জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন, তা ধীরে ধীরে ভীতিজনক হয়ে উঠছে৷বিজ্ঞানীদের চোখ এখন সুমেরু-কুমেরুর বরফের আস্তরণের দিকে, যা পুরোপুরি গললে সাগরের জল বাড়তে পারে দু'শো ফুট!
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Kahnert
বিজ্ঞাপন
‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ' বা আইপিসিসি তিন বছর আগেই অনুমান করার চেষ্টা করেছিল, বিশ্বের উষ্ণায়নের ফলে সাগরের পানি কতটা বাড়তে পারে৷ শুধু একটি ভুল হয়ে গিয়েছিল: গ্রিনল্যান্ড আর অ্যান্টার্কটিকা অর্থাৎ কুমেরুর বরফের আস্তরণ গললে কি ঘটবে, সেটা তারা হিসেবের মধ্যে ধরেননি৷ ওদিকে এই দুটি অঞ্চলে বিশ্বের মিষ্টি পানির দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ধরা রয়েছে৷ গ্রিনল্যান্ডের বরফের আস্তরণ গললে সাগরের পানি বাড়বে ছ'মিটার বা ২০ ফুট৷ কুমেরুর বরফ গললে সাগরের জল বাড়বে ৬০ মিটার বা ২০০ ফুট৷
বিপদ তো শুধু একদিক থেকেই নয়৷ বরফ গলে জল বাড়া এক কথা; আবার সাগরের জলের তাপমাত্রা বেড়ে সেই জলের সম্প্রসারণ আরেক কথা৷ জার্মানির বন বিশ্বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী রোলেয়ফ রিটব্রুক ডয়চে ভেলে-কে বলেছেন যে, সাগরের পানি বাড়ার ক্ষেত্রে সাগরের জলের তাপমাত্রা বাড়ার প্রভাব এর আগে যা ভাবা গিয়েছিল, তার অন্তত দ্বিগুণ৷ যেমন বর্তমানে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে বছরে প্রায় ২ দশমিক সাত মিলিমিটার করে - তার প্রায় অর্ধেকই নাকি জলের তাপমাত্রা বাড়ার ফলে৷ ওদিকে মার্কিন বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, সাগরের পানির তাপমাত্রা বাড়ার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে - প্রাক-শিল্পায়ন আমল থেকে সাগরের পানির তাপমাত্রা যতটা বেড়েছে, তার অর্ধেকই নাকি এসেছে গত দুই দশকে৷ এই অতিরিক্ত তাপ বা উষ্ণতার ৩৫ শতাংশ নাকি জমা হয় সাগরের ৭০০ মিটার নীচের পানিতে - বিশ বছর আগেও সাগরের পানির এই স্তরে জমা হত মাত্র ২০ শতাংশ অতিরিক্ত তাপ৷
জলবায়ু পরিবর্তন যা করেছে, যা করবে
রবিবার থেকে প্যারিসে জাতিসংঘের আয়োজনে শুরু হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন৷ চলুন এর আগে জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জেনে নিই৷
ছবি: gemeinfrei
তবুও আমস্টারডাম ডুবে যাবে!
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা নিয়ে আসন্ন প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনা হবে৷ সেক্ষেত্রে সবাই একমত হলেও সমুদ্রের পানির উচ্চতা এক মিটারের বেশি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ আর সেটা হলে ডুবে যাবে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহর ৷
ছবি: CC BY 2.0 Duncan Hull
কোরাল রিফ
অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে স্নরকেলিং করতে নেমে নিমো-র সঙ্গে সেলফি তুলতে চান? তাহলে এখনই যেতে হবে৷ কারণ তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে প্রবালপ্রাচীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে৷ এখনই পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রবালপ্রাচীর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
স্কি আর নয়?
ওইসিডি-র হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তুষারের স্তর কমে যাওয়ায় আল্পসে স্কি করার জায়গা কমে যাচ্ছে৷ ফলে ইতিমধ্যে স্কি এলাকার অনেক রিসোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে৷ অন্যরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গরমের সময় হিমবাহগুলো ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করে৷
ছবি: picture-alliance/chromorange
ভেনিস সহ আরও যেসব শহর
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব শহর হুমকির মুখে রয়েছে তার মধ্যে ইটালির ভেনিস একটি৷ আরও আছে ঢাকা, মিয়ামি, নিউ ইয়র্ক, ব্যাংকক, হং কং, হো চি মিন সিটি, টোকিও, মুম্বই ইত্যাদি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ
একসময় এই রুট পাড়ি দেয়া ছিল অভিযাত্রীদের স্বপ্ন৷ এটা করতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে৷ তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরফ গলে যাওয়ায় প্রমোদতরী কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে৷
ছবি: DW/I.Quaile
ঘুরে বেড়ানোর এখনই সময়
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রায়ই খরা দেখা দিচ্ছে৷ গত তিন বছর সেখানে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রা ছিল৷ ফলে আপনি যদি ক্যালিফোর্নিয়ার কাঠবাদামের গাছের নীচে কিংবা ব্রাজিলের কফি ও ভিয়েতনামের ধানক্ষেতে ঘুরে বেড়াতে চান তাহলে এখনই করে ফেলা ঠিক হবে৷
ছবি: Reuters/L. Nicholson
গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক
১৯ শতকের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের মনটানা রাজ্যের ‘গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক’ এ প্রায় দেড়শোটির মতো হিমবাহ ছিল৷ কিন্তু ২০১০ সালের হিসেবে সেখানে এখন হিমবাহের সংখ্যা মাত্র ২৪৷ ২০৩০ সাল নাগাদ সংখ্যাটা শূন্যের কোটায় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
ছবি: gemeinfrei
7 ছবি1 | 7
যেভাবেই দেখা যাক, পরিস্থিতি শঙ্কা সৃষ্টি করতে বাধ্য৷ কুমেরুর বরফ সুমেরুর চেয়ে বেশি স্থিতিশীল বলে ধারণা ছিল, কিন্তু বিগত কয়েক দশকে দক্ষিণ মেরুর তুষার - বিশেষ করে পশ্চিমাংশের - গলতে শুরু করেছে এবং ক্রমেই আরো দ্রুতহারে গলছে৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কুমেরু আর গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলা থেকে বিশ বছর আগে সাগরের পানি যতটা বাড়ছিল, আজ তার তিনগুণ বেশি বাড়ছে৷ সর্বশেষ ভবিষ্যদ্বাণী হল, সাগরের পানির তাপমাত্রা যদি আজকের তুলনায় দুই ডিগ্রি বাড়ে, তাহলে দক্ষিণ মেরুর পশ্চিমাংশের সব বরফ গলে যাবে৷ পূর্বাংশের বরফও নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে আর পুরোপুরি মুক্ত নয়৷
তাহলে সমাধান? পুরোপুরি কার্বন নির্গমন বন্ধ করা, যা কিনা সম্ভব নয়৷ তাহলে? শহর ছাড়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে মানুষজনকে, বিশেষ করে উপকূলের শহর৷ কিন্তু কোথায় যাবে তারা? বাস্তুত্যাগ আর অভিবাসনের সেই কাহিনি কি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে যায়নি?
জলবায়ু পরিবর্তনের শক্তিশালী কয়েকটি ছবি
জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বিভিন্নভাবে উপলব্ধি করা যায়৷ একটি সংস্থা প্রবাল প্রাচীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সেটা আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
দুই মাস আগে, পরে
জলবায়ু যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বোঝার অন্যতম উপায় প্রবালের দিকে খেয়াল করা৷ উপরে যে ছবিটি দেখছেন তার বাম পাশেরটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তোলা, আর ডানেরটি দুই মাস পর, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের৷ এবার নীচে কোরালগুলোর দিকে তাকান৷ বামেরগুলো এক রংয়ের আর ডানেরগুলো সাদা হয়ে গেছে৷ হ্যাঁ, এটা জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে৷ ছবিটি অ্যামেরিকান সামোয়া এলাকার৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
সাদা হয়ে যাওয়া
এই ছবিটি হাওয়াই এলাকার৷ এখানেও সাদা হয়ে যাওয়া কোরাল দেখা যাচ্ছে৷ কোরাল তার গায়ে থাকা জলজ উদ্ভিদ, অ্যালজির কারণে বেঁচে থাকে৷ কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে গেলে কোরাল থেকে ঐ উদ্ভিদ ঝরে পড়ে৷ ফলে কোরালেরও আয়ু শেষ হতে থাকে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
একেবারে স্পষ্ট
এতক্ষণ দূর থেকে সাদা অংশ দেখেছেন৷ এখন দেখুন একেবারে কাছ থেকে তোলা ও বর্ধিত করা একটি ছবি৷ এটি কোরালের একটি অংশ৷ দেখুন, গায়ে থাকা জলজ উদ্ভিদ আর না থাকায় কীরকম সাদা হয়ে গেছে কোরালটি৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
চারদিক কেমন যেন খাঁ-খাঁ করছে
মন খারাপ করা একটি ছবি৷ অ্যালজি না থাকায় মরে গেছে কোরাল৷ পড়ে আছে শুধু কঙ্কাল৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
কয়েক দশক সময় প্রয়োজন
এবার আরেকটি ছবি৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি থেকে কোরাল রিফের বেঁচে উঠতে (আদৌ যদি বেঁচে ওঠে) কয়েক দশক সময় লাগতে পারে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
প্রমাণ সংগ্রহ
বিশ্বের কোরাল রিফগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণে ২০১২ সালে ক্যাটলিন গ্রুপের সহায়তায় ‘এক্সএল ক্যাটলিন সিভিউ সার্ভে’ নামে একটি সমীক্ষা শুরু হয়৷ এর মাধ্যমে উচ্চপ্রযুক্তির ক্যামেরা ও রোবট ব্যবহার করে কোরালের বর্তমান অবস্থা তুলে আনা হচ্ছে৷ অনেক ছবি গুগল স্ট্রিট ভিউ-তে আপলোড করা হয়েছে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে তাপমাত্রা বাড়ছে তার প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি অংশ শুষে নেয় সাগর৷ ফলে জলবায়ু যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বোঝার একটি ভালো উপায় হচ্ছে কোরাল৷ সমুদ্রের প্রায় ২৫ শতাংশ প্রজাতির বেঁচে থাকার পেছনে রয়েছে কোরাল রিফ৷ তাই কোরাল না থাকে মানে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়া৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
প্রাণিকুলের খাবার
দেখছেন অ্যামেরিকান সামোয়ার ‘এয়ারপোর্ট রিফ’৷ স্বাস্থ্যবান এ সব কোরালের মধ্যে যে গাছপালা থাকে সেখান থেকেই খাবার সংগ্রহ করে পানির নীচে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
খাবার পাবে কোথায়?
লম্বা নাকের সুন্দর এই মাছটি কোরাল থেকে খাবার সংগ্রহ করে থাকে৷ কিন্তু কোরালই যদি না থাকে তাহলে তার কী হবে?