সাধারণ ভোটারের অধিকার হরণ করেছে সরকার
২৯ এপ্রিল ২০১৫ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় মঙ্গলবার৷ ভোট কেমন হচ্ছে, সেটা জানতে স্বাভাবিকভাবে আমারও আগ্রহ ছিল৷ সকালে কয়েক জায়গায় ফোন করেছি৷ একজন ভোটারকে পেলাম যিনি মিরপুরের একটি কেন্দ্রে সকালে ভোট দিয়েছেন৷ বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি৷ বললেন, ভোটকেন্দ্রে তেমন কোন জটিলতা দেখেননি৷ ব়্যাব সক্রিয় আছে৷ স্বাধীনভাবে ভোট দেয়া গেছে৷
ভোটারের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, তিনি সন্তুষ্ট স্বাধীনভাবে নিজের মতামত জানাতে পেরে৷ আশাবাদী তার পছন্দের প্রার্থীকে নিয়েও৷ তার সঙ্গে যারা ভোট দিতে গিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে আরো কয়েকজন ভোট দিয়েছেন৷
আশা, হতাশা
আমি নিজেও তাঁর বক্তব্যে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম৷ তবে খুব একটা সময় লাগেনি হতাশ হতে৷ ভোটাভুটির প্রথম ঘণ্টা পার হতেই বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে খবর আসতে শুরু করলো ব্যাপক অনিয়ম, জালভোট দেয়ার উৎসব শুরু হয়ে গেছে৷ সেই উৎসবে দলীয় কর্মীরা ছাড়াও নির্বাচন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশ পর্যন্ত অংশ নিচ্ছে৷ প্রথম ঘণ্টাটা সম্ভবত সুযোগ দেয়া হয়েছিল সাধারণ ভোটারদের ভোট দিতে৷ এরপর আর নিজেদের ধরে রাখতে পারেনি ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কর্মী, সমর্থকরা৷ আর তাদের ভোট ডাকাতির ছবি, ভিডিওতে এখন ফেসবুক, টুইটার সয়লাব৷
নির্বাচনে অনিয়ম, জালভোটের ব্যাপক উপস্থিতি দেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদি মঙ্গলবার টুইটারে লিখেছেন, ‘‘এটার কোন প্রয়োজন ছিল না৷ বাংলাদেশ ৩০ বছর পিছিয়ে গেল৷'' বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নি ক্যাটও টুইটারে লিখেছেন, ‘‘যে কোনো মূল্যে জেতাটা আসলে কোনো বিজয় নয়৷''
বর্তমানে ইন্টারনেট, স্মার্টফোনের যুগে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম করে তা অপ্রকাশিত রাখা কার্যত অসম্ভব৷ আমার ধারণা ছিল ক্ষমতাসীন দলের তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সেটা ভালোভাবে জানেন৷ তাদের এটাও জানা উচিত, এখন আর মানুষ শুধু প্রচলিত গণমাধ্যমের উপর নির্ভরশীল নয়৷ ফলে শুধুমাত্র গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে সবকিছু দমিয়ে রাখা যাবে না৷ তথ্য জানার জন্য ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যম জনগণের কাছে আছে৷ তবুও কেন এরকম বিপুলসংখ্যক ব্যালট পেপারে জোরপূর্বক সিল মারার ঘটনা ঘটলো? সিটি কর্পোরেশনের মতো ছোট পরিসরের একটি নির্বাচনে জয়ের জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন ক্ষমতাসীনরা? বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নজরে থাকা নির্বাচনে কেন এত অনিয়মের সুযোগ দিল সরকার?
বেপরোয়া আওয়ামী লীগ
আমার ধারণা আওয়ামী লীগের অতি আত্মবিশ্বাস তাদের এভাবে বেপরোয়া, দুঃসাহসী করে তুলেছে৷ তারা বুঝতে পেরেছে বিএনপির পক্ষে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে সরানোর মতো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশে কোন দল ক্ষমতায় আছে তা অতি গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়৷ আর যেটুকু বা উদ্বেগ তৈরি হতে পারে তা সামাল দিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারত আছে৷ বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশটির হাসিনা সরকারের প্রতি সমর্থন এখন এক প্রকাশ্য বিষয়৷
বিএনপির পক্ষে যেতে পারে এমন কিছু কিংবা হাসিনা সরকারের উপর সত্যিকারের চাপ সৃষ্টি করতে পারে এমন আর কোন শক্তি কি তাহলে নেই? অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে আরেকটি শক্তি আছে যারা প্রয়োজনে দেশের নিয়ন্ত্রণ সরাসরি বা আড়ালে থেকে নিয়ে নিতে পারে৷ বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসেও অনেকবার তারা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে৷ হ্যাঁ, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী৷
সবদিক সামাল দিয়ে চলা
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ তখন সেনাবাহিনীর মধ্যে এই নিয়ে চরম অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেসময় সেনানিবাসে গিয়ে সেনা সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তাদের শান্ত করেছেন৷ এরপর গত ছয় বছরে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷ সর্বশেষ গত কয়েক মাসেও রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাণহানি কম হয়নি৷ অতীতে দেখা গেছে, এরকম পরিস্থিতিতে দেশে শান্তি ফেরাতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে৷ কিন্তু এখন তারা পুরোপুরি নিরব কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও দিয়েছে লন্ডনের ফাইনেন্সিয়াল টাইমস৷ ২৬ এপ্রিল প্রকাশিত তাদের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘‘বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী যাতে তাদের নিরপেক্ষ মধ্যস্থের ভূমিকা পালন না করে, সেজন্য তাদের অর্থায়ন করা হয়েছে৷'' বিশ্বখ্যাত পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে গত ছয় বছরে সামরিক বাহিনীর জন্য করা বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেছে৷ বিশেষ করে তাদের বাজেট বৃদ্ধি, তাদের জন্য সমরাস্ত্র কেনার জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দ এমনকি সেনানিবাসের পরিধি বাড়ানো, বিভিন্ন খাতে ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ বাড়ানোর মতো কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাসিনা সরকার সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট রেখেছে বলেই মনে করছে পত্রিকাটি৷
পাশাপাশি আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামও, যারা কিনা ২০১৩ সালে নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ঢাকার মতিঝিলে বিপুল জনসমাগম ঘটিয়েছিল, কোন এক কারণে নিরব হয়ে গেছে৷ জামায়াতের সঙ্গে দলটির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে অনেকে বিশ্বাস করলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি কিংবা জামায়াতের কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাদের দেখা যায়নি৷ এর কিছুটা কারণ অবশ্য বোঝা যায় সাম্প্রতি ঢাকায় দুই নাস্তিক ব্লগার নিহতের ঘটনার দিকে তাকালে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য প্রবণ হলেও এই দুই ব্লগার হত্যাকাণ্ডের কোন নিন্দা, সমালোচনা করেননি৷ তাঁর এই নিরবতা কি উগ্র ইসলামিপন্থীদের শান্ত রাখতে? এই প্রশ্ন এখন অনেকের মনে৷
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা পরিষ্কার যে হাসিনা সরকার সবদিক থেকেই নিরাপদ অবস্থানে আছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাদের জবাবদিহিতার কোন জায়গা না থাকায়, বাংলাদেশ থেকে গণতান্ত্রিক ধারা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ৷ সাধারণ ভোটারদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে৷ আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে, বিভিন্ন কৌশলে বিভিন্ন শক্তিকে আয়ত্বে রাখা গেলেও ব্যালট বাক্সের সামনে একজন স্বাধীন ভোটার তাদের জন্য মোটেই নিরাপদ নয়৷ আর তাই ভোটারের ভোটের অধিকার হরণে মরিয়া তারা৷ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনেও সেটা পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে৷ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলটি এভাবে জনগণের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে৷ এমনটা মোটেই প্রত্যাশিত নয়৷