সাধারণ নাগরিক ও অর্থনীতিবিদদের বাজেট ভাবনা
২ জুন ২০২১সাব্বির রহমানের বাড়ি যশোরে৷ তিনি বাসের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেন৷ দূরপাল্লার বাস চালু হওয়ার পর গত মঙ্গলবার প্রথম ট্রিপ পেয়েছেন৷ করোনায় বাস বন্ধ থাকায় তার কোনো আয় ছিলনা৷ চরম কষ্টে দিন কেটেছে৷ তার কাছে বাজেট মানে তার কষ্টের অবসান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি চাই এই বাজেটে যেন আমাদের কষ্টের অবসান হয়৷ আমরা যদি কিছু প্রণোদনা পাই তাহলে অনেক খুশি হবো৷ অনেক শিল্প মালিক, বড় ব্যবসায়ী প্রণোদনা পেয়েছেন৷ আমরা তো কিছু পাই নাই৷ সামনে আমাদের কী হবে?'' তার কথা বাজেটে গরিব মানুষের জন্য যে সুবিধা দেয়া হয় তা যেন তারা পান৷ তার অভিযোগ, তারা সবসময় তা পান না৷
এই করোনায় অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, ব্যবসা হারিয়েছেন৷ অনেকে কাজ পাচ্ছেন না৷ দুই কোটিরও বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন৷ বিশাল জনগোষ্ঠীর অনেকে বিপদে আছেন৷ তা ফুটে উঠেছে পিরোজপুরের দেবদাস মজুমদারের কথায়৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা সাধারণ মানুষ বাজেটে বড় বড় উন্নয়নের কথা বুঝিনা৷ আমরা বুঝি দুই বেলা খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারব কিনা৷ আমাদের এলাকায় অনেক মানুষের হাতে কোনো কাজ নেই৷ অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে এসেছেন৷ সরকারি সহায়তা যা দেয়া হয় তা সবাই পান না৷ তারা কীভাবে চলবেন? এবার কৃষিরও ক্ষতি হয়েছে৷ এরমধ্যে আবার জিনিসপত্রের দাম বাড়তি৷''
করোনার মধ্যে এটা দ্বিতীয় বাজেট৷ যা জানা যাচ্ছে তাতে এবার বাজেটের আকার হবে ৬ লাখ তিন হাজার ৬৮১ হাজার কোটি টাকার৷ গতবারের চেয়ে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি৷ আর এই বাজেটে ঘাটতি হবে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা, যা একটি রেকর্ড৷ এবার বিদেশি ঋণ বাড়ছে৷ সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকছে অবকাঠামো খাতে৷
করোনার কারণে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ছে৷ বাড়ছে সামাজিক বেষ্টনী৷ আসছে নানা খাতে কর অবকাশ৷ কালো টাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ থাকছে৷ টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্নই করা হবেনা৷ বৈধ-অবৈধ সবই অপ্রদর্শিত আয় হিসেবে বিবেচনা করা হবে৷ মাত্র শতকরা ১০ ভাগ আয়কর দিলেই ‘হালাল' হয়ে যাবে৷
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, এবার তারা সিপিডির পক্ষ থেকে বাজেটে চারটি খাতকে গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন৷ স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং কৃষি৷ তিনি বলেন, ‘‘যা খবর আছে তাতে স্বাস্থ্যখাতকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো এই খাতের সক্ষমতা নিয়ে৷ সাফল্য নির্ভর করছে ভ্যাকসিনের ওপর৷ সবাইকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে কিনা তার ওপর৷''
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে প্রচুর কর ছাড় আসছে৷ এর মাধ্যমে যদি ব্যক্তিখাত উৎসাহিত হয় তাহলে কর্মসংস্থান হবে৷ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে সেটা যেন শুধু আগে যারা পেয়েছেন তারাই না পান৷ নতুন সুবিধাবঞ্চিতরা যেন যুক্ত হন৷''
তবে এই বরাদ্দ কাজে লাগাতে হবে৷ বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে৷ কারণ প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার কারণে বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ৷
এবার বাজেটের আগে কালোটাকা সাদা করার হিড়িক পড়ে যায়৷ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যত দিন কালো টাকা থাকবে তত দিন এই সুবিধা থাকবে৷ কিন্তু বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ এর বিরোধিতা করছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এবার কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত আয় বোঝা কঠিন৷ কারণ এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবেনা৷ ফলে কালো টাকা সাদা করার উৎসাহ বেশি৷ কিন্তু এটা যদি বেশি দিন চলতে থাকে তাহলে অবৈধ আয় উৎসাহিত হবে৷ বৈধ আয়ে ২৫ ভাগ পর্যন্ত কর দিতে হয়৷ আর অবৈধ আয়ে মাত্র ১০ ভাগ৷ তাহলে যারা বৈধ আয় করেন তারাও কর না দিয়ে পরে ১০ ভাগ করের সুবিধা নেবেন৷''
নাজনীন আহমেদ বলেন, এবার সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে বাজেটে জোর দিতে হবে৷ কারণ করোনা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি৷ সামনে কী হবে তাও জানিনা৷ তার মতে, ‘‘কিন্তু এই যে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে তার সুফল মানুষ পাবে কী না৷ গতবারও বরাদ্দ বাড়ানো হয়৷ কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর দেখ গেল আইসিইউ নেই৷ থানা পর্যায়ে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়নি৷ তাই বাজেটের সঙ্গে সুশাসন ও দুর্নীতি দূর করা জরুরি৷''
করোনার টিকার জন্য এবার বাজেটে দুই ধরনের বরাদ্দ থাকছে৷ টিকা কেনার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের পাশাপাশি আরো অতিরিক্ত তিন হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ থাকছে৷ কিন্তু সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য বাজেটে আরো বেশি ব্যবস্থা দেখতে চান অর্থনীতিবিদরা৷