বাংলাদেশের সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনো থমকে আছে৷ তদন্তকারীরা এখন ডিএনএ টেস্টের ফলাফলের আশায় হা-পা গুটিয়ে বসে আছেন৷ এই তদন্ত নিয়ে এখন হতাশা দুই পরিবারে৷
বিজ্ঞাপন
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যে ডিএনএ টেস্টের আশায় ছিল, ব়্যাব তাও এখন ফিকে হয়ে আসছে৷ হত্যাকাণ্ডের আলামত, রক্তমাখা কাপড়সহ আরো কিছু আলামত যুক্তরাষ্ট্রের ডিএনএ ল্যাবে পাঠিয়ে ২ জনের ডিএনএ প্রোফাইল পায় ব়্যাব৷ কিন্তু সেই প্রোফাইলের সঙ্গে এই মামলায় আটক ৮ জনের কারুর ডিএনএ প্রোফাইলই মেলেনি৷ ব়্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, এরপর তারা আরো কিছু আলামত পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে৷ এখন তারা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছেন৷ এদিকে বাংলাদেশে অপরাধীদের ডিএনএ তথ্যভাণ্ডার না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া ডিএনএ প্রোফাইল মিলিয়ে দেখার সুযোগও খুব সীমিত৷ বাংলাদেশে সাধারণত অজ্ঞাতপরিচয় লাশ এবং পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব নির্ধারণে ডিএনএ টেস্ট কাজে লাগানো হয়৷ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের কোনো অপরাধী শনাক্ত এবং বিচারের মুখোমুখি হয়েছে কিনা তা তার জানা নেই৷
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার বাসায় সাগর-রুনি নিহত হওয়ার পর তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের চিহ্নিত এবং গ্রেফতারের কথা বলেছিলেন৷ কিন্তু দু'বছরেও হত্যারহস্যের কিনারা হয়নি৷ থানা পুলিশ ও ডিবি-র তদন্তে ব্যর্থতার পর হত্যাকাণ্ডের ৬ মাস পর আদালতের নির্দেশে তদন্ত দেয়া হয় ব়্যাবকে৷ আর ব়্যাব তদন্ত করছে দেড় বছর ধরে৷ তারা সাংবাদিক দম্পতির লাশ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্তও করে৷ এই তদন্তকালে মোট ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ যারা সাধারণ ভাসমান অপরাধী৷ আর তাদের আটক করা হয় চোর বা ডাকাত হিসেবে৷ কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পায়নি তদন্তকারীরা৷
এই তদন্ত নিয়ে এখন পুরোপুরি হতাশ সাগর-রুনির পরিবারের সদস্যরা৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানান, তারা জানেন না তদন্তের নামে এখন কী হচ্ছে৷ তাদের সঙ্গে তদন্তকারীরা দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগও রাখছেন না৷ আর জানতে চাইলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়না৷ সাগরের মা সালেহা মুনিরও একই কথা বলেন৷ তিনি বলেন, মূল অপরাধীদের এখনো চিহ্নিত করা হয়নি৷ তাদের আটকের কোন লক্ষণও নাই৷ তিনি মনে করেন, তদন্তকারীরা নাটক ছাড়া আর কিছুই করেননি৷
তবে নতুন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল আশা করেন, ব়্যাব সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারবে৷