গ্রীষ্মের শুরুতেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে পানির সংকট৷ নদী থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশে সচেতনতার অভাব এই সংকটকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা উঠে এসেছে ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলির আলোচনায়৷
বিজ্ঞাপন
সামহয়্যার ইন ব্লগে শাহ আজিজ লিখেছেন, ‘‘গত কদিন দেখছি ঢাকার কাটাশুরের একাংশে একটি পানির গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে আর আশেপাশের লোকজন বড় ড্রাম থেকে শুরু করে বদনা পর্যন্ত ভরে নিচ্ছেন৷ এই পানি দিয়ে রান্নাবান্না, হাত-মুখ ধোয়া, পায়খানা এবং মেপে মেপে পান করতে হবে৷ এই অব্যবস্থা স্থায়ী হয়ে গেছে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে এবং এর স্থায়ী কোনো সমাধান নেই, নেই কোনো উদ্যোগ৷''
পানির অপচয় রোধের দশ উপায়
পানির আরেক নাম জীবন৷ অথচ এই পানি, বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানি ক্রমশ কমে যাচ্ছে৷ যা জীবনের জন্য এক হুমকি৷ এই হুমকি মোকাবিলায় সচেতন হতে হবে আপনাকেও৷ চলুন জেনে নেই পানির অপচয় রোধের দশ উপায়৷
ছবি: Fotolia/Valua Vitaly
এক কাপ কফি তৈরিতে ১৪০ লিটার পানি!
আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য বা পানীয় তালিকার কিছু পণ্য তৈরিতে অনেক পানি প্রয়োজন হয়৷ যেমন এক কাপ কফি বাগান থেকে আপনার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ হচ্ছে ১৪০ লিটার পানি৷ আর এক লিটার দুধের পেছনে ব্যয় ১,০০০ লিটার পানি৷ তাই এ সব পানীয়র অপচয় কমানোর মাধ্যমে পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Fotolia/dmitrimaruta
মাংস খাওয়া কমাতে পারেন
ওয়াটারফুটপ্রিন্ট ডটঅর্গ-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এক কেজি মাংস উৎপাদনে সবমিলিয়ে খরচ হয় ১৫ হাজার লিটারের মতো পানি৷ এই হিসাবের মধ্যে পশুর জন্ম এবং বেড়ে ওঠার সময় প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণও বিবেচনা করা হয়েছে৷ এবার ভেবে দেখুন, এক বেলা মাংস না খেয়ে কতটা পানি বাঁচানো সম্ভব?
ছবি: picture-alliance/dpa
পানির ট্যাপের দিকের নজর রাখুন
মুখ ধোয়া বা দাঁত ব্রাশ করার সময় পানির ট্যাপ বন্ধ রাখুন৷ একান্ত যদি গরম পানি পেতে ট্যাপ একটু খুলে রাখতে চান, তাহলে সেই পানি ব্যবহার করতে পারেন ব্রাশ ধোয়ার কাজে৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
কাপড় বা থালাবাসন পরিষ্কারে সতর্ক হন
কাপড় ধোয়া বা থালাবাসন পরিষ্কারের মেশিন এখন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে৷ পুরোপুরি ভর্তি না হওয়া অবধি এ সব মেশিন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন৷
ছবি: Fotolia/lightpoet
অপ্রয়োজনে ফ্লাশ নয়
অনেকেই যখন-তখন টয়লেট ফ্লাশ করে থাকেন৷ এতে প্রচুর পানি অপচয় হয়৷ তাই একান্ত প্রয়োজন না হলে ফ্লাশ করা থেকে বিরত থাকুন৷
ছবি: by-studio - Fotolia.com
পুকুরে ময়লা ফেলা নয়
বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ সুযোগ পেলেই পুকুর বা খালে ময়লা ফেলে৷ এতে করে পানি দূষিত হয়৷ আর দূষিত পানি পুনরায় পান উপযোগী করে তুলতে খরচ হয় প্রচুর অর্থ এবং বিদ্যুৎ৷ তাই পুকুরে বা খালে ময়লা না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে বা মাটিতে গর্ত করে ময়লা ফেলুন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
পানির পাইপের দিকে নজর দিন
অনেক সময় পানির পাইপে থাকা বিভিন্ন জোড়া হালকা হয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি বাইরে পরে যায়৷ একটু সতর্ক হলেই এভাবে পানির অপচয় রোধ করা যায়৷ এছাড়া ছাদের ট্যাংকি ভর্তি হয়ে যাতে পানি বাইরে পরে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখুন৷ সময়মতো পানির পাম্প বন্ধ করে দিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গোসলের সময় অপচয় নয়
বাথরুমে থাকা গতানুগতিক বা পুরনো পানির ঝরনাগুলো সরিয়ে ফেলুন৷ বর্তমানে বাজারে পানি সাশ্রয়কারী ঝরনা পাওয়া যায়৷ সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে ২০ থেকে ৬০ শতাংশ পানির অপচয় রোধ সম্ভব৷ আর গোসলের সময় প্রস্রাব করার অভ্যেস তৈরির মাধ্যমে দিনে অন্তত একবার ফ্লাশ করার পানি বাঁচানো সম্ভব৷
ছবি: Fotolia/Valua Vitaly
পানি কখনো ফেলে দেবেন না
পানি পান করার পর যদি গ্লাসের তলায় খানিকটা পানি থেকে যায়, তাহলে তা ফেলে দেবেন না৷ সেটুকু আপনার গাছের গোড়ায় ঢালতে পারেন কিংবা চায়ের কেটলিতে জমাতে পারেন৷
ছবি: mdxphoto - Fotolia.com
সম্ভব হলে বৃষ্টির পানি জমা করুন
বৃষ্টির পানি জমা করে তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার এমনকি পান করাও সম্ভব৷ বর্তমানে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের বিভিন্ন সরঞ্জামও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে৷ মনে রাখবেন, আপনার সামান্য উদ্যোগ পানির অপচয় রোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারে৷ তাই চেষ্টা করে দেখুন না!
ছবি: DW/Karin Jäger
10 ছবি1 | 10
একই ব্লগে মোস্তফা কামাল পলাশ লিখেছেন, টাইম মেশিনে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়টিতে ফেরার সুযোগ থাকলে তিনি পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও প্রকৌশল বিষয়ে লেখাপড়া করতেন৷ এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের পানি সংকটের বিভিন্ন দিক তুলে এনেছেন৷
তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে প্রবেশের ঠিক আগ মুহূর্তে ভারত সরকার অন্তর্জাতিক নদীতে বাধ দিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহার করছে শুষ্ক মৌসুমে পশ্চিমবঙ্গে সেচ কাজের জন্য৷
বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে পলাশের লেখায় বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে খাবার পানির ৯৭ শতাংশ ও চাষাবাদের ৮০ শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে আসে৷ পৃথিবীর মোট ব্যবহৃত ভূ-গর্ভস্থ পানির শতকরা ৩৫ ভাগ ব্যবহার করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল৷
বাংলাদেশ গত ২০ বছরে খদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে তার অন্যতম করণ হলো শুকনো মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি-মে) অগভীর ও গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচের মাধ্যমে বোরো ধান উৎপাদন৷
‘‘অপরিকল্পিতভাবে ব্যাপক পরিমাণে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে বোরো ধান চাষ করার ফলে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি যেটা আমাদের জন্য সু-সংবাদ, কিন্তু দুঃসংবাদ হলো আমরা ক্ষতি করেছি আমাদের ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিমাণের৷ প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে যে পরিমাণ পানি মাটির নিচে জমা হয় তার চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি আমরা মাটির নিচ থেকে তুলে থাকি কৃষিকাজের জন্য৷''
পানি পরিশোধনের সহজ পদ্ধতি
04:40
পলাশ লিখেছেন, গত ২০-৩০ বছর ধরে গভীর নলকূপের মাধ্যমে চাষাবাদের পানি তুলতে গিয়ে নদীর পানিও টেনে নেয়া হচ্ছে৷ ফলে নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ছে এবং শুকনো মৌসুমে গ্রাম-বাংলার জলাভূমি ও পুকুরগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে৷
তিনি মনে করেন, বুড়িগঙ্গা নদীর তলায় কি পরিমাণ ‘হেভি মেটাল' জামা হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি নদীর তলা পরীক্ষা করে বলা সম্ভব নয়৷ বুড়িগঙ্গা নদীর তলা থেকে দূষিত পদার্থ কি পরিমাণে ও কত দিনে ঢাকা ওয়াসার নলকূপে পৌঁছাতে পারে তা জানতে দরকার বৈজ্ঞানিক গবেষণা৷ গবেষণার জন্য দকরার অর্থ ও যোগ্য মানব সম্পদ৷ ... এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট/ইঞ্জিনিয়ারিং' বিষয় চালু করে নদী ও পানি সম্পদ নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন৷
প্লাস্টিকের পানির বোতলের জীবন
সারা বিশ্বে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ বোতল পানি বিক্রি হয়৷ কিন্তু পানি পান করার পর প্লাস্টিকের ঐ বোতলগুলোর কী হয় তা কি জানেন? ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত৷
ছবি: Fotolia/zhekos
প্লাস্টিকের দামই বেশি
এক বোতল পানি কেনার জন্য আপনি যে দাম দেন তার বেশিরভাগই কিন্তু চলে যায় প্লাস্টিকের জন্য৷ এছাড়া রয়েছে বোতলের গায়ে লেবেল লাগানো, পরিবহণ, সংরক্ষণ ও বোতল নষ্ট করে ফেলার খরচ৷
ছবি: Fotolia/fottoo
তেলের ব্যবহার
অশোধিত তেল দিয়ে তৈরি হয় পলিইথিলিন টেরেফথালেট (পিইটি) প্লাস্টিক৷ এরপর সেটা দিয়েই তৈরি হয় প্লাস্টিকের বোতল৷ এই তেল উৎপাদনের সময় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়৷ এছাড়া প্লাস্টিক তৈরির সময় বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ ছবিতে জার্মানির সবচেয়ে বড় তেলশোধন প্ল্যান্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বড়ি থেকে বোতল
পরিশোধিত তেল থেকে প্রথমে প্লাস্টিকের এমন ছোট ছোট বড়ি তৈরি করা হয়৷ এরপর সেগুলোকে গলিয়ে বোতল তৈরি করা হয়৷
ছবি: Fotolia/digitalstock
চারে এক
আর্থ পলিসি ইনস্টিটিউটের হিসেবে সারা বিশ্বে উৎপাদিত চারটি পানির বোতলের অন্তত একটি ক্রেতার খোঁজে কমপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে৷ অর্থাৎ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়৷ এভাবে পানি পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত যানবাহন থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পানি সংকট
প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের হিসেবে এক বোতল পানির জন্য তিনগুণ বেশি পানি খরচ হয়৷ ফলে যে অঞ্চলে পানির ফ্যাক্টরি অবস্থিত সেখানকার ভূগর্ভে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মাত্র অর্ধেক
এক হিসেবে জানা গেছে, ইউরোপে গত বছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল রিসাইকেল করা হয়৷ পরিমাণটা, যত বোতল ব্যবহৃত হয়েছে তার অর্ধেকের কিছু বেশি৷ বাকি বোতলগুলো বিভিন্ন জায়গায় জমে গিয়ে বিশেষ করে জলাধার ও সাগরে পড়ে গিয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে৷
ছবি: JOSEPH EID/AFP/Getty Images
রিসাইক্লিং
ব্যবহার হওয়ার পর পানির বোতলগুলো রিসাইকেল করে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়৷ যেমন এক ধরণের পশম, যেটা শীতবস্ত্র জাতীয় পোশাক তৈরিতে কাজে লাগে৷
ছবি: Fotolia/zhekos
7 ছবি1 | 7
তাছাড়া পানি দূষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে গণমাধ্যমেও ব্যাপক প্রচারণা দরকার বলে পলাশ মনে করেন৷
তাঁর এই লেখার প্রতিক্রিয়ায় আশিক হাসান লিখেছেন, ‘‘অভিন্ন নদী নিয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলোর পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে লাভের লাভ কিছুই হয়নি বরং ভারত কালক্ষেপণ করে শুধু নিজের পরিকল্পনামাফিক বাঁধ তৈরি করে গেছে যত্রতত্র৷ বাংলাদেশের কোনো আপত্তির মুখে তাঁরা তাঁদের কাজ বন্ধ করেনি৷ ভারতে কোন দল সরকার গঠন করলো তা নিয়ে আমরা হাজার অঙ্ক কষলেও কোনো লাভ নেই, কারণ ভারতের পররাষ্ট্রনীতি দলনির্ভর নয়, বরং রাষ্ট্রের স্বার্থনির্ভর৷''
তিন মনে করেন, সমুদ্রসীমা নিয়ে যেভাবে আন্তজার্তিক আদালতে বিরোধ মীমাংসা হয়েছে, সেভাবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়েও সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে৷
মুহাম্মদ এরশাদুল করিম একই লেখার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘‘মালয়েশিয়াতে বৃষ্টির পানি ব্যবহৃত হয়৷ অনান্য উন্নত দেশেও তাই৷ মালয়েশিয়াতে গত প্রায় দুইমাস ধরে পানির সমস্যা চলছিল, কারণ বৃষ্টি ছিল না আর প্রচণ্ড গরমের কারণে সরকার পানি দিতে পারছিল না৷ তখন রেশনিং করে চলেছে৷...তখন বুঝতে পারছিলাম কী ভয়াবহ সময় সামনে আসছে৷''