পাঁচ বছরেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলা তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি৷ তদন্তকারীরা এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন দাখিলেন জন্য আদালত থেকে ৪৬ বার সময় নিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি৷ হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল তাদের একমাত্র শিশু সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ৷ ঘটনার পরপরই তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেন৷ কিন্তু ৪৮ ঘণ্টাতো দূরের কথা পাঁচ বছরেও এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নাই৷ কাউকে চিহ্নিত বা গ্রেপ্তারও করতে পারেনি পুলিশ৷ ঘটনার পর সন্দেহভাজন হিসেবে বাসার দারোয়ানসহ কয়েকজনকে তখন আটক করা হয়েছিল৷ সেই পর্যন্তই শেষ৷ আর মামলাটি আদালতের নির্দেশে এখন র্যাব তদন্ত করছে৷
Badsa - MP3-Stereo
গত ৮ ফেব্রয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে এই মামলার তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল র্যাব-এর৷ কিন্তু তারা প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়েছে৷ তাই আগামী ২১ মার্চ আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে আদালতে তলব এবং তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে৷ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে র্যাব এপর্যন্ত ৪৬ বার সময় নিল৷
বাংলাদেশ ফেডালের সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব মো. ওমর ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা হতাশ হলেও আশা ছাড়িনি এখনো৷ এমনও দেখা যায় কোনো কোনো মামলায় ৪০ বছর পরও অপরাধী চিহ্নিত হয়৷ সেই হিসেবে আমরা আন্দোলন করে যাব৷ কেউ যদি মনে করে থাকে কয়েক বছর পর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে৷ তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ তদন্তকারীরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন৷ ২১ মার্চ আদালত প্রতিবেদন দেয়া সময় বেধে দিয়েছেন৷ দেখি তারা প্রতিবেদন দেন কিনা৷ আমরা আন্দোলনে আছি, আন্দোলনেই থাকবো৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলনেই থাকবো৷''
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
এদিকে বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ‘‘এই মামলার তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে আমার কিছু জানা নাই'' বললেও শনিবার তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসেছেন৷ শনিবার তিনি নড়াইলে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট খুব শিগগিরই আলোর মুখ দেখবে৷ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত খুনীদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ আশা করি, খুব দ্রুতই তাদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হব৷''
এর প্রেক্ষিতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াৎ হোসেন বাদশা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একদিন আগের কথায় আমরা হতাশ হলেও শনিবারের কথায় আমরা আবার আশার আলো দেখছি৷ তিনি প্রকৃত খুনীদের বের করার জোর চেষ্টার কথা বলেছেন৷ আমরাদেরও একটিই দাবি, সাগর-রুনির হত্যাকারীদের আটক এবং আইনের আওতায় আনা৷''
Farook - MP3-Stereo
তিনি বলেন, ‘‘আমরা দিনের হিসাব করিনা৷ আমরা আমাদের সহকর্মী হত্যার বিচার চাই৷ যতদিন বিচার না হবে ততদিন আমরা বিচার চাইব৷ আন্দোলনে থাকবো৷ ২১ মার্চ আদালত সাগর-রুনি হত্যা নিয়ে প্রতিবেদন দিতে বলেছে৷ আমারা ওই দিনই প্রতিবেদন দেখতে চাই৷ নতুন করে যেন সময় ক্ষেপন করা না হয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘২২ মার্চ সাংবাদিক ইউনিয়সের সব অংশ, প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি যৌথ সভা ডেকেছে৷ যদি ২১ মার্চ তদন্তকারীরা কোনো অগ্রগতি প্রতিবেদন না দেয় তাহলে ২২ মার্চ সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে নতুন আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে৷'' এদিকে, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা ২১ মার্চ তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি৷ আদালতের আদেশ পাওয়ার পর সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছি৷ আশা করি এবার প্রতিবেদন দিতে পারব৷''