এক দশক পার হলেও সাংবাদিকদের পক্ষে সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান এখনও সম্ভব৷ লেগে থাকলে এই বিষয়ে অনেক তথ্যই বের করে আনা যাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা দুই অনুসন্ধানী সাংবাদিক৷
বিজ্ঞাপন
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনী হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও এই মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই৷ ৮৫ বার সময় নিয়েও আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি তদন্তকারীরা৷ এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য নিয়ে গণমাধ্যমেও তেমন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি৷ এক্ষেত্রে সাংবাদিকরা কতটা তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন? অনুসন্ধানী সাংবাদিক বদরুদ্দোজা বাবুর মতে, ‘‘আলোচিত হত্যাকাণ্ড সবগুলোর ক্ষেত্রেই একই অবস্থা৷ তদন্ত করা বা নিজে অনুসন্ধান করে কিছু বের করা যেটা তদন্ত কাজে সহযোগিতা করবে এটা দেখা যায় না খুব একটা৷ ...সাগর-রুনীর রিপোর্টের ক্ষেত্রেও সাংবাদিকরা ঠিকমত রিপোর্ট করতে পারেননি৷ এই দায় সাংবাদিকদের নিতে হবে৷’’
যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহসীন-উল হাকিমও এই বিষয়ে একমত৷ তিনি বলেন, ‘‘সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক দুইদিন আমরা কাজ করি৷ কিন্ত আমরা কি বলতে পারব যে সারা বছর কোনো প্রতিষ্ঠানের একজন বা একাধিক জন একটানা কাজ করছেন এই বিষয়টি নিয়ে? ব্যর্থতা আসবেই৷ আমরা পাব না হয়ত কিছুই, কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এভাবে এই বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি না কেউ৷’’
‘ডয়চে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ ইউটিউব টকশোতে এসে এই দুই অনুসন্ধানী সাংবাদিক এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন৷ তবে তাদের দুইজনই মনে করেন এই ঘটনায় অনুসন্ধানের সুযোগ এখনও শেষ হয়ে যায়নি৷ বদরুদ্দোজা বাবুর মতে, যত দেরিই হোক সাংবাদিকরা যেকোন জায়গা থেকেই উন্মোচনের কাজটি শুরু করতে পারেন৷ ‘‘এরকম অনেক উদাহরণ দেখব দেশে-বিদেশে যে, দশ বছর পরে এসেও সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করে খুঁজে বের করেছে৷ এই খুঁজে বের করার পথটা হয়ত কঠিন হবে, কিন্তু খুঁজে বের করা সম্ভব৷ কিছু না কিছু নতুন বের করা সম্ভব৷’’ বলেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় দেশি-বিদেশি পুরস্কারজয়ী এই প্রতিবেদক৷
তার সঙ্গে একমত মোহসীন-উল হাকিমও, ‘‘আমি বলতে চাইছি এখনও যদি আমরা ইনভেস্টিগেশন করি আমরা যদি একেবারে মোটিভ পর্যন্ত কালকে নাও পারি, এর ভিতর থেকে আরো কিছু গল্প আমরা নিশ্চয়ই পাব৷ এখানে কার কী ভূমিকা ছিল বা কার প্রভাব বা কার গাফিলতিতে এই বিষয়টি এই পর্যায়ে এসেছে সেটি পাব৷ ...একজন সাংবাদিক যদি তার নিউজরুমের সমর্থন নিয়ে কাজ করেন তাহলে এটার ভিতরের অজানা তথ্য বের হতে থাকবে৷ এবং আমার মনে হয় লেগে থাকলে হয় না এমন আসলে হতে পারে না৷’’
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বাধা, চাপ, সাংবাদিকদের নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনার প্রসঙ্গও উঠে আসে৷ বদরুদ্দোজা বাবুর মতে, বাংলাদেশে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকদের দক্ষতার অভাব নেই৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা যা করতে চান তা করতে পারেন না, করলেও তা প্রকাশ হয় না৷ এক্ষেত্রে যারা সংবাদ নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের কারণে সব সাংবাদিকরাই সমালোচিত হচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সাংবাদিকতায় মাঠ পর্যায়ে যারা আছেন তাদেরকে আমার ব্যর্থ মনে হয় না৷ তাদের অনেক ইচ্ছা আছে৷ তারা চাইলেও অনেক রিপোর্ট করতে পারেন না৷ ...চাপ যতটা না বাইরে থেকে সেই চাপ ততটা নিজের ভিতরে তৈরি হয়ে গেছে৷ সেই কারণে সে মনে করে এই রিপোর্ট নিয়ে যদি অনেক দিন কাজ করি তাহলে এটা অনএয়ার হবে না বা পাবলিশ হবে না৷’’
তবে এ বিষয়ে হতাশ নন মোহসীন-উল হাকিম৷ তিনি বলেন, ‘‘নিঃসন্দেহে কাজ হচ্ছে, অনেকেই কাজ করছেন৷ কাজ করার চেষ্টা করছেন৷ পরিবর্তন আসছে৷ গত ১৫ বছর হিসাব করলে আবার উল্টো দিকে ঘোরা শুরু করছে৷’’
এফএস/এআই
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে গত দুই দশকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন৷ তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনাগুলো ঘটেনি৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan
দুই দশক
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৩৬৪ জন৷ বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল ২০০৫-০৬ সালে৷ ২০০৫ সালে ৩৭৭ জন এবং ২০০৬ সালে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ তবে আরেক মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে দুই দশকে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চার হাজারের বেশি৷
ছবি: Shahidul Alam/Drik/Majority World
আওয়ামী লীগের ইশতেহার
সেসময় ক্রসফায়ার নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের৷ ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়৷ সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুচ্ছেদে ৫.২ নং অঙ্গীকারে বলা হয়েছিল, ‘‘বিচারবিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে৷ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
কথা রাখেনি সরকার
ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি আওয়ামী লীগ সরকার৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরে ২০০ জনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে মারা গেছেন আড়াই হাজারের বেশি মানুষ৷ (২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ছবি)
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/A. Nath
নির্বাচন ও ক্রসফায়ার
আসক এর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ নির্বাচনী বছর ও তার আগের বছরে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালে প্রতিমাসে গড়ে ২৭ জন বা মোট ৩২৯ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে৷ ২০১৮ সালের ৪৬৬ টি ঘটনা ঘটে যা আগের বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি৷ ২০১৯ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩৮৮ টি৷
ছবি: DW/A. Islam
২০২১ সাল নিম্নমুখী
আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২২২টি৷ সেখানে গত বছর এমন ঘটনা ঘটেছে মোট ৮০টি৷ এর মধ্যে ৩০টির সঙ্গে জড়িত র্যাব, ২৪টিতে পুলিশ, দুইটিতে র্যাব ও পুলিশ এবং ১৭টি ঘটনায় বিজিবির নাম এসেছে৷ ৪৮টি ক্ষেত্রেই গেপ্তারের আগে ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: Getty Images
নানা নাম
তবে এগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে স্বীকার করে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ কখনও ক্রসফায়ার, কখনও বন্দুকযুদ্ধ কখনওবা এনকাউন্টার হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেয়া হয় বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে৷ সম্প্রতি র্যাব দাবি করেছে তাদের সদস্যদের সঙ্গে ‘ধস্তাধস্তিতে’ গাজীপুরে এক ব্যক্তি মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan
একরামুল হত্যা
২০১৮ সালে ২৬ শে মে র্যাবের ‘মাদক বিরোধী অভিযানে’ কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন কক্সবাজারের কাউন্সিলর একরামুল হক৷ কিন্তু স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তের মোবাইলের কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর র্যাবের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে৷ এই ঘটনায় একরামুলের পরিবার মামলা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: DW/S. Kumar Dey
মেজর সিনহা হত্যা
বাংলাদেশে বিচার বহিভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা৷ ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি৷ টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয় পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন৷ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরো শতাধিক এমন হত্যার অভিযোগও রয়েছে৷
ছবি: bdnews24
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ এই নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগের পাঁচদিনে ‘ক্রসফয়ারে’ পাঁচজন নিহত হয়েছেন৷ কিন্তু এরপর আর এমন ঘটনা ঘটেনি৷
ছবি: DW
সরকারের বক্তব্য
তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে কিছু হয় না বলে বারবারই দাবি করে আসা হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে৷ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও সরকার এই কথা জোর দিয়ে বলে আসছে৷ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি৷ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে৷’’