1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সাপের খেলা

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা২৬ আগস্ট ২০১৩

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মন্দির-শহর বিষ্ণুপুরে প্রতি বছর শ্রাবণ সংক্রান্তিতে হয় ঝাঁপান উৎসব, যা আদতে বিষধর সাপ নিয়ে খেলা দেখানো৷ ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই প্রথা৷

ছবি: DW/ S. Bandopadhyay

একটা গল্প প্রচলিত আছে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের আদিপুরুষ রঘু সম্পর্কে৷ বালকবয়সে পালক-পিতার গরু চরাতেন রঘু৷ একদিন ক্লান্ত হয়ে মাঠের ধারে, আলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন৷ সেইসব তাঁর পালক-পিতা দেখেন, অতিকায় এক মহাসর্প তার বিশাল ফনা রঘুর মাথার উপর তুলে পাহারা দিচ্ছে৷ সেই থেকেই নাকি বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবংশের রক্ষক হল সাপ৷ আর ঐতিহাসিকরা বলেন, অধুনা ঝাড়খণ্ডের রাঁচির কাছে রামগড়ে যে নাগ বংশীয় ক্ষত্রিয়দের বাস ছিল বলে জানা যায়, সম্ভবত তাদেরই কেউ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে এসে রাজত্ব শুরু করেছিলেন৷ নাগদেবী মনসার আরাধনা বিষ্ণুপুরে সেই তখন থেকেই, যা একসময় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করে এসেছে৷ ৫০০ বছর পরেও বিষ্ণুপুরে মনসাপুজো এবং সেই উপলক্ষ্যে সাপখেলা চালু আছে, যা ঝাঁপান নামে পরিচিত৷

ঝাঁপান উৎসব যতটা না ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, তার থেকে বেশি একটি লোকায়ত প্রথাছবি: DW/ S. Bandopadhyay

সাপের খেলা দেখাবার নাম ঝাঁপান কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে বাঁকুড়া জেলা সংগ্রহশালার বর্তমান সম্পাদক এবং রাঢ় বাংলার প্রত্মতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ শ্রী চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত বললেন, পুরাকালে সাপুড়ে এবং গুণিনরা তাদের ভক্তদের কাঁধে বওয়া চতুর্দোলায় চড়ে সাপের খেলা দেখাতে আসতেন৷ এই ধরনের মনুষ্যবাহিত যানকে বলা হতো যাপ্যযান, যার থেকে ঝাঁপান শব্দটি এসেছে৷ তবে শ্রী দাশগুপ্ত স্মরণ করিয়ে দিলেন, এই ঝাঁপান উৎসব যতটা না ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, তার থেকে বেশি একটি লোকায়ত প্রথা৷ জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ থেকে একেবারে আশ্বিন-কার্তিক মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ যতদিন শস্যক্ষেতে চাষের কাজ চলে, ততদিন ধরে মনসাপুজো চলে৷ একটাই কারণে, যাতে কৃষিকাজ করতে গিয়ে সাপের কামড়ে প্রাণ না যায়৷

উৎসবে আগত দর্শণার্থীছবি: DW/ S. Bandopadhyay

বিষ্ণুপুরে যেমন মনসাপুজো এবং ঝাঁপানে সামিল হয় ক্যাওট বা অন্ত্যজ শ্রেণির কৈবর্ত্য সম্প্রদায়৷ দু'ধরনের ক্যাওট হয়৷ হালি ক্যাওট, যাঁরা হাল চাষ করেন, আর জালি ক্যাওট অর্থাৎ যাঁরা জাল দিয়ে মাছ ধরেন৷ বর্ষাকালে এদেরই সাপের কামড় খাওয়ার ভয় সব থেকে বেশি৷ কিছুটা যেন সাহস জোগাতেই সাপুড়েরা শ্রাবণসংক্রান্তিতে একটা উৎসবের পরিবেশে সাপ নিয়ে খেলা দেখান৷ আগে নিয়ম ছিল, ঝাঁপানের শুরুতে সাপুড়েদের কোনও একটা দল রাজবাড়ি গিয়ে রানিমাকে সর্পদর্শন করাবে৷ এখানেও লুকিয়ে আছে উপ-মহাদেশে প্রচলিত ফার্টিলিটি কাল্ট বা প্রজনন সংস্কৃতি-জাত একটা বিশ্বাস যে সাপ হল ফলন, বংশ বিস্তারের প্রতীক৷ সে কারণে বিষ্ণুপুরের রাজা নন, বরং রাজমহিষী ঝাঁপানে প্রথম সাপ দেখার সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন৷

৫০০ বছর পরেও বিষ্ণুপুরে মনসাপুজো এবং সেই উপলক্ষ্যে সাপখেলা চালু আছে, যা ঝাঁপান নামে পরিচিত৷ছবি: DW/ S. Bandopadhyay

এখন আর রাজার শাসন নেই, রাজপরিবারও নেই৷ কিন্তু রাজদরবার ছিল যে জায়গায়, সেখানে গিয়ে প্রথম খেলা দেখাবার রেওয়াজটা এখনও চালু আছে৷ বিষ্ণুপুরেই দুটি দল আছে, যারা নিয়মিতভাবে এই ঝাঁপানে অংশ নেয়৷ কিন্তু ওরা ছাড়াও বাঁকুড়ারই হেতিয়া এবং পুরুলিয়ার অযোধ্যা থেকে সাপুড়েদের দল আসত একটা সময়৷ কিন্তু এখন যেহেতু সব কিছুরই খরচ বেড়েছে, সাপুড়েদের আর্থিক দাবিও বেড়েছে৷ অবশ্য সাপুড়ে বৃত্তিও এখন আর কেউ নিতে চায় না৷ সারা বছর অন্যান্য চাষ-বাসের কাজ করার পর ঝাঁপানের সময় খেলা দেখাতে আগ্রহও খুব একটা নেই৷ কারণ সেভাবে কোনও রোজগার হয় না ঝাঁপান থেকে৷

পশ্চিমবঙ্গের মন্দির-শহর বিষ্ণুপুরে প্রতি বছর শ্রাবণ সংক্রান্তিতে হয় ঝাঁপান উৎসবছবি: DW/ S. Bandopadhyay

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকসংস্কৃতি দপ্তর থেকে নামমাত্র একটা অর্থসাহায্য চালু ছিল, কিন্তু গত বছর থেকে সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ আপাতত একটা লটারির আয়োজন করে কিছু টাকা তোলেন উদ্যোক্তারা, কিন্তু সেটাও যথাযথ আইনি অনুমোদন নিয়ে নয়৷ ফলে এক ধরনের সংকটেই পড়েছে বিষ্ণুপুরের অর্ধ সহস্র বছরের পুরনো এক লৌকিক প্রথা তথা উৎসব৷ এমন হতেই পারে যে হয়ত পরের বছর থেকেই বন্ধ হয়ে গেল ঝাঁপান এবং একদিন হারিয়ে গেল ইতিহাসের পাতা থেকেও৷ প্রবীণ মানুষরা এখনই আফশোস করেন, আগেকার সাপুড়েদের দক্ষতা আর খেলা দেখাবার চমৎকারিত্ব আর দেখা যায় না৷ এবং যেহেতু সাপুড়ে-বৃত্তি বংশ পরম্পরা ধরে চলে আসে, কোথাও তা শেখার ব্যবস্থা নেই, খুব শিগগিরি এই পেশাও হয়ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সমাজ থেকে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ