উত্তর সাগরে জার্মান দ্বীপপুঞ্জ হেলিগোল্যান্ডের গবেষকরা আন্তর্জাতিক৷ তাদের চিন্তা সাগরের অম্লতা বৃদ্ধি নিয়ে৷ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া বিষয়টির তল পাওয়া সম্ভব নয়, সমাধান তো দূরের কথা৷
বিজ্ঞাপন
পানির তাপমাত্রা বাড়াই একমাত্র সমস্যা নয়৷ ওশেনোগ্রাফার কারেন উইল্টশায়ার জানান, ‘‘বর্তমানে একটা বড় উদ্বেগ হলো সাগরের অম্লতা বৃদ্ধি, যে জন্য আমাদের একটি প্রকল্প হলো, উপকূল এলাকায় অম্লতার পরিমাপ করা৷ জার্মানির উপকূলবর্তী সাগরের পানির অম্লতা বাড়বে কিনা, তা আদৌ স্পষ্ট নয় এবং সে-বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্যও নেই৷''
মহাসমুদ্রের পানির অম্লতা যে বাড়ে, তা দেখা গেছে৷ তার ফলশ্রুতিস্বরূপ বিশেষ করে সাগরের প্রাণীরা বিড়ম্বনায় পড়ে৷ কিন্তু বিশ্বের সাগরাঞ্চল সুরক্ষিত করার জন্য শুধু তথ্য সংগ্রহ করলেই চলবে না, সেই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সক্রিয় হতে হবে৷
পার্টনারশিপ ফর অবজারভেশন অফ দ্য গ্লোবাল ওশেন্স বা ‘পোগো'-র সভাপতি কারেন উইল্টশায়ার বলেন, ‘‘আমরা বিজ্ঞানীরা সবসময়ে একমত নই – অপরদিকে রাজনীতিক কিংবা যাদের স্বার্থ বিষয়টির সঙ্গে জড়িত, তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো দক্ষতার অধিকারীও আমরা নই৷ অথচ আমরা দেখছি, স্বার্থ আর প্রয়োজন যেখানে, বিজ্ঞানকে সেখানে পৌঁছে দেওয়া ক্রমেই আমাদের একটা দায়িত্ব বা কর্তব্য হয়ে উঠছে৷''
সাগরের মায়াপুরী
ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞদের মতে সমুদ্রের পাঁচটি স্থানকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত৷ অবশ্য সাগরের অতলে এই স্থানগুলিতে দর্শক সমাগম হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই!
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Courtesy Chris Burville
সাগরের গভীরে, জলের তলায় এক আশ্চর্য জগৎ
সাগরের পানির নীচে পাঁচটি স্থানকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেবার সুপারিশ করেছেন ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞরা৷ এই সব স্থানের বাসিন্দাদের সৌন্দর্য অকল্পনীয়; সেই সঙ্গে রয়েছে অপরিসীম জীববৈচিত্র্য; এছাড়া পরিবেশ বিপন্ন হলে, তার চিহ্নও ধরা পড়ে এখানে৷
ছবি: Kevin Raskoff/NOAA/Wikipedia
‘‘হারানো শহর’’
অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে ৮০০ মিটার জলের তলায় ভূপৃষ্টের ফাটল থেকে আগুন, গরম লাভা ও গ্যাস বেরিয়ে আসছে৷ ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের অন্য কোথাও এ ধরনের একটি আশ্চর্য পরিবেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট নামে পরিচিত প্রাকৃতিক চিমনিগুলি থেকে সম্ভবত ১ লক্ষ ২০ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে গ্যাস নির্গত হচ্ছে৷ সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় চিমনিটির নাম রাখা হয়েছে পোসাইডন৷ উচ্চতা ৬০ মিটারের বেশি৷
ছবি: Woods Hole Oceanographic Institute and Charles Fisher, Pennsylvania State University
কোস্টা রিকার থার্মাল ডোম
প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ৫০০ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘের এই এলাকাটিকে ‘‘সাগরের মরুদ্যান’’ আখ্যা দিয়েছেন ইউনেস্কোর বিজ্ঞানীরা৷ এখানে যেমন টুনা মাছ কিংবা শুশুক, তেমনই হাঙর বা তিমি মাছ পাওয়া যায়৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে এলাকার সবচেয়ে বড় বাসিন্দা নীল তিমিকে৷ বিশেষভাবে বিপন্ন সামুদ্রিক কচ্ছপ লেদারব্যাক টার্টলরাও এখান দিয়ে যায়৷
ছবি: picture alliance/WILDLIFE
হোয়াইট শার্ক কাফে
সাদা হাঙরের কফিহাউস? হ্যাঁ, মেরিন বায়োলজিস্টরা সত্যিই এই নাম দিয়েছেন৷ জায়গাটা কিন্তু খোলা সমুদ্রে, উত্তর অ্যামেরিকা আর হাওয়াই দ্বীপের মাঝামাঝি৷ হোয়াইট শার্ক নামধারী হাঙরদের ভিড় লেগে থাকে এখানে, হয়তো জলের বিভিন্ন স্রোত তাদের ভালো লাগে বলে৷
ছবি: Pterantula (Terry Goss) via Wikimedia Commons
সারগাসো সি
স্বয়ং কলম্বাস নাকি ১৮৯২ সালে তাঁর প্রথম সমুদ্রযাত্রার সময় এই দৃশ্য দেখেছিলেন৷ বার্মুডার দ্বীপগুলোকে ঘিরে রয়েছে এই সারগাসো সাগর৷ সারগাসো নামটি এসেছে সার্গাসুম নামধারী ভাসন্ত সামুদ্রিক শ্যাওলা থেকে৷ সার্গাসুম-কে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘ভাসন্ত সোনালি ক্রান্তীয় অরণ্য’৷ এই ‘অরণ্যে’ বহু জীব ও প্রাণীর বাস৷ ইউরোপীয় ও অ্যামেরিকান বানমাছেরা শুধু এখানেই ডিম পাড়ে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Courtesy Chris Burville
অ্যাটলান্টিসের পাড়
ভারত মহাসাগরের এই জলমজ্জিত দ্বীপটি নাকি লক্ষ লক্ষ বছর আগে সাগরে ডুবে গিয়েছিল – এই কি তাহলে কিংবদন্তীর অ্যাটলান্টিস মহাদেশ? সাগরের ৭০০ থেকে ৪,০০০ মিটার নীচে চড়াই-উৎরাই, সৈকৎ কিংবা উপহ্রদ, সবই পাওয়া যায় – সেই সঙ্গে বড় বড় অ্যানেমনি, সুবিশাল স্পঞ্জ ও প্রবাল৷
ছবি: The Natural Environment Research Council and IUCN/GEF Seamounts Project C/O Alex D Rogers
সারা পৃথিবীর, গোটা মানবজাতির সম্পদ
পাঁচটি স্থানই সাগরের জলভূমির আন্তর্জাতিক অংশে, কোনো বিশেষ দেশের তাঁবে নয়৷ তার খারাপ দিকটা হল এই যে, এই ধরনের এলাকা সুরক্ষিত বা সংরক্ষিত করা কঠিন৷ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আখ্যা দেওয়াটা তার একটা পন্থা হতে পারে৷
7 ছবি1 | 7
সারা বিশ্ব থেকে তরুণ বিজ্ঞানীরা হেলিগোল্যান্ডে আসেন বছর খানেকের জন্য৷ উদ্দেশ্য: পঠন-পাঠন ও গবেষণা৷ যেমন জাপানের হিরোশি ইনু, যিনি গলদা চিংড়ি নিয়ে গবেষণা করছেন৷ গলদা চিংড়ি উত্তর সাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী, কিন্তু আজ বিপন্ন৷ সেই জন্যে হিরোশি গবেষণা করছেন, গলদা চিংড়িদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের কি প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে৷ বিশ্বের ওশেনোগ্রাফারদের আরো ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করা উচিত কেন, সে বিষয়ে পোগো ফেলো সেন্টার অফ এক্সেলেন্স ইন অবজারভেশনাল ওশেনোগ্রাফির হিরোশি ইনু বললেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনে কোনো দেশের পক্ষে একা কিছু করা সম্ভব নয়৷ সারা বিশ্বকে সহযোগিতা করতে হবে৷ কোনো দেশ একা এর সমাধান করতে পারবে না৷''
দুনিয়ার সাগরগুলিতে অতিমাত্রায় মাছ ধরার ফলে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হতে চলেছে৷ এর বিরুদ্ধে কিছু করতে হবে, বলেন কারেন উইল্টশায়ার, ‘‘আমার কাছে সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়, যখন আমরা হেলিগোল্যান্ডে আমাদের অ্যাকোয়ারিয়ামের চৌবাচ্চাগুলো থেকে মাছগুলোকে বার করে নিই আর শুধু জলটা পড়ে থাকে৷ আমি যেন একটা শক পাই৷ আমি ১৪ বছর ধরে দেখছি চৌবাচ্চায় ওরা সবাই ভাসছে, সাঁতার কাটছে, খাচ্ছে, কামড়াকামড়ি করছে – হঠাৎ যেন কেউ সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিয়েছে – সব কিছু ফাঁকা, সব কিছু খালি৷ এই কথাটা মনে রাখতে হবে, এর আসল অর্থ কী? আমরা ঠিক কী নিভিয়ে দিচ্ছি৷''
সাগর ভবিষ্যতেও থাকবে৷ প্রশ্ন হলো: সেই সাগরের পানিতে কোন কোন প্রাণী থাকবে? আর সেই প্রাণিসম্পদ থেকে উপকূলের মানুষ জীবনধারণ করতে পারবে কিনা৷
মাবেল গুন্ডলাখ/এসি
দেবারতি গুহ
সাগরে শিক্ষা ট্যুর
এটা একটি বিশেষ ধরনের বিদেশ ভ্রমণ৷ সারা জার্মানি থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা অ্যাটলান্টিকের বুকে কাটায় দীর্ঘ ছয় মাস৷ সেখানে তারা বিদেশি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে৷ জাহাজেই চলে এই ক্লাস৷ এমনকি জাহাজটিও চালায় তারা নিজেরাই৷
ছবি: KUS-Projekt
‘টোর হায়ারডাল’
গত প্রায় ২৫ বছর যবত তিন-তিনটি মাস্তুল বিশিষ্ট ‘টোর হায়ারডাল’ নামের এই জাহাজ যুব শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের সাগরের ওপর দিয়ে নিয়ে গেছে বিশ্বের নানা দেশে৷ ২০০৮ সাল থেকে এই জাহাজটি অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ‘সাগরে ক্লাসরুম’ নামের এই প্রজেক্টটির জন্য ‘রিজার্ভ’ করা থাকে৷
ছবি: KUS-Projekt
দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য প্যাকিং
মোট ১৯০ দিন সাগরে বসবাস, কাজেই সবকিছু সাথে নিতে হয়৷ বলা বাহুল্য তার মধ্যে খাবার-দাবার অন্যতম৷ ভ্রমণের চারদিন আগে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের নতুন ‘বাড়ি’, মানে এই জাহাজে সব জিনিস-পত্র তোলার ব্যাপারে একে-অন্যকে সাহায্য করে থাকে৷
ছবি: KUS-Projekt
আনন্দদায়ক এক জাহাজ
জার্মানির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মোট ৩৪ জন ছাত্র-ছাত্রী ইটালির বিশিষ্ট নাবিক ক্রিস্টোফার কলোম্বাস এবং বিশ্বখ্যাত আবিষ্কারক আলেক্সান্ডার ফন হুমবোল্ড-এর পথ অনুসরণ করছে৷ ছবিতে দেখুন, কেমন করে তারা জার্মানির কিল শহর থেকে বিভিন্ন চ্যানেলের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ছে নতুন জগতে৷
ছবি: KUS-Projekt
প্রথম দিন
সুন্দর আবহাওয়া, সাগরের জল শান্ত – ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি এমন একটি দিনে শিক্ষার্থীরা সমুদ্র পথে যাত্রা শুরু করে৷ তারা উত্তর সাগরের একটি চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে থেকে ইংলিশ চ্যানেল এবং স্পেনের বিস্কায়া হয়ে টেনেরিফা পর্যন্ত পাড়ি দেয়৷
ছবি: KUS-Projekt
পাহাড়ের ছায়ায় ক্লাস
টেনেরিফার সেন্ট ক্রুজে জাহাজটি প্রথম এসে নাঙর ফেলে৷ সেখানে অতিথি বা ‘হোস্ট’ পরিবারে রাত কাটানোর পর শিক্ষার্থীরা স্পেনের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় ‘পিকো ডেল টেইডে’-র চূড়ায় ওঠতে থাকে৷ পথেই ওদের জীববিদ্যার ক্লাস হয়৷
ছবি: KUS-Projekt
সাগরের অনুভূতি
অ্যাটলান্টিক মহাসাগর বা অতলান্ত সাহর পার হওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের নিজেদের অনেকটা নাবিকদের মতোই লাগে৷ জাহাজ ক্রু’র নির্দেশনায় জাহাজের সমস্ত কাজ ছাত্র-ছাত্রীরাই করে৷ এমন কি রান্না এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজও৷
ছবি: KUS-Projekt
যথেষ্ট হয়েছে রোদ আর পামগাছ দেখা
ক্যারিবিকে পৌঁছানোর পর আনন্দ যেন আর ধরে না তাদের! দীর্ঘ ২৪ দিন সাগরে কাটানোর পর এই সবুজ দ্বীপে নাঙর ফেলে এবং এত সুন্দর একটা সমুদ্রসৈকত দেখে শিক্ষার্থীদের মন ভরে যায়৷ এমনটাই তো আশা করেছিল তারা! স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলে আলহামরা-খ্যাত গ্রানাডা শহরেও হোস্ট পরিবার বাড়িতে ওরা রাত কাটায়৷
ছবি: KUS-Projekt
ইন্ডিয়ানাদের সাথে বাস
শিক্ষার্থীরা পানামাতে কয়েকদিন হোস্ট পরিবারে থাকা এবং কফি বাগানে কাজ করার সুবাদে কুনা-ইন্ডিয়ানাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানা ও দেখার সুযোগ পেয়ে যায়৷
ছবি: KUS-Projekt
সাইকেলে কিউবা ঘুরে বেড়ানো
সাইকেল চালিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই কিউবার বিখ্যাত তামাক উৎপাদনকারী এলাকায় চলে যায়৷ সেখানে তারা কিউবার শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা করে, গল্প করে, আর আড্ডা মারতে মারতে ঘুরে দেখে রাজধানী হাভানা৷
ছবি: KUS-Projekt
দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ঘরে ফেরা
সব শেষে বারমুডা এবং আৎসোরেন দ্বীপে ছোট্ট একটা বিরতির পর শিক্ষার্থীরা ফিরে আসে নিজ দেশে৷ সাগরে দীর্ঘদিনের এই শিক্ষা ভ্রমণ ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ায় তো কাজে লাগবেই, একজন সম্পূর্ণ মানুষ হতেও হয়ত সাহায্য করবে অনেকটাই৷