সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তিন বছর পেরিয়ে গেছে৷ অথচ এখনো জানা যায়নি খুনের কারণ৷ খুনিই বা কারা? বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত এই সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের তিন বছরে ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন অনেকেই৷
বিজ্ঞাপন
সাগর-রুনির পরিবারের সদস্যরা বিচারের আশায় পার করে দিয়েছেন তিন বছর৷ এখনও তাদের প্রতিক্ষার শেষ নেই৷ ফেসবুক স্ট্যাটাসে এই বিষয়টি তুলে এনেছেন রুনির ছোট ভাই নওশের রোমান৷ ফেসবুকে মঙ্গলবার তিনি লিখেছেন, ‘‘ক্লান্ত, হতাশ, ক্ষুব্ধ,বিচারের আশায় থাকতে থাকতে৷ তিন বছর, ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৩৬ মাস পার হলো৷ এই বিচার দেওয়ার কেউ নাই তাই বিচার পাওয়ার আশাও ছেড়ে দিয়েছি৷ আল্লাহ-র কাছে বিচার চাওয়া ছাড়া রাষ্ট্রের কাছে বিচার প্রত্যাশা করা করা নিজেদের উপহাস করা ছাড়া আর কিছুই না৷''
তিনি লিখেছেন, ‘‘কিন্তু যে শিশুটি বিদেশের সুন্দর জীবন ছেড়ে বাংলাদেশে এসে নিজের চোখের সামনে বাবা-মাকে খুন হতে দেখে, এবং পরবর্তীতে সারা জীবনের জন্য শুধু বাবা-মার আদরবঞ্চিত করাই নয়, রাষ্ট্র বিচারের নামে উপহাস করে তখন এই শিশুটির এই দেশের প্রতি কী ধারণা হতে পারে??? এই দেশের মানুষই বা কী জবাব দিবে তাকে?? শুধু এক মেঘ না, উপহাস আর জবাবদিহিতার অভাবে প্রতিদিন মেঘের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷''
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
ব্লগার আরিল ক্লকারহেগ ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন একটি ব্যানার৷ সামহয়্যার ইন ব্লগের প্রথম পাতায় থাকা ব্যানারটিতে সময় গণনা চলছে৷ সেই ব্যানারে প্রকাশিত হিসেব অনুযায়ী, পেরিয়ে গেছে ১০৯৭ দিন৷ ফেসবুকে আরিল লিখেছেন, ‘‘তিন বছর পরও সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড এক রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে৷ সাহারা খাতুন বলেছিলেন, খুনিরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ধরা পড়বে৷ আজ ১০৯৭ দিন!''
তিনি লিখেছেন, ‘‘সাগর-রুনি অনেক কিছু জেনে ফেলেছিলেন যা জানার অধিকার আমাদের নেই৷ তবে ব্লগাররা ভুলে যায় না৷ ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে প্রতিদিন আমরা তোমাদের মনে করছি৷''
স্ট্যাটাসের বাকি অংশ আরিল লিখেছেন বাংলায়, ‘‘আমরা ব্লগার, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দ্রুত শেষ করার জোর দাবি জানাচ্ছি...৷''
ফেসবুকে গত ২৪ ঘণ্টায় প্রকাশিত অনেক মতামতেই জায়গা পেয়েছে খুনিদের বিচার না হওয়ার বিষয়টি৷ নিউজ এনআরবি-র প্রধান সম্পাদক মাঈনুল ইসলাম নাসিম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘অনলাইন জুড়ে ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন – কী ছিল সাগরের ল্যাপটপে? তিন বছরেও নাকি কোনো কুলকিনারা করতে পারলো না গোয়েন্দারা৷ পারবে কী করে – যদি বেড়ায় খায় ঘাস, সর্ষে থাকে ভূত৷''
এছাড়া সাংবাদিক সুপ্রীতি ধর তুলে এনেছেন আন্দোলনে সাংবাদিক নেতাদের ব্যর্থতার কথা৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘সাগর-রুনি হত্যার পর যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, কিছু সাংবাদিক নেতা তা গিলে ফেলেছেন৷ এর পরিবর্তে তাদের জীবনযাপন পাল্টে গেছে৷ তারা বড় বড় পজিশনে চলে গেছে পুরস্কার হিসেবে৷ অসুবিধা নেই৷ একদিন সেই ক্ষমতাও তাদের খাবে, কর্মফলই বলে দেবে কি হবে তাদের! আমি তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি৷''