সাত মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় তিন লাখ প্রাণহানির শঙ্কা
সমীর কুমার দে ঢাকা
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
রিখটার স্কেলে যদি সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয়, সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না ঢাকা৷ ধ্বসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের৷ এমনটাই মনে করছেন ভূমিকম্প বিশ্লেষকরা৷
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ৷ সেবার আতঙ্কেই মারা যান ৬ জন৷ গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্পের আলামত৷ আবার বড় ভূমিকম্পের শত বছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়৷ সে দিক থেকেও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট৷
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "গত দু-তিন বছরে দেশে ভূমিকম্প অনেক বেড়েছে৷ আবার ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের এখানে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি৷ এটা আতঙ্কের বিষয়৷ তার মানে, ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে৷ ফলে সামনে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা আছে৷ তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট, অর্থাৎ, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে৷ কয়েক হাজার ভবন ধ্বসে পড়বে৷ মৃত্যু হতে পারে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের৷ কারণ, আমাদের ভবনগুলো এখনও নিরাপদভাবে তৈরি হচ্ছে না৷”
‘দেশের ২০ লাখ বহুতল ভবনের সবকটিকে ভূমিকম্প-সহনশীল করতে হবে’
বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে৷ এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়েও উঁচু৷ ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে৷
অধ্যাপক আনসারী বলেন, ‘‘দ্রুত দেশের ২০ লাখ বহুতল ভবনের সবক'টিকে ভূমিকম্প-সহনশীল করতে হবে৷ সেটা করার মতো কারিগরি দক্ষতা এবং সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে৷ তবে এ জন্য সরকারের জরুরি উদ্যোগ দরকার৷ সারা দেশে বড় বড় শহরে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে সেখানকার বাসাবাড়ি ভূমিকম্পন-সহনীয় কিনা, সেটা যাচাই করতে হবে৷ কোনো বাসা খারাপ থাকলে মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে৷ কারণ, ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ মানুষ মারা যায় ভবন ধসে৷ তুরস্কেও আমরা দেখলাম ভবন ধ্বসেই বেশি মৃত্যু হয়েছে৷”
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ঢাকায় যদি সাত মাত্রার ভূমিকম্পও আঘাত হানে, আমরাদের যে প্রস্তুতি, ভবনের স্ট্রাকচার, ঘনবসতি তাতে অনেক বড় বিপর্যয় হতে পারে৷ আমাদের এত বছরে যত উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে তা আবার ফিরিয়ে আনা অনেক সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার হবে৷” শক্তিশালী এই ভূমিকম্পের আশঙ্কার কারণ জানতে চাইলে অধ্যাপক আখতার বলেন, "ভূতাত্ত্বিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশে তিনটি টেকটনিক প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত৷ উত্তরে তিব্বত প্লেট, পূর্বে বার্মা সাব-প্লেট এবং পশ্চিমে ইন্ডিয়া প্লেট৷ এগুলোর বিস্তৃতি সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার৷ এই জোনে বড় বড় ভূমিকম্প হয়েছে৷ আবার শতবর্ষে বড় ভূমিকম্প ফিরে আসে৷”
এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ সব ভূমিকম্প
সোমবার ভোরে সিরিয়া ও তুরস্কে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ২,৩০০-র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ ছবিঘরে এই শতাব্দীতে বিশ্বে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সব ভূমিকম্পের তথ্য থাকছে৷
ছবি: AP
৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, সিরিয়া ও তুরস্ক
সোমবার ভোরে সিরিয়া ও তুরস্কে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে৷ এতে এখন পর্যন্ত তুরস্ক ও সিরিয়ায় ২,৩০০-র বেশি মানুষ মারা গেছেন৷
ছবি: Ghaith Alsayed/AP Photo/picture alliance
১৪ আগস্ট, ২০২১, হাইতি
হাইতির দক্ষিণাঞ্চলে ৭.২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে ২,২০০র বেশি মানুষ প্রাণ হারান৷ প্রায় ১৩ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল৷
ছবি: Reginald Louissant Jr/AFP/ Getty Images
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসিতে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের কারণে প্রায় দেড় মিটার উঁচু সুনামি হয়েছিল৷ প্রাণ হারান চার হাজার ৩০০ জনের বেশি মানুষ৷
ছবি: Getty Images/C. Court
১ নভেম্বর, ২০১৭, ইরান
পূর্বাঞ্চলীয় কেয়ারমানশাহ রাজ্যে ৭.৩ মাত্রা ভূমিকম্পে চারশর বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Pakizeh
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, মেক্সিকো
মধ্য মেক্সিকোতে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্পে কমপক্ষে ৩৬৯ জন প্রাণ হারান৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/G.M. Contreras
২৪ আগস্ট, ২০১৬, ইটালি
রোমের পূর্বে পাহাড়ি এলাকায় ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৩০০ জন নিহত হয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/M.Cavallari
১৬ এপ্রিল, ২০১৬, ইকুয়েডর
দেশটির প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলীয় এলাকায় ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে সাড়ে ছয়শর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন৷
ছবি: Imago/Zumapress
২৬ অক্টোবর, ২০১৫, পাকিস্তান-আফগানিস্তান
৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে দুই দেশ মিলিয়ে প্রায় চারশ জন প্রাণ হারান৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Shah
২৫ এপ্রিল, ২০১৫, কাটমান্ডু, নেপাল
৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প প্রায় নয় হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়৷ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল কাটমান্ডু থেকে ৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে৷
ছবি: Reuters/N. Chitrakar
১১ মার্চ, ২০১১, ফুকুশিমা, জাপান
৯ মাত্রার ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি ও তারপর পারমাণবিক কেন্দ্রে বিপর্যয়ের ঘটনায় প্রায় ২১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়৷
ছবি: picture alliance/dpa
১২ ডিসেম্বর, ২০১০, পোর্ট অফ প্রিন্স, হাইতি
৭.৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে৷ এতে কমপক্ষে তিন লক্ষ ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়৷ আহত হয় প্রায় তিন লক্ষ মানুষ৷ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল হাইতির রাজধানী পোর্ট অফ প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে৷
ছবি: AP
১২ মে, ২০০৮, সিচুয়ান, চীন
৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ মারা যায়৷ এতে ৫০ লক্ষেরও বেশি ভবন ধসে পড়ে৷ নিহতদের বেশিরভাগই ধসে যাওয়া ভবনের নীচে পড়ে প্রাণ হারায়৷
ছবি: AFP/Getty Images
২৬ মে, ২০০৬, ইয়োগিয়াকার্টা, ইন্দোনেশিয়া
২০০৬ সালের ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৫,৮০০ মানুষের প্রাণ যায়৷ আহত হয় প্রায় ৩৬ হাজার৷
ছবি: AP
৮ অক্টোবর, ২০০৫, কাশ্মীর, পাকিস্তান
৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে কমপক্ষে ৭৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়৷ এছাড়া ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে প্রায় ১,৩০০ জন এবং আফগানিস্তানেও বেশ কয়েকজন নিহত হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/E. Feferberg
২৬ ডিসেম্বর,২০০৪, আচে, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উপকূলে সমুদ্রগর্ভে সংঘটিত ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্প যে সুনামির অবতারণা ঘটায়, তাতে ১৪ দেশের প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Choo Youn Kong
২৬ ডিসেম্বর, ২০০৩, বাম, ইরান
৬.৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন৷ আহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার৷
ছবি: AP
২৬ জানুয়ারি, ২০০১, গুজরাট, ভারত
গুজরাটে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ৷
ছবি: SEBASTIAN D'SOUZA/AFP/Getty Images
17 ছবি1 | 17
বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০ ছরে বাংলাদেশে ৮৭ বার ভূকম্পন হয়৷ এ সময় মারা যান ১৫ জন৷ এর মধ্যে ১৩ জনেরই মৃত্যু আতঙ্কিত হয়ে৷ প্রাণহানিসহ ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ শহরাঞ্চলেই বেশি৷ ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সারা দেশে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৯৬ কিলোমিটার দূরের সিকিম-নেপাল সীমান্তে৷ ১৮৫৭ সালের পর ঢাকার এত কাছে আর কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল না৷
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৭টি ভূমিকম্পের প্রভাবে কেঁপেছে বাংলাদেশ৷ সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ভূমিকম্পে কাঁপে দেশ৷ রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ২ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল বঙ্গোপসাগর৷ ২০২১ সালের ২৯ মে এক দিনেই টানা ছয় দফা মৃদু ভূমিকম্পের কারণে সিলেট শহরসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷ এসব কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতা: আলী আহমেদ খান
বাংলাদেশে যদি বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য উদ্ধার তৎপরতার প্রস্তুতি কেমন? ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের খুব বেশি প্রস্তুতি নেই৷ সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতা, যেটার জন্য ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনওইসি) থাকতে হয়৷ সেটা এখন সময়ের দাবি৷ তবে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে৷ যেমন ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরে আর বহুতল ভবন হবে না৷ পাশাপাশি যে ভবনগুলো আগে হয়েছে, সেগুলোর ভূমিকম্প-সহনশীলতাও পরীক্ষা করে নিশ্চিত করতে হবে৷”
তুরস্কের ভূমিকম্পের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেছেন, প্রতিটি দুর্যোগ থেকেই আমরা শিক্ষা নিচ্ছি৷ সে অনুযায়ী নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি৷ তবে রাতারাতি সব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়৷ বাংলাদেশকে ভূমিকম্প-সহনীয় দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে জাপানের সঙ্গে চার দফা বৈঠক হয়েছে৷ একটি সমঝোতা স্মারক তৈরি হয়েছে৷ সেই অনুযায়ী তিন ধাপে বাংলাদেশকে ভূমিকম্প-সহনীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে৷ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের পর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা নেই ঢাকা শহরে৷ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মেনে চলার নির্দেশনা থাকলেও রাজধানীর বেশির ভাগ ভবন মালিকই তা মানছেন না৷ এ বিষয়ে আইন হওয়ার প্রায় ১৫ বছর পরও এটি ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজধানীতে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং ভূমিকম্পে ক্ষতির আশঙ্কা৷
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ঘেরা ঢাকা শহর
রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সুনির্দিষ্ট তালিকা কখনোই তৈরি হয়নি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভাঙা হচ্ছে না অতি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট
সাতটি বিশাল মার্কেট ভবনকে প্রায় সাত বছর আগে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল বুয়েট, নানা কারণ দেখিয়ে আজ পর্যন্ত তা ভাঙা হয়নি। ভবনগুলো হচ্ছে মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট, গুলশান-২ কাঁচা মার্কেট, গুলশান-১ পাকা মার্কেট, কাওরানবাজার কিচেন মার্কেট, কাওরানবাজার ১ এবং ২ নং ভবন মার্কেট, কাওরানবাজার আড়ৎ ভবন ও রায়েরবাজার মার্কেট। (ছবিটি গুলশান-১ ডিএনসিসি পাকা মার্কেটের)
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঐতিহ্যবাহী ‘নিলাম ঘর’ ভেঙে ফেলা হয়েছে
পুরান ঢাকার জজ কোর্টের পিছনের কোর্ট হাউজ স্ট্রিটের ২০০ বছরের পুরাতন ‘নিলাম ঘর’ গত বছর ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ যা ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কথা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শুধু চোখের হিসাব
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেদি হাসান আনসারি বলেন, ‘২০০৯ সালের ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জরিপের কারিগরি কমিটিতে আমি ছিলাম। তখন মাত্র ১০টা ভবনের কারিগরি দিকসহ সবকিছু খুঁটিয়ে দেখা হয়েছিল। বাকি ৪০০ থেকে ৫০০টি ভবন দেখা হয়েছিল সাধারণ পর্যবেক্ষণে চোখের অনুমানের ভিত্তিতে। তখন ঢাকায় ভবনের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ২৬ হাজার। ঢাকায় কোথায় কত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অবস্থিত, তা মন্ত্রণালয় আদৌ বলতে পারবে না।‘
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আমরাও এমন ঝুঁকি নিয়ে বাস করতে চাই না’
পুরান ঢাকার কৈলাশ ঘোষ লেনে প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো ‘ইয়াং প্রেস’ ভবনে বংশানুক্রমে ৫০ বছর ধরে থাকছেন সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘‘এখানে কোনো বাসা ভাড়া দিতে হয় না। তবে আমরাও এত ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করতে চাই না। সরকার যদি নামমাত্র মূল্যে আমাদের মতো গরিবদের থাকার একটা জায়গা দিত, এখানে আর থাকতাম না।’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মতিঝিলে বহুতল ভবনে ফাটল
এ বছরের গত ৬ মার্চ ঢাকার মতিঝিলের ৫৩ নম্বর ভবনে ‘মডার্ন ম্যানশন’ নামের ১৫ তলাবিশিষ্ট একটি বাণিজ্যিক ভবনে ফাটল ধরা পড়ে। তবে ভবনটি কোনো দিকে হেলে পড়েনি। ভবন থেকে সকল অফিস ও বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হলেও গত সাত মাসে ভবনটি ভাঙা এখনো শুরু হয়নি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাণী ভবন
পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল ‘বাণী ভবন’ নামে পরিচিত। শতবর্ষ পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনে দশের বেশি পরিবার থাকে। আগে শিক্ষার্থীরা থাকলেও প্রায় ১৫ বছর প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা থাকছেন। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভবনটির বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে বলে জানান বাসিন্দারা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ব্যবসায়িক কাজ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই
ঢাকার মহাখালী আমতলিতে ‘রহমান ভবন’ নামের একটি পাঁচ তলা ভবনও ঝুঁকিপূর্ণ। একতলায় মিষ্টি, চায়ের দোকানসহ একাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চলছে। সেখানে নোটিস দিয়ে বলা হয়েছে যে বিআরটিসি বুয়েট, কর্তৃক তদন্তে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবকাঠামোটি ভেঙে ফেলার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
একটি ভবনও থাকবে না
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ঘিঞ্জি এলাকা পুরান ঢাকাকে প্ল্যানে নিয়ে আসতে হলে কোনো ভবনের অস্তিত্ব থাকবে না, সব ভেঙে ফেলতে হবে। শুরুতে ঢাকায় কোনো পরিকল্পনা না থাকায় শত শত বছর ধরে এ জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। তবে ঢাকা যত উন্নত হচ্ছে এসবও উন্নত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, ওয়ারির কথা বলেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নেই পরিসংখ্যান ও সূচক
ঢাকায় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ, একাধিক কর্তৃপক্ষের তথ্যে রয়েছে বিস্তর অমিল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় জানায়, ঢাকায় ৭২ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। ডিএসসিসি থেকে জানা যায়, ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৫০০ ভবন চিহ্নিত হয়েছে। অন্যদিকে রাজউকের মতে ৩২১টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের এক জরিপে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বলা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরকারি ভবনে ছাদধস
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকার কারওয়ান বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল পাঁচের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার ২০১ নম্বর কক্ষের ছাদের একাংশ খসে পড়ে। এতে কেউ হতাহত না হলেও কর্মকর্তা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ওই আড়ত ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনেক সমস্যা, অক্ষমতা ও অজুহাত
ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পুরান ঢাকার ভবন মালিকরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে ভবনগুলোকে রেখে দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মালিক ও ভাড়াটেরা বলেন, নতুন করে ভবন তারা গড়তে চান না। ভাড়াটিয়ারা বলেন, মানুষের জীবন মালিকদের কাছে তুচ্ছ, বরং টাকাটাই মুখ্য। ভবন মালিক রমজান আলী জানান, একটি ভবন আরেকটির সঙ্গে গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। একটি ভবন ভেঙে সেটা ফের বানাতে গেলে নতুন বিপত্তি হবে। তাছাড়া এত অর্থও নেই।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ওয়াহেদ ম্যানশন’ এখন নিরাপদ
পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনে ২০১৯ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনটিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিভেন্স। সাম্প্রতিক সময়ে ভবনটি মেরামত করে সেখানে পুরোদমে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা যতদূর জানি এটা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পরিদর্শনে এসে শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দিয়েছেন। দোতলায় ব্যাংক ভাড়া হওয়ার পর নিরাপদ ভেবে এসেছি।‘
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনুমোদন এক, বাস্তবে আরেক
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ২২ তলা ভবন এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। সেই ভবন থেকে বেরোনোর জন্য কোনো আপৎকালীন রাস্তা ছিল না। এই দুর্ঘটনার পর আরেকটি গুরুতর বিষয় সামনে আসে। ভবনটি নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো নকশা লঙ্ঘন করে রাজউক থেকে ১৮ তলার নকশার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকায় এমন নকশা লঙ্ঘন করা ভবনের অভাব নেই।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের উদ্যোগ
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটার পর বেড়ে যায় সরকারের তৎপরতা, গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তদন্তের পর চলে তদন্ত, রিপোর্টও আসে কিন্তু সেসব কার্যকর হয় না। চকবাজারের নিমতলি, চুড়িহাট্টা, বনানী, হাশেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে তদন্ত হলেও সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মিডিয়া থেকেও ধীরে ধীরে থেমে গিয়েছে আলোচনা সমালোচনা। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আরেকটি বড় ভূকম্পনের আশঙ্কা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আক্তার বলেন, সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পে সবচেয়ে ঝুঁকি রয়েছে ঢাকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দরকার একযোগে পদক্ষেপ
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিটি ভবন পরীক্ষা করা ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার উপায় নেই। ভবনের বিভিন্ন সূচক নির্ধারণ করে সরকারের কয়েকটি বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পুরান ঢাকাকে শৃঙ্খলায় আনার প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ডিএসসিসিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের প্রথম কাজ, ভবনের পাশের রাস্তাগুলো বড় করা, সেটব্যাক ভেঙে ফেলা এবং যথাসম্ভব ঐতিহ্যবাহী ভবন রক্ষা করা। তবে লোকবলের অভাবে আমাদের কাজ ব্যাহত হয়।