক্ষা থাকতে হবে
আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও নানা সমস্যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ বিশেষকরে মেয়েদের ক্ষেত্রে একথাটি বেশি প্রযোজ্য৷ প্রতি দশজনের একজন লিখতে পড়তে পারে সেখানে৷ তবে এ হার পুরুষদের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ জন৷ তাছাড়া স্কুলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট স্কুলও নেই, অভাব রয়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার সরঞ্জামেরও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত
আফগানিস্তানের মতো প্রায় একই অবস্থা দক্ষিণ সুদানেও৷ এদেশেও মেয়েদের প্রতি পাঁচজনের একজন লিখতে ও পড়তে পারে৷ সেজন্যই বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো সুদানের মেয়েদের শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে৷ বহু বছরের গৃহযুদ্ধ সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷ অনেক স্কুলেই বই-খাতা এবং টেবিল-বেঞ্চও ঠিকমতো নেই৷
ছবি: dapd
কো-এডুকেশন পছন্দ নয়
কো-এডুকেশন? না, ইরানে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ ছেলে এবং মেয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করে ইরানে৷ এমন কি এই ইহুদি স্কুলেও ইসলামিক স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ এখানে মেয়েরা যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাইকেই চুল ঢেকে রাখতে হবে, অর্থাৎ হিজাব পরতে হবে৷
ছবি: AP
ধনী-গরিবের পার্থক্য
ব্রাজিলের গ্রামাঞ্চলের ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া করা বেশ কঠিন৷ কারণ সেখানকার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই৷ যেমন মন্টে আলেগ্রের এই স্কুলটির মতো ৷ যদিও ব্রাজিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটি, তারপরও এদেশে গরিব এবং ধনীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা একই রকম
বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল এবং রাজধানী ঢাকা শহরের স্কুলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ বড় শহরগুলোতে ছাত্ররা কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে৷ আর গ্রামের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটার ব্যবহার করার ইচ্ছা – এখনো স্বপ্ন!
ছবি: Getty Images
13 ছবি1 | 13
এক দশক পর, সারা ভারতেই সাক্ষরতার হার বাড়ল প্রায় ৯ শতাংশ৷ ২০১১ সালের সাক্ষরতা জরিপে দেখা গেল, তখনও কেরল ৯৩.৯১ শতাংশ সাক্ষরতার হার নিয়ে এক নম্বরেই রয়েছে৷ কিন্তু ৮৭.৭৫ শতাংশ সাক্ষরতা নিয়ে ত্রিপুরা তিন নম্বরে উঠে এসেছে৷ তার পর থেকেই ১০০ শতাংশ সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে একেবারে উঠেপড়ে লেগেছিল ত্রিপুরা৷ রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের নেতৃত্বে তৈরি করা হল স্টেট লিটারেসি মিশন অথরিটি৷ সঙ্গে নেওয়া হল গ্রাম পঞ্চায়েত, পাড়ার ক্লাব এবং এনজিও-দের৷ রাজ্য জুড়ে তৈরি হল আট হাজারেরও বেশি প্রাথমিক সাক্ষরতা কেন্দ্র৷
২০১৩ সালের যে সাক্ষরতা সমীক্ষা করেছে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, তাতে দেখা যাচ্ছে ৯৪.৬৫ শতাংশ সাক্ষরতার হার নিয়ে প্রথম স্থানে চলে এসেছে ত্রিপুরা৷ ৯৩,৯১ শতাংশ সাক্ষরতা নিয়ে দ্বিতীয় কেরল এবং ৯১.৫৮ শতাংশ সাক্ষরতার হার তৃতীয় স্থানে রেখেছে উত্তর-পূর্ব ভারতেরই আর এক রাজ্য মিজোরামকে৷
এখানে আরও একটা বিষয় লক্ষণীয়৷ উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্য, চিরকাল যারা বাকি ভারতের কাছে অবহেলিত বলে তাদের এক ধরনের অভিমান এবং ক্ষোভ রয়েছে, তারা প্রায় প্রত্যেকে কিন্তু সাক্ষরতায় দেশের বাকি অংশ থেকে এগিয়ে৷ ত্রিপুরা এবং মিজোরাম ছাড়াও সাক্ষরতা তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে রয়েছে নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মণিপুর, অসম এবং অরুণাচল প্রদেশ৷ অবশ্য ২০১৩ সালের তালিকায় তিন নম্বরে উঠে এসেছে লাক্ষাদ্বীপ৷
তবে শতাংশের হিসেবে সাক্ষরতার হার নির্ণয়ের এই পদ্ধতি যে কিছুটা বিভ্রান্তিকর, সেটা বলাই বাহুল্য৷ লাক্ষাদ্বীপে মোট জনসংখ্যাই এত কম যে শতাংশের হিসেবে অন্য রাজ্যের তুলনায় সাক্ষরতার হার অনেক বেশি দেখাতে পারে৷ কিন্তু সেটা সমস্ত পরিসংখ্যানেরই সমস্যা৷ ত্রিপুরার ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য৷ ঐতিহাসিকভাবে ত্রিপুরা শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে অনেক এগিয়ে থাকা রাজ্য হয়েও তার ভৌগোলিক অবস্থান তাকে কার্যত দলছুট করে রেখেছে৷ বাংলা ভাষার চর্চা ত্রিপুরায় যত ব্যাপক এবং গভীর, ততটা হয়ত পশ্চিমবঙ্গেও আর নয়, কিন্তু তাও পূর্ব ভারতে ভাষা-শিল্প-সংস্কৃতির কথা হয় কলকাতার মুখের দিকে তাকিয়ে৷
একশো শতাংশ সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্যে ত্রিপুরার এই প্রয়াস এবং সাফল্য নিঃসন্দেহে উদযাপন করার মতো ঘটনাছবি: Fotolia/silver-john
সেই পরিস্থিতিতে প্রায় একশো শতাংশ সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্যে ত্রিপুরার এই প্রয়াস এবং এই সাফল্য নিঃসন্দেহে উদযাপন করার মতো ঘটনা৷ এবং বাংলা ভাষা, ভারতে অন্যান্য ভাষার দাপটে যা বস্তুত কোণঠাসা হয়ে আছে, সেই ভাষার চর্চা হয়, এমন একটা রাজ্য সাক্ষরতায় এক নম্বর হল, এটা বাঙালিদের পক্ষেই অত্যন্ত সুখবর৷ যে আনন্দটা পাওয়া যায় বাংলাদেশে সব পর্যায়ে বাংলাভাষার ইজ্জত এবং কদরে৷ কারণ পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষরতার নিরিখে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে, যদিও সেটা পুরো দেশের সাক্ষরতার হারের সমান৷ কিন্তু সেটা আদৌ কোনও সান্ত্বনা পাওয়ার মতো বিষয় নয়৷ তা ছাড়া এই রাজ্যে এখন এত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুযের বাস যে পশ্চিমবঙ্গকে আর বাঙালি রাজ্য বলা বোধহয় ঠিক নয়৷ সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মশাল এখন ত্রিপুরারই হাতে৷
ত্রিপুরার জন্যে বিষয়টা আরও আনন্দের কারণ রাজ্যের যে জেলায় সবথেকে বেশি মানুষ স্বাক্ষর হয়েছেন বলে স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের গণনায় জানা গিয়েছে, সেটা উপজাতি অধ্যুষিত ধলাই৷ সেখানে ৯৭ শতাংশ মানুষ এখন সাক্ষর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের এখন একটাই আফসোস৷ তাঁর রাজ্যে নিরক্ষর লোকের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৬৩৪ জন৷ এঁদের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে সাক্ষরতা কর্মসূচিতে আনা সম্ভব হয়নি৷ না হলে ত্রিপুরা হতো দেশের একমাত্র সম্পূর্ণ স্বাক্ষর রাজ্য৷