রাজধানীর লালবাগে ২০ বছর আগের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে হাইকোর্ট৷ নিম্ন আদালতের রায়ে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড, নয় জনের যাবজ্জীবন এবং একজনের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল৷
বিজ্ঞাপন
নিহত হাফিজউদ্দিনের ভাই রিয়াজউদ্দিন আহমেদ রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা খুব একটা খুশি হতে পারিনি৷ ওই হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত বিএনপি নেতা আবদুল আজিজ মিয়ার সাজা বাড়ানো হলে খুশি হতাম৷'' নিম্ন আদালত রায়ে আবদুল আজিজের ১০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন৷ রিয়াজউদ্দিন বলেন, ‘‘ওই খুনের নির্দেশদাতা ছিলেন আবদুল আজিজ৷ তার সর্বোচ্চ সাজা হলে আমরা খুশি হতাম৷''
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি হলেন আবদুস ছালাম ওরফে মতি ও জাহিদ হোসেন ওরফে নাটকা বাবু৷ তারা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন৷ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ জন হলেন আবদুল আলিম ওরফে শাহীন, মুন্না, কালু ওরফে কাইল্যা, দেলোয়ার হোসেন ওরফে আন্ডা, আমির হোসেন ওরফে আমিরা, মাহাতাব হোসেন, মনির পাটোয়ারী, দিল মোহাম্মদ ওরফে মতি ও মোজাম্মেল৷ এদের মধ্যে প্রথম পাঁচজন কারাগারে, পরের দুজন জামিনে ও শেষ দু'জন পলাতক৷ আর আবদুল আজিজকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ তিনি জামিনে আছেন৷ আদালত আবদুল আজিজসহ তিন আসামিকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন৷
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ৩০শে জানুয়ারি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হুমায়ুন কবির বিজয়ী হন৷ পরদিন তার সমর্থকরা বিজয় মিছিল বের করলে লালবাগের নবাবগঞ্জ রোডে পরাজিত প্রার্থী বিএনপি সমর্থিত আব্দুল আজিজ মিয়ার সমর্থকরা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়৷ ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে ৬ জন ও পরে হাসপাতালে আরো একজন মারা যান৷ সেই সময়ে এই ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে৷ খুনিদের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনও হয়৷
নিহতরা হলেন লালবাগ এলাকার দেলোয়ার, গাজী, নজরুল, আনোয়ার, হাফিজউদ্দিন, আজিজ ও শাহ আলম৷ ঘটনার পর তখনকার বিজয়ী কমিশনার হুমায়ুন কবির ১৯ আসামির নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ৭০ থেকে ৮০ জনের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন৷ তখন থেকে মামলাটি সেভেন মার্ডার হিসেবে পরিচিতি পায়৷ মামলায় দণ্ড পাওয়া সবাই বিএনপি নেতা আবদুল আজিজ মিয়ার কর্মী ও সমর্থক৷
ঘটনার পর সাড়ে ৩ মাস তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ১৯৯৪ সালের ১৪ মে ২১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে৷ ১লা আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়৷ বিচার চলাকালে আসামি আবদুল মজিদ মৃত্যুবরণ করেন৷ আবদুল মজিদ মামলার অন্যতম আসামি আজিজের বাবা৷
জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ জেলা জজ আদালত ২০০৮ সালের ৭ই মে রায় ঘোষণা করেন৷ রায়ে দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড, ৯ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আট আসামিকে খালাস দেয়া হয়৷ নিম্ন আদালতের রায়ের পর পলাতক দুই আসামি ছাড়া অপর আসামিরা আপিল করেন৷ ডেথরেফারেন্স শুনানির জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে৷ চলতি মাসের শুরুতে ডেথরেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়৷
রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির উল্লাহ বলেন, অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের সাজার রায় বহাল রেখেছেন৷ আসামিদের ডেথরেফারেন্স মঞ্জুর ও আপিল খারিজ করে এই রায় দেয়া হয়েছে৷ তবে রায়ে খুশি নন আসামিপক্ষের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান৷ তিনি জানান, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হবে৷ মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই আসামির জরিমানার আদেশ বাতিল করা হয়েছে৷ জামিনে থাকা তিনজনকে ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে৷ আসামিপক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, মাহবুব উদ্দিন খোকন, খুরশীদ আলম খান ও এ এস এম শাজাহান৷