জঙ্গিবাদে জড়ানোর ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের চেয়ে সাধারণ স্কুল, কলেজের বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সংখ্যাটা বেশি৷ অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিটের গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য৷
বিজ্ঞাপন
গবেষণায় দেখা গেছে, জঙ্গিবাদে যারা জড়ায় তাদের ৫৬ ভাগ সাধারণ স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী৷ অবশিষ্ট ৪৪ ভাগের মধ্যে মাদ্রাসা থেকে ২২ ভাগ আর ইংরেজি মাধ্যম থেকে ২২ ভাগ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে৷
গবেষণাটি পরিচালনা নেতৃত্বে ছিলেন, পুলিশের অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, ‘‘২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার লোক জঙ্গি বিরোধী অভিযানে ধরা পড়ে৷ জঙ্গিবাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ৩০০ শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ করি৷ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের ভিত্তিতে সার্ভে করা হয়। তাতে দেখা যায়, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে বেশি। পরে গবেষণালবন্ধ ফলকে মিলিয়ে দেখেছি। তাতেও দেখা গেছে, নতুন যারা ধরা পড়ছে তাদের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ ভাগ বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থী।''
জঙ্গিবাদে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই বেশি জড়াচ্ছে: মনিরুজ্জামান
কারণ ব্যাখ্যায় পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, নানা হতাশা থেকেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বা অনলাইন হলো জড়িয়ে পড়ার একটি ক্ষেত্র৷ ফলে, ইন্টারনেট ব্যবহারের যাদের বেশি, তারা বেশি জড়াচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ‘‘সাধারণত বাংলা বা ইংলিশ মিডিয়ামে যারা পড়াশোনা করেন তাদের অনলাইন ব্যবহারের সুযোগ বেশি। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সেটা কম।''
গবেষণায় বলছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদে জড়িয়েছে ৮০ ভাগ৷ বাকিরা পরিচিত কারো মাধ্যমে কিংবা নিজ উদ্যোগে পা রাখছে জঙ্গিবাদে৷
সিগন্যাল, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবারের মতো মাধ্যম ব্যবহার করায় চিহ্নিত করা কঠিন: তানভীর জোহা
আইসিটি বিশেষজ্ঞ ও জঙ্গি বিষয়ক গবেষক তানভীর জোহা বলেন, ‘‘২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ফেসবুক ছিলো খেলাফত (জঙ্গিবাদ) ছড়িয়ে দেয়ার জনপ্রিয় মাধ্যম। অনেকগুলো পেজ ছিল। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অভিযানের ফলে এখানে ভাটা পড়েছে। এখন তারা এনক্রিপ্টেড প্লাটফর্মে চলে গেছে। তারা সিগন্যাল, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার ও টেলিগ্রামের মত মাধ্যম ব্যবহার করছে। আর এটা সুনির্দিষ্ট ও টার্গেটভিত্তিক। চিহ্নিত করা কঠিন।''
বলা হচ্ছে, বাংলা ও ইরেজি মাধ্যমে পড়ুয়াদের ইন্টারনেট প্রাপ্তির সুবিধাটা তুলনামূলক বেশি৷ কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরও সেই সুযোগ নেহাত কম নয়৷ স্বেচ্ছ্বাসেবী সংগঠন মুভ ফাউন্ডেশনের জরিপ বলছে, নিজস্ব কম্পিউটার না থাকলেও মোবাইল ফোন ও ট্যাবসহ নানা উপায়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ৭৫ ভাগ ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে।
জরিপের আরো জানা যায়, দিনে গড়ে দেড় ঘন্টা অনলাইনে সক্রিয় থাকে মাদ্রাসা পড়ুয়ারা৷ বাংলাদেশের ১২টি জেলার ৩৬ কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই জরিপ করা হয়। প্রতিষ্ঠান প্রধান সাইফুল হক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মাদ্রাসার নারী শিক্ষার্থীরা অনলাইনে বেশি সময় কাটান।''
ঢাকার মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক জানান, ‘‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিই না। তবে তারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাসায় মোবাইল ফোন বা কেউ কেউ কম্পিউটার ব্যবহার করে। আর তা সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারে কোনো বাধা নেই।''
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যাতে বিপদগামী না হতে পারে, সেজন্য নিয়মিত জঙ্গিবাদবিরোধী বয়ান কররার কথা জানান প্রিন্সিপাল। তিনি বলেন, ‘‘ধর্মের সাথে যে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক নেই, তা আমরা কোরান হাদিসের রেফরেন্সসহ নিয়মিত তাদের কাছে তুলে ধরি।''
স্তম্ভিত করে দেয়া গুলশান হামলা
ঘটনাটি কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়, আলোড়ন উঠেছিল দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে৷
ছবি: bdnews24.com
গুলশানে হামলা
বিশ্ব মানচিত্রে পরস্পরের সঙ্গে লাগোয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ অর্ধ শতাব্দী পূর্বে স্বাধীন হয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনায়৷ দেড় দশক ধরে নানা জায়গায় মুসলিম জঙ্গিবাদ ছড়ালেও খানিকটা যেন নিরাপদেই ছিল দেশটি৷ রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল৷ তার অনেকগুলোতে জঙ্গিদের ব্যবহারের কথাও তদন্তে উঠে আসে৷ তবে ঘোষণা দিয়ে বড় ধরণের হামলা আর হয়নি৷ এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছে গোটা দেশ৷
ছবি: bdnews24.com
যেভাবে শুরু
তখন ছিল রমজান৷ ঘটনার দিন ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে একদল অস্ত্রধারী গুলশানের একটি রেস্টুরেন্ট ঢুকে পড়ে৷ স্প্যানিশ ওই রেস্টুরেন্টটির নাম হোলি আর্টিজান৷ ঢোকার সময়ই তারা বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে৷
ছবি: bdnews24.com
জিম্মি দশা
অস্ত্রধারীরা রেস্টুরেন্টে ঢোকার পর সেখানে জিম্মি সংকট শুরু হয়৷ বাইরে চলে নানা গুজব৷ হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজন রেস্টুরেন্টকর্মী বের হয়ে আসতে সক্ষম হন৷ বাংলাদেশে এর আগে ১৯৭৭ সালে ঢাকায় আরেকটি জিম্মি সংকট ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়েছিল৷ তখন মুম্বাই থেকে টোকিওগামী একটি জাপানি বিমানের যাত্রীদের জিম্মি করে বিমানটি ঢাকায় নামিয়েছিল দেশটির বামপন্থি বিদ্রোহী দল ‘ইউনাইটেড রেড আর্মি’৷
ছবি: picture-alliance/abaca
কোথায়
অবস্থানগত কারণেও এই ঘটনা আলোচনায় ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে৷ কারণ, রেস্তোরাঁটি ঢাকার গুলশান এলাকায়৷ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস রয়েছে এই এলাকায়৷ কয়েকটি দূতাবাস তো রেস্টুরেন্টের একেবারেই কাছে৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press Agency/M. Hasan
টার্গেট বিদেশি, টার্গেট হোলি আর্টিজান
ঢাকার অভিজাত এই এলাকার রেস্টুরেন্টটিতে পোষা প্রাণী নিয়ে প্রবেশ করা যেতো৷ এর ভেতরে উন্মুক্ত লন ছিল, সেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করতে পারতো৷ ওই এলাকায় থাকা বিদেশিদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল রেস্টুরেন্টটি৷ বিদেশিদের টার্গেট করতেই এই রেস্টুরেন্টকে বেছে নেয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন৷
ছবি: bdnews24.com
প্রাণহানি পুলিশেরও
জিম্মি সংকট শুরুর পর ঘটনা সামলাতে এগিয়ে যায় পুলিশ বাহিনী৷ কিন্তু প্রথম দিকেই জঙ্গিদের হামলায় বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম প্রাণ হারান৷ এতে আতঙ্ক আরো বাড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর
পুলিশ হতাহত হওয়ার পর অভিযান নিয়ে নতুন করে চিন্তা শুরু হয়৷ এক পর্যায়ে জঙ্গিদের কবল থেকে ওই রেস্টুরেন্টটি মুক্ত করার অভিযান রাতে কার্যত স্থগিত হয়ে যায়৷ শেষ পর্যন্ত ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর৷ সাঁজোয়া যান নিয়ে সেনা সদস্যরা অভিযান পরিচালনা করেন৷
ছবি: bdnews24.com
আইএস সংশ্লিষ্টতা
রাতে জিম্মি দশা চলাকালে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আইএস হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর আসতে থাকে৷ তবে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তা অস্বীকার করে৷
ছবি: Reuters/A.Konstantinidis
কিভাবে ঘটনার শেষ
ঘটনার অবসান হয় প্রায় ১২ ঘণ্টা পর সেনা অভিযানে৷ অবশ্য তার আগেই জঙ্গিরা সেখানে থাকা ২০ জনকে খুন করে৷ মরদেহ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারির জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে৷ জীবিত উদ্ধার করা হয় এক জাপানি ও দুই শ্রীলঙ্কানসহ মোট ১৩ জনকে৷
ছবি: bdnews24.com
আলোচিত সেই বাড়ি
ঘটনার পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় গুলশানের সেই বাড়ি৷ যে রেস্টুরেন্টে হামলা হয়েছিল, তার মালিক ঘটনার পর বাড়িটি ফিরিয়ে নেন৷
ছবি: bdnews24.com
নতুন ঠিকানায় হোলি আর্টিজান
গত বছরের ১ জুলাই রাতে যখন হামলা হয়, তখন হোলি আর্টিজান ছিল গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর বাড়িতে৷ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর জানুয়ারিতে এসে গুলশান এভিনিউর র্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় নতুন করে চালু হয় রেস্টুরেন্টি৷
ছবি: bdnews24.com
জঙ্গিবাদ ও বিচার
এই ঘটনার পর আইএস দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার এর জন্য স্থানীয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবির পুনর্গঠিত একটি শাখাকে দায়ী মনে করে৷ ঘুরে ফিরে এর সঙ্গে জড়িত হিসাবে একই ব্যক্তিদের নাম আসতে থাকে৷ সরকার তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করে৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর আগাম পদক্ষেপে তাদের বহু ঘাঁটি ও অবস্থানস্থল ধ্বং হয়ে গেছে৷ সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এই ঘটনার তদন্ত শেষ করতে ৫ ব্যক্তিকে খোঁজা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
12 ছবি1 | 12
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মজিবুর রহমানের মতে, ‘‘মাদ্রাসা শিক্ষায় ধর্মীয় বিষয় স্পষ্ট, তাই তাদের বিভ্রান্ত করার সুযোগ কম। বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমে সেটা না থাকায় তাদের বিভ্রান্ত করা সহজ। তাই অ্যান্টি-টেররিজম ইউনিটের গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।'‘
তিনি বলেন, ‘‘মাদ্রাসা বা সাধারণ যে ধরনেরই শিক্ষা বলুন না কেন পাঠ্যক্রমে জঙ্গিবাদ বা জঙ্গিবাদ বিরোধী কোনো উপাদান নেই।'' সমাজে জঙ্গিবাদের উপস্থিতি থাকায়, পাঠক্রমে জঙ্গিবাদবিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা এবং সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলায় গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন অধ্যাপক মজিবুর রহমান৷