ঘটনাটা ঘটে ১৯৪৪ সালে, মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে৷ হাঙ্গেরি থেকে অন্তত ৪ লাখ ২৫ হাজার ইহুদিকে পোল্যান্ডের কুখ্যাত সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় নাৎসিরা৷ সাবেক নাৎসি সদস্য অস্কার গ্র্যোনিং এ কাজে সাহায্য করেছিলেন বলে অভিযোগে৷ জানা গেছে, এঁদের মধ্যে ৩ লাখ মানুষকে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে হত্যা করা হয়, অর্থাৎ হলোকস্ট বা ইহুদি নিধনযজ্ঞের বলি হন তাঁরা৷
হানোফারের উত্তরাঞ্চলের একটি শহরে অস্কার গ্র্যোনিং-এর বিচার কাজ চলছে৷ সেখানে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা বলেন, অস্কারের প্রধান কাজ ছিল যাঁদের হত্যা করা হয় তাঁদের সব জিনিস সরিয়ে রাখা, যাতে নতুন বন্দিদের তা চোখে না পড়ে৷ এছাড়া বন্দিদের কাছে থাকা অর্থ ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করে তা বার্লিনে নাৎসি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোও ছিল তাঁর অন্যতম কাজ৷
মিউনিখের এক ফ্ল্যাটে ইউরোপীয় শিল্পীদের আঁকা ১,৪০০ অমূল্য ছবির সন্ধান পাওয়ার পর গত বছর আলোচনায় আসেন কর্নেলিয়াস গুরলিট, যাঁর বাবা হিল্ডেব্রান্ড গুরলিট ছিলেন নাৎসি আমলের আর্ট ডিলার৷ গত মঙ্গলবার ৮১ বছর বয়সে মারা গেছেন তিনি৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpaড্রেসডেনের শিল্পী উইলহেল্ম লাখনিট (১৮৯৯-১৯৬২) জলরংয়ে ‘ম্যান অ্যান্ড উইমেন ইন দ্য উইনডো’ আঁকেন ১৯২৩ সালে৷ নাৎসি প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী ইওসেফ গ্যোবেল্সের নির্দেশে অন্য অনেক ছবির সঙ্গে এ ছবিটিও ‘অধঃপতিত’ ঘোষণা করে সংগ্রহশালা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa‘যুগল’ শিরোনামে জলরংয়ের এই ছবিটি হান্স ক্রিস্টফ (১৯০১-১৯৯২) এঁকেছিলেন ১৯২৪ সালে৷ সে সময় তিনি খুব বেশি পরিচিতি না পেলেও এখন উইলহেল্ম লাখনিট, ওটো গ্রিবেল, ওটো ডিক্সের মতো শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpaক্রিস্টফ ফল (১৮৯৭-১৯৩৯) সেই বিংশ শতকের গোড়ার দিকেই ভাস্কর্য আর ছবির জন্য খ্যাতি পান৷ কিন্তু নাৎসি সরকারের কোপে পড়ে তাঁর ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে, কারণ তাঁদের বিচারে এসব শিল্পকর্ম ছিল অ-জার্মান৷ ‘মংক’ ছবিটি তিনি আঁকেন ১৯২১ সালে৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa (Ausschnitt)ব্যার্নহার্ড ক্রেচমারও (১৮৮৯-১৯৭২) ছিলেন ড্রেসডেনের শিল্পী৷ জলরংয়ে ‘ট্রাম’ ছবিটি তিনি কবে এঁকেছিলেন, তার সঠিক তারিখ জানা যায় না৷ তাঁর আঁকা বহু ছবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘অধঃপতিত’ আখ্যা দিয়ে গ্যালারি থেকে সরিয়ে নেয়া হয়৷ ১৯৪৫ সালে ড্রেসডেনে ‘মিত্রবাহিনীর’ বোমা হামলায় তাঁর বহু শিল্পকর্ম ধ্বংস হয়ে যায়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpaওটো গ্রিবেল (১৮৯৫-১৯৭২) জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির জন্য লিফলেট ও পোস্টার তৈরি করতেন৷ সামরিক বাহনীর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন ছবি এঁকেও৷ স্বাভাবিকভাবেই এসব কাজ নাৎসি নেতাদের পছন্দ হয়নি৷ সে সময় ওটো গ্রিবেলের আঁকা বহু ছবি ধ্বংস করে ফেলা হয়৷ তবে ‘চৌপায়ায় শিশু’ শিরোনামের এই ছবিটি কোনোভাবে রক্ষা পেয়ে যায় এবং বহু বছর পর এর সন্ধান মেলে কর্নেলিয়াস গুরলিটের গোপন সংগ্রহশালায়৷
ছবি: picture-alliance/AP(Ausschnitt)বাঁয়ের ছবিতে দেখা যাচ্ছে অগাস্ট রঁদার (১৮৪০-১৯১৭) একটি ড্রয়িং৷ ডানে ওটো ডিক্সের (১৮৯১-১৯৬৯) আঁকা ‘দ্য ফিমেল লায়ন ট্যামার’৷ ওটো ডিক্স ছিলেন নাৎসি আমলের একজন প্রতিবাদী কণ্ঠ, যিনি সেই সময়ের বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন তুলির রূঢ় আঁচড়ে৷ ১৯৩৪ সালে ওটো ডিক্সের ছবি প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷ বিভিন্ন জাদুঘর থেকে তুলে নেয়া হয় তাঁর আঁকা শতাধিক ছবি৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa (Ausschnitt)ওটো গ্রিবেল ও ওটো ডিক্সের মতো ড্রেসডেনের শিল্পী কনরাড ফেলিক্সম্যুলারও ছিলেন নাৎসি কর্মকাণ্ডের একজন কড়া সমালোচক৷ এ কারণে তাঁকেও রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হয়৷ ‘রিয়েলিস্ট’ ধারার এই শিল্পী ‘কাপল ইন দ্য ল্যান্ডস্কেপ’ ছবিটি আঁকেন ১৯২৪ সালে৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa (Ausschnitt)ইটালির শিল্পী আন্তোনিও কানালেত্তো (১৬৯৭-১৭৬৮) চিত্রকলার ইতিহাসে বিখ্যাত তাঁর আঁকা ল্যান্ডস্কেপের জন্য৷ এ সব ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তিনি ‘ক্যামেরা অবসকিউরা’ নামের একটি যন্ত্র ব্যবহার করতেন, যা আধুনিক ক্যামেরার পূর্বসূরি৷ তাঁর করা এই ছাঁপচিত্রটি পাওয়া গেছে কর্নেলিয়াস গুরলিটের সংগ্রহশালায়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpaফ্রান্সে রোমান্টিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পী ইউজিন দেলাক্রোয়ার (১৭৯৮-১৮৬৩) ছাঁপচিত্রগুলো তাঁর জিবদ্দশাতেই দারুণভাবে আলোচিত হয়৷ ইতিহাস বা পুরাননির্ভর ছবি, স্টিল লাইফ ও পোর্ট্রেট – সবই তিনি করেছেন৷ কর্নেলিয়াস গুরলিটের ফ্ল্যাটে পাওয়া শিল্পকর্মের মধ্যে দেলাক্রোয়ার এই পেনসিল স্কেচটিও ছিল৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa আইনজীবীরা আরো বলেন, অস্কার গ্যাস চেম্বারে ঐ নীরিহ মানুষদের হত্যার ব্যাপারে অবগত ছিলেন৷ তাই স্থানীয় আদালত এখন সিদ্ধান্ত নেবে তাঁর বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হবে কিনা৷
জার্মানির যে অফিস নাৎসিদের হত্যাযুদ্ধ বা ইহুদি নিধনযজ্ঞ নিয়ে তদন্ত করছে, সেই অফিস গত বছর ৩০ জন সাবেক নাৎসি সদস্যকে সমন পাঠিয়েছিল৷ এঁদের ৩০ জনই নাকি আউশভিৎসের মৃত্যু শিবিরে কাজ করতেন৷
গত ৬০ বছর ধরে জার্মানির আদালতগুলো নাৎসি নৃশংসতার সাথে এই ব্যাক্তিরা সরাসরি জড়িত কিনা –তার তথ্য-প্রমাণ নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে৷ তবে ২০১১ সালে নাৎসি ক্যাম্পগার্ড ইয়ন ডেমইয়ানইয়ুককে
পোল্যান্ডের অপর এক বন্দি শিবির সোবিবরে ২৭,৯০০ ইহুদির হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করার জন্য মাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয় মিউনিখ আদালত৷
আউশভিৎস ‘ডেথ ক্যাম্পে' প্রায় ১১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ৷ এছাড়া ঐ ক্যাম্পে পোলিশ, রোমা, সোভিয়েত যুদ্ধবন্দি ছিলেন, যাঁদের সকলকেই হত্যা করা হয়৷ ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি পর্যন্ত ঐ ক্যাম্পে হত্যাযজ্ঞ চলে৷
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই নাৎসিদের স্বরূপ স্পষ্ট হতে শুরু করে৷ বিশেষ করে ইহুদি-বিদ্বেষ ধাপে ধাপে মারাত্মক রূপ নেয়, যার পরিণতি সুপরিকল্পিত ইহুদি নিধনযজ্ঞে, যার ফলে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বা অন্যভাবে খুন করা হয়৷
এপিবি/ডিজি (এপি, এএফপি, ডিপিএ)