নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাতখুনের মামলার তদন্ত এককভাবে স্থানীয় ডিবি পুলিশকে দিয়ে করানোর সরকারি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে৷ তাই এখন, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সিআইডি-কে দিয়েই এ মামলার তদন্ত করানোর দির্দেশ দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
নারায়ণগঞ্জে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণ এবং হত্যা মামলার তদন্তের সঙ্গে আদালতের নির্দেশে শুরু থেকেই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি যুক্ত হয়৷ পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশও তদন্ত কাজ করছিল৷ কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সিআইডি-কে এই মামলার তদন্তে কোনোরকম সহযোগিতা করছিল না, যা সিআইডি লিখতভাবে আদালতকে জানায়৷ তারা আদালতে জানায় আরো যে, স্থানীয় পুলিশ তাদের ব়্যাবের তিন কর্মকর্তাসহ যাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে তাঁদের জবানবন্দির অনুলিপিও দিচ্ছে না৷
সরকারই যে সিআইডি-কে দিয়ে মামলার তদন্ত করাতে চায় না, তা আরো স্পষ্ট হয় অ্যাটর্নি জেনারেলের তত্পরতায়৷ তিনি হাইকোর্টে সিআইডি-কে বাদ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ থানা পুলিশ দিয়ে মামলার তদন্তের আবেদন জানান৷ কিন্তু বৃহস্পতিবার আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করে দেয়৷
হাইকোর্টের বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ তাঁদের আদেশে অবশ্য সামান্য পরিবর্তন এনেছেন৷ তারা সিআইডি-কে ‘ইনভেস্টিগেশন'-এর পরিবর্তে ‘ইনকোয়ারি' করতে বলেছেন৷
গত ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারকে অপহরণ করা হয়৷ ৩০শে এপ্রিল তাঁদের লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে৷ এই ঘটনার পর হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়েই সিআইডি-কে এই মামলার তদন্তের নির্দেশ দেয়৷ ওদিকে অবশ্য জেলা ডিবি পুলিশও তদন্ত চালাচ্ছিল৷ আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি দেখান, ‘‘ফৌজদারি মামলার তদন্ত দুটি সংস্থার মাধ্যমে করা আইনগতভাবে সঠিক নয়৷ এতে বিচার ‘ভুল' হয়ে যাবে৷'' তবে আদালত তাঁর এই যুক্তি গ্রহণ করেনি৷
অপহরণের ঘটনার পরপরই নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করা হয়৷ নূর হোসেন ব়্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে সাতজনকে হত্যা করিয়েছে বলে নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন৷
এরই মধ্যে এই মামলায় ব়্যাব ১১-এর তখনকার অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকে গ্রেপ্তারের পর তাঁরা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন৷ শুধু তাই নয়, নূর হোসেন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতে গ্রেপ্তারও হয়েছেন৷ জানা গেছে, তিন ব়্যাব কর্মকর্তার জবানবন্দিতে ব়্যাবের অন্তত আরো ১০ জন রাজনৈতিক নেতাদের নাম এসেছে, যাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
বলা বাহুল্য, এটা সরকারের জন্য খুবই বিব্রতকর এবং স্পর্শ কাতর৷ তাই এই মামলার তদন্তে এখন চরম গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে৷ এমনকি এখন পর্যন্ত সিআইডি-কেও তাই জবানবন্দির কপি দেয়া হয়নি৷ নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান যে, তাঁরা চান না জবানবন্দিতে যাঁদের নাম এসেছে তা কোনোভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাক৷