গত এক বছর ধরে সন্ত্রাসের জনপদ বলে আলোচনায় উঠে আসা সাতক্ষীরা সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ সফরকালে তিনি বললেন, সাতক্ষীরায় সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ থাকবে না৷ তবে অব্যাহত থাকবে যৌথ বাহিনীর অভিযান৷
বিজ্ঞাপন
গত এক বছর ধরে সন্ত্রাসের জনপদ বলে আলোচনায় উঠে আসা সাতক্ষীরা সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ সফরকালে তিনি বললেন, সাতক্ষীরায় সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ থাকবে না৷ তবে অব্যাহত থাকবে যৌথ বাহিনীর অভিযান৷
বাংলাদেশের দক্ষিণে সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা জেলাকে বলা হয়ে থাকে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত এলাকা৷ যা ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায় যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়ার পর৷ সেই রায়ের পর যে কয়েকটি জেলায় ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে, তার মধ্যে সাতক্ষীরা অন্যতম৷ এছাড়া, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার পরও সাতক্ষীরায় ব্যাপক সহিংসতা হয়৷ সাতক্ষীরা শহর থেকে জেলার অন্যান্য উপজেলা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়৷ সড়ক কেটে, গাছ ফেলে এবং পাহারা বসিয়ে এক ধরণের নিজস্ব আধিপত্য কায়েম করা হয় সেখানে৷ বাইরের মানুষ তো দূরের কথা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সেখানে প্রবেশ করতে পারতেন না৷ সাংবাদিকরাও যেতে পারতেন না বিচ্ছিন্ন ঐ জনপদে৷ যেতে চাইলে তাঁদের পথে পথে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হতো৷ গত ১০ মাসে সেখানে নারী, শিশু, মুক্তিযোদ্ধা এবং সাংবাদিকসহ ২১ জন নিহত হয়েছেন৷ কয়েকশ বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ আর নির্বাচনের আগে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরুর পরও পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি৷ অভিযানে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে, তারা দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধের মুখেও পড়েছেন৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার সাতক্ষীরা গিয়ে প্রথমেই সার্কিট হাউজে জামায়াত-শিবিরের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন৷ প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বলেন, সাতক্ষীরায় সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ থাকবে না৷ তার জন্য যা করার তা করবে সরকার৷ একই সঙ্গে যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি একজন ভুক্তভোগী৷ আমার বাবা-মা, ভাই-বোনসহ অনেক আত্মীয়স্বজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে৷ আমি রাজনীতি করি তাঁদের জন্য, যাঁরা এ দেশে নিষ্পেশিত নির্যাতিত৷''
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিএনপি-জামায়াতের কারণে দেশে যে সহিংসতা, মানুষ হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না৷'' হতাহতের পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘‘নির্যাতনকারীরা দেশের যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, তাদের খুঁজে বের করে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে৷ আপনাদের আমি স্বজন ফিরিয়ে দিতে পারবো না৷ তবে হত্যাকারী এবং হামলাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করবো৷''
প্রধানমন্ত্রী সাতক্ষীরায় সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহত ১৬ জনের পরিবারসহ ১৫৪ জনের হাতে নগদ অর্থ সহায়তা তুলে দেন৷ যাঁদের বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেঙে বা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে তা পুনর্নির্মাণ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি৷
প্রধানমন্ত্রী বিকেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় বক্তৃতা দেন৷ সেখানে তিনি বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে৷ তাই জামায়াতের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে নির্বাচন বর্জন করেছেন খালেদা জিয়া৷ তিনি বলেন, একাত্তরে যারা হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সেই জামায়াত এখন বিএনপির দোসর৷ বিএিনপি-জামায়াত দেশে সহিংসতা আর সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়৷ কিন্তু তাদের সেই ষড়যন্ত্র সফল হবে না, জানান প্রধানমন্ত্রী৷
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রীর সাতক্ষীরা সফরের কারণে পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাঁদরে ঢেকে ফেলা হয়৷