সাগর সরওয়ার-মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের এক বছর হয়ে গেল৷ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হলো স্বাভাবিক বেদনা আর অস্বাভাবিক হতাশা নিয়ে৷ সেই হতাশা থেকেই হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷
বিজ্ঞাপন
ঢাকায় নিজেদের ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার আর মেহেরুন রুনি নির্মমভাবে খুন হয়েছিলেন ২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি৷ হাত-পা বাঁধা ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায় মৃত্যুর আগের দিনও মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে নিউজ এডিটরের দায়িত্ব পালন করে আসা সাগর সরওয়ারের৷ এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনির নিথর দেহও ছিল ক্ষতবিক্ষত, রক্তে রঞ্জিত৷ তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে৷ তারপর ৪৮ ঘণ্টা অর্থাৎ দু দিন নয়, পেরিয়ে গেছে একটি বছর৷ কিন্তু সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জট খোলেনি, তদন্ত ঠিক পথে এগিয়েছে, প্রকৃত অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে – এই স্বস্তিটুকু এতদিনেও পায়নি সাংবাদিক দম্পতির পরিবার৷
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
এ অবস্থাতেই খুব আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷ সাংবাদিকদের এই আন্তর্জাতিক সংগঠন এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘ ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (ব়্যাব) এর দায়িত্বে দেয়া এ মামলার তদন্ত এখন থেমে আছে৷ ব়্যাবের দাবি, মামলা তদন্তে তাঁরা আন্তরিক৷ কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে নজির তাঁরা রেখেছে, সে কথা ভেবে হলেও এ মামলা তদন্তের ভার অন্য কাউকে দেয়া উচিত৷''
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড তদন্ত করার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাকে দেয়ার দাবি জানিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷ প্যারিস ভিত্তিক এ সংস্থা মনে করে বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত যেহেতু এফবিআই বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে দিয়ে করানোর দাবি করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সুতরাং সাগর-রুনির ব্যাপারে একই কথা ভাবা যেতেই পারে৷ বিবৃতিতে সাগর-রুনির ছয় বছরের সন্তান মেঘকে জেরা করায় ব়্যাবের সমালোচনা করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷
তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ সর্বস্তরেই রয়েছে৷ সোমবার বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও এক স্মরণসভার আয়োজন করে জানিয়েছেন সে কথা৷ আগামী ১১ই মার্চ সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা৷ এদিকে নিহত সাংবাদিক দম্পতির পরিবার জানিয়েছে, এ মামলায় এ পর্যন্ত যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাতে শুধু মূল ঘটনাকে আড়াল করার প্রয়াস রয়েছে বলেই তাঁদের বিশ্বাস৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় নেয়ার দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা৷ এ দাবি অবশ্য গত এক বছরে বহুবারই উঠেছে, কিন্তু এখনো কোনো কাজের কাজ হয়নি৷