ঢাকার যানজট নিয়ে নানা কথা হয়েছে, হয়েছে গবেষণা আর যানজট কমাতে হয়েছে মহাপরিকল্পনাও৷ আগে বলা হতো ফ্লাইওভার নির্মাণ করলেই যানজট কমবে৷ কিন্তু না, তেমনটা হয়নি৷ তাই এবার যানজট কমাতে ঢাকার সড়কে করা হচ্ছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা৷
বিজ্ঞাপন
গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের গবেষণা তুলে ধরা হয়৷ সেই গবেষণায় জানানো হয় যে, ঢাকায় শুধু যানজটের কারণে প্রতিবছর ক্ষতি হয় অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা৷ ঢাকায় এখন আর কোনোমতেই ঘণ্টায় গড়ে সাত কিলোমিটারের বেশি গতি পায় না যন্ত্রচালিত যানবাহন৷ বিশ্লেষকদের কথায় অবশ্য এই গতি গড়ে ছয় কিলোমিটারের বেশি হবে না৷ বলা বাহুল্য, এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ চার কিলোমিটারের বেশি গতিতে ছুটতে পারবে না যানাবাহন৷ এই যে গতির হিসাব, তাতে এখনই যানবাহনের চেয়ে পায়ে হেঁটে আগে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়৷ তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সামনে কি এক স্থবির ঢাকা অপেক্ষা করছে?
সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকায় যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ প্রাইভেট কার৷ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসেবে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় বাস ও মিনিবাসের চেয়ে সাত গুণ বেশি চলেছে প্রাইভেট কার৷
‘এখানে নিয়ম না মানার শীর্ষে প্রাইভেট কার, তারা ইচ্ছে মতো চলাচল করে’
‘২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার উন্নয়ন সম্ভাবনা' শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেছেন, ‘‘১০ বছর আগেও ঢাকায় যানবাহনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার৷ এখন সেই গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারেরও কম৷ যে হারে ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আর ক'বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি কার্যত নাগালের বাইরে চলে যাবে৷' আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মেলনে যানজট নিরসনে মাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি), বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা জানানো হয়৷
বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, ঢাকার এখনকার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ৷ ২০৩৫ সালে তা দ্বিগুণ হয়ে সাড়ে ৩ কোটি হবে৷
যোগাযোগ মন্ত্রীর সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থ বছরে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ১৮টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়৷ গত ৩১ মে পর্যন্ত ঢাকায় মোট গাড়ির সংখ্যা ১১ লাখ ২৫ হাজার৷ তবে ২০১৫ সালে সংসদে দেয়া তথ্য মতে, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে নতুন গাড়ি নামছে ৩১৭টি৷ এরমধ্যে ৫৩টি প্রাইভেট কার৷
ঢাকা শহরে বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, হিউম্যান হলার, অটোরিকশা, মটর বাইক ও ট্রাকসহ নানা যান্ত্রিক যানবাহন একসঙ্গে চলে৷ এর সঙ্গে আছে রিকশা, ভ্যান ও সাইকেলের মতো নানা অযান্ত্রিক যানবাহনও৷ এমনকি ঢাকার কিছু এলাকায় এখনো চলে ঘোড়ার গাড়ি৷
রাস্তায় নৈরাজ্য, যেন আইন ভাঙার হিড়িক
১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা৷ শুধু রাজধানীই নয়, দেশের আইন-শাসন-বিচার বিভাগ এখান থেকেই পরিচালিত হয়৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্যসহ নানা কাজের কেন্দ্রও এটাই৷ অথচ কোনো সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই ঢাকায়৷
ছবি: bdnews24.com
উলটো পথে চলাচল
ঢাকা শহরে নানা ট্রাফিক অব্যবস্থপনার মধ্যে উলটো পথে চলা অন্যতম৷ বাইকার, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ভিআইপি – অনেকেই নিজের তাড়াতাড়ি যাওয়া নিশ্চিত করতে উলটো পথে গাড়ি ছোটান৷ তাতে আরো বেশি বিড়ম্বনায় পড়েন রাস্তায় নামা সাধারণ মানুষ৷
ছবি: bdnews24.com
বেপরোয়া ড্রাইভিং
এমনিতে হয়ত যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অনেক গাড়িকে৷ তবে রাস্তা ফাঁকা পেলে যেন দেরি সয় না অনেক চালকের৷ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে দেন তাঁরা৷ এর ফলে অনেক সময়ই প্রাণ যায় মানুষের৷ প্রিয়জন হারানোর আহাজারিতে ভারী হয় আকাশ বাতাস৷ কেবল ঢাকার রাস্তাতেই প্রতি বছর কয়েক শত মানুষের প্রাণ যায়৷
ছবি: bdnews24.com
যত্রতত্র পার্কিং
ঢাকা মহানগরের সড়কগুলো আর যাই হোক, বিপুল পরিমাণ মানুষ আর যান বাহনের চাপ সামলানোর মতো নয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত৷ সরু সেই সব রাস্তার অবস্থা আরো করুণ হয়ে যায়, যখন যত্রতত্র পার্কিংয়ে এই রাস্তা আরো সরু হয়ে যায়৷
ছবি: bdnews24.com
অননুমোদিত ড্রাইভিং
গত মে মাসে এক স্কুলছাত্র এই গাড়িটি নিয়ে বের হয়ে পড়ে রাস্তায়৷ অননুমোদিত এই ড্রাইভিংয়ে আহত হয় আরেক শিশু৷ অবৈধ ড্রাইভিংয়ে কেবল শিশু নয়, বড়রা জড়িয়ে পড়েন৷ লাইসেন্স ছাড়াই অনেকে নেমে পড়েন রাস্তায়৷ লাইসেন্স থাকলেও মাদক গ্রহণের পর, শারিরীক বা মানসিকভাবে অনুপযুক্ত অবস্থায়ও গাড়ি চালানো আইনে নিষেধ৷ সড়কে বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালানো, রেসে অংশ নেয়াও নিষিদ্ধ৷ বীমার বাধ্যবাধকতাও অনেকে মানেন না৷
ছবি: bdnews24.com
উলটো পথে চললে চাকা ফুটো
উলটো পথে গাড়ির চলাচল বন্ধ করতে একটি যন্ত্র বসিয়েছিল ট্রাফিক পুলিশ৷ কথা ছিল গাড়ি উলটো পথে চললে তাতে চাকা ফুটো হয়ে যাবে৷ কিছুদিন পর এই যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়৷ ঢাকা শহরের গাড়িকে স্বয়ংক্রিয় সংকেত বাতির উপর নির্ভরশীল করে দিতে সর্বশেষ ২০১৫ সালে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়৷ কিন্তু পুলিশের অসহযোগিতায় সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে৷ এই শহরে ট্রাফিক আইন ভাঙা মামলাও হয় গতানুগতিকভাবে, হাতে লিখে৷
ছবি: bdnews24.com
যত্রতত্র পথচারীদের চলাচল
ঢাকার রাস্তায় আরেক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে খোদ পথচারীরাই৷ নির্ধারিত জায়গার পরিবর্তে যেখানে সেখানে রাস্তা পার হয়ে যান তাঁরা৷ রাজধানীতে পথচারীদের আইন না মানার প্রবণতাও এখানকার দুর্ঘটনার একটা কারণ৷
ছবি: bdnews24.com
আইন প্রয়োগে ফাঁকি
ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে নানা আইন থাকলেও, সেটা প্রয়োগে ফাঁকি রয়েছে৷ প্রায়ই খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক সদস্যকেই আইন ভাঙতে দেখা যায়৷ লেগুনা নামের এই ‘আনফিট’ গাড়ি ব্যবহার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷
ছবি: bdnews24.com
ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্য
রাজধানী ঢাকায় যে সব গাড়ি চলে তার অধিকাংশই ব্যক্তিগত৷ এ সব গাড়িকে যত্রযত্র যানজট সৃষ্টির জন্যও দায়ী করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গণপরিবহনে নৈরাজ্য
ঢাকার সমস্যা গণপরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য৷ মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব তো রয়েছেই৷ যে গাড়িগুলো রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল৷ যেখানে সেখানে থামিয়ে যাত্রী তোলা যেন নগরীর নিত্যদিনের চিত্র৷
ছবি: bdnews24.com
9 ছবি1 | 9
অন্যদিকে ঢাকায় সড়কের পরিমাণ মোট আয়তনের সাত ভাগের বেশি নয়৷ কিন্তু একটি শহরে মোট আয়তনের কমপক্ষে ৩০ ভাগ সড়ক থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ এর মানে হলো, প্রয়োজনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এই শহরে৷ ঢাকা শহরের মোট এলাকা ১,৩৫৩ বর্গ কিলোমিটার আর ঢাকার বর্তমান রাস্তার আয়তন ২,২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক৷
তাই চিত্রটি খুবই স্পষ্ট৷ প্রয়োজনের তুলনায় সড়ক অনেক কম৷ বিপরীতে যানবাহন বেড়েছে গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি৷ এছাড়া যে সড়ক আছে তার কমপক্ষে ১৫ ভাগ নানাভাবে অবৈধ দখলে আছে৷
ঢাকায় ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছেন মোট সড়কের ৭০ ভাগ৷ স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি-র হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কম-বেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট কারে যাতায়াত করেন৷ এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা৷ বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন৷ অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পায়৷ জনসংখ্যার হিসেবে শতকরা এক ভাগের মতো মানুষের প্রাইভেট কার আছে৷ কিন্তু সড়ক চলে গেছে তাদের দখলে৷
সরকারি গণপরিবহনের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি ৩৩ গুণ বেশি থাকলেও এ সব ব্যক্তিগত গাড়িতে মাত্র ১৩ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা হয়৷ বাস ৪৯ শতাংশ যাত্রীর দায়িত্ব নেয়৷
ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে এখনো রেলগাড়ি চলাচল করে৷ ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে রেল লাইন যাওয়ার ফলে ১৭টি পয়েন্টে রাস্তা বন্ধ করে ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা করায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়৷ এ সব পয়েন্টে দিনে কমপক্ষে ১০ বার যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়৷
সরকারের পরিকল্পনা
ভয়াবহ যানজটের আটটি শহর
৩৮টি দেশের ১ হাজার ৬৪টি শহরের অবস্থা পর্যালোচনা করে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ যানজটের শহরের তালিকা করেছে ইনট্রিক্স৷ সেই তালিকায় অ্যামেরিকা আর ইউরোপের শহরই বেশি৷
ছবি: picture alliance/dpa/W.Lei
সবচেয়ে ভয়াবহ যানজটের শহর
ট্রাফিক বিশ্লেষণ করাই ইন্ট্রিক্সের কাজ৷ এবার সে কাজ করতে গিয়ে তারা দেখেছে, অফিস শুরু আর শেষের সময়টায় ট্রাফিক পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ থাকে যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেসে৷ পরিসংখ্যান বলছে, সেখানকার গাড়িচালকদের প্রতি বছর পিক আওয়ারে অন্তত ১০৪ ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/Frank Duenzl
দ্বিতীয় স্থানে মস্কো
মস্কোর গাড়িচালকদের বছরে পিক আওয়ারে অন্তত ৯১ ঘণ্টা বসে থাকতে হয় গাড়িতে৷
ছবি: Getty Images/Y.Kadobnov
নিউ ইয়র্কও কম যায় না
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কেও বলতে গেলে সারা বছরই পিক আওয়ারে যানজট লেগে থাকে৷ সেখানে বছরে কমপক্ষে ৮৯ ঘণ্টা যানজটের কারণে গাড়িতেই বসে থাকতে হয় চালকদের৷
ছবি: picture alliance/dpa/blickwinkel
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শহর
সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজ এলাকায় পিক আওয়ারে গাড়ি যেন চলতেই চায় না৷ আর সারা শহরে যানজটের কারণে প্রতি বছর প্রত্যেক চালকের অন্তত ১৪শ ডলারের ক্ষতি হয়৷ সব চালকের ক্ষতি যোগ করলে যোগফলটা ৩০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে৷
ছবি: Getty Images/J.Sullivan
ব্রাজিলের সাও পাওলো
তালিকায় পঞ্চম স্থানে আছে ব্রাজিলের সাও পাওলো৷ সেই শহরে বছর কমপক্ষে ৭৭ ঘণ্টা জ্যামের কারণে চালকদের গাড়িতেই বসে থাকতে হয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/C.Faga
লন্ডন
ইউরোপের যে দেশগুলোতে ট্রাফিক জ্যামের দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি, ইংল্যান্ড তার অন্যতম৷ ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের তিনটি দেশের একটি ইংল্যান্ড৷ ইংল্যান্ডের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যানজট থাকে লন্ডনে৷ সেখানে বেশি ট্রাফিক জ্যাম হয় নাকি উইন্ডো শপিংয়ের কারণে৷
ছবি: Getty Images/S.Barbour
চীন, জাপান নেই কেন?
ইনট্রিক্স চীন এবং জাপানসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশের যানজট পরিস্থিতি বিশ্লেষন করেনি৷ সে কারণে তালিকায় চীন, জাপানসহ এশিয়ার অনেক দেশই নেই ৷ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাও হয়ত সে কারণেই তালিকার বাইরে৷
ছবি: picture alliance/dpa/W.Lei
আফ্রিকাও বাদ
আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশেই যানজট নিত্যদিনের ব্যাপার৷ তারপরও তালিকায় আফ্রিকার কোনো শহরের নাম আসেনি, কারণ, ইন্ট্রিক্স এখনো ওই মহাদেশ নিয়ে কাজ শুরু করেনি৷
ছবি: Getty Images/P.U.Ekpei
8 ছবি1 | 8
এ সব সমস্যা সমাধানে সরকার ২০১৪-১৫ সালে একটি রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) অনুমোদন করে, যাতে পাঁচটি পাতাল রেললাইন, দু'টো দ্রুতগতির বাস রুট এবং ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে৷ আর তা বর্তমান সড়ক নেটওয়ার্কের দ্বিগুণ৷ এতে ছয়টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং তিনটি রিং রোড অন্তর্ভুক্ত আছে৷ আগামী ২০ বছরে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের মোট ব্যয় হবে প্রায় ৩ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা৷
খসড়া পরিবহন পরিকল্পনায় আরো ৩ লাখ ৬০ হাজার অতিরিক্ত গাড়ি রাস্তায় নামানোর কথা বলা হয়েছে, যা অনেক বেশি পরিমাণে জায়গা দখল করবে৷ এ সব গাড়ি শুধু পার্ক করার জন্যই ৩ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার জায়গার প্রয়োজন হবে, যা গুলশান এবং বনানী আবাসিক এলাকার মিলিত আয়তনের প্রায় সমান৷
পুলিশ কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা
ঢাকার এই পরিবহণ সমস্যা এবং যানজট নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে৷ গবেষকরা নানা মতামতও দিচ্ছেন৷ তবে ঢাকার এক পুলিশ কর্মকর্তা আবু ইউসুফ প্রায় দু'বছর ধরে ঢাকার একটি এলাকার পরিবহণ ব্যবস্থা এবং যানজট নিরসনের জন্য তাঁর নিজের উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগিয়ে সফলতা পান৷ এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদনও প্রচার হয়েছে৷ তিনি ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে ঢাকা উত্তর বিভাগে ট্রাফিক পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন৷ তাঁকে তেজগাঁ শিল্প এলাকা, মগবাজার, রামপুরা
এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল৷ আর এই এলাকাগুলোতে ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার সব কারণ বিদ্যমান৷ এখানে রেলক্রসিং, ফ্লাইওভার, যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহন, প্রাইভেট কারের আধিক্য সব কিছুই আছে৷
ঢাকার প্রধান সমস্যা যানজট
এক কোটিরও বেশি জনসংখ্যার শহর ঢাকা৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো থমকে থাকে যানজটে৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়ে মানুষ, যার প্রধান কারণ অব্যবস্থাপনা ও জনগণের অসচেতনতা৷
ছবি: DW/M. Mamun
গোড়া থেকেই শুরু
বিশাল জনগোষ্ঠীর শহর ঢাকায় যানজটের ফলে যে শুধু সময় নষ্ট হয়, তা নয়৷ ক্ষতি হয় বিপুল পরিমাণ জ্বালানিরও৷ আর এই যানজট শুরু হয় সপ্তাহের একেবারে প্রথম দিনটি থেকেই৷ সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসের সকালে তোলা ছবিটি দেখুন৷ রাজধানী ঢাকার কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ-এর যানজট এটি৷
ছবি: DW/M. Mamun
যেখানে-সেখানে ওঠা-নামা
ঢাকার যানজটের কারণগুলোর একটি হলো যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো৷ এক্ষেত্রে চালকদের যেমন সচেতনতার অভাব আছে, তেমনি অসচেতন যাত্রীরাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
আরো বেশি যাত্রী!
ঢাকার ব্যস্ততম বিমানবন্দর সড়কের মাঝখানে গাড়িগুলোকে এভাবে আকাবাঁকা করে দাঁড় করানোর আরো একটি কারণ যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতা৷ সাধারণত একই রুটের বাসগুলো বেশি যাত্রী উঠানোর জন্য এরকম প্রতিযোগিতায় নামে৷ ফলে সৃষ্টি হয় যানজট৷
ছবি: DW/M. Mamun
অপ্রতুল পার্কিং স্পেস
ঢাকার প্রগতি সরণীর একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রের সামনের সড়কের ফুটপাথটি দখল করে রেখেছে গাড়ি৷ এ শহরের বেশিরভাগ ভবনেরই নেই নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা৷ ফলে এ সব ভবনে আসা গাড়িগুলো পার্ক করা হয় ফুটপাথে কিংবা সড়কের ওপর, যেটা যানজটের অন্যতম একটি কারণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
সচেতনতার অভাব
ঢাকার যানজটের অন্যতম আরেকটি কারণ যত্রতত্র পথচারী পারাপার৷ এ শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দাই ‘ট্র্যাফিক ম্যানার’ জানেন না৷ ব্যস্ততম সড়কে যত্রতত্র পারাপার তাই যানজটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ অবশ্য ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত ওভার ব্রিজ অথবা জেব্রা ক্রসিং না থাকাও এর একটা কারণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
জীবনের ভয় নেই?
পর্যাপ্ত ফুট ব্রিজ বা ওভার ব্রিজ না থাকলেও, যে কটি আছে তাও ব্যবহার করতে চান না পথচারীরা৷ ছবিতে দেখুন রাজধানীর প্রগতি সরণীর ওভার ব্রিজের নীচ থেকেই কেমন রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা৷ এই দলে আছে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে স্কুল শিক্ষার্থীরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
কখনও হকার, কখনও ছিনতাইকারী
যেসব পথচারী ওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে চান, তাদের অনেকসময়ই শিকার হতে হয় নানা বিড়ম্বনার৷ দিনেরবেলায় ওভার ব্রিজগুলো হকারদের দখলে চলে গেলেও, দেখার নেই কেউ৷ আর রাতেরবেলা এ সব ওভার ব্রিজে মানুষ উঠতে চান না ছিনতাইকারীর ভয়ে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বেপথে গাড়ি
যে কোনো বড় রাস্তারই দু’টো দিক থাকে – গাড়ি আসার একদিক আর যাওয়ার একদিক৷ ঢাকা শহরে যানজটের একটা প্রধান কারণ উল্টো পথে গাড়ি চালানো৷ হ্যাঁ, রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম হলে অনেককেই দেখা যায় গাড়ি ঘুরিয়ে ঝট করে উল্টো দিকের চলে যেতে৷ এতে করে যানজট তো বাড়েই, দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও থেকে যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
রাস্তার ভাঙার কারণে জ্যাম
ঢাকার যানজটের অন্যতম একটি কারণ দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তা খোড়াখুড়ি৷ ঢাকার গুলশানের এ সড়কটিতে স্যুয়ারেজের লাইন মেরামতের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে কাজ চলছে৷ ফলে দিনেরবেলায় সড়কটিতে লেগেই থাকছে যানজট৷
ছবি: DW/M. Mamun
সেতু নির্মাণের জন্য...
ঢাকা শহরের যানজটের কারণের মধ্যে আছে দীর্ঘ সময় ধরে উড়াল সেতু নির্মাণও৷ উড়াল সেতু নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখা হচ্ছে সড়কের বেশিরভাগ জায়গায়৷ ফলে তৈরি হচ্ছে যানজট৷ তাছাড়া এ সব উড়াল সেতু নির্মাণে সঠিক পরিকল্পনারও অভাব আছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাঁধ সাধলো রেল ক্রসিং
ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রেই আছে কমপক্ষে ২০টি রেল ক্রসিং৷ এ সব ক্রসিং থেকে দিনে কমপক্ষে ৭০টিরও বেশি রেলগাড়ি চলাচল করে৷ এক হিসেব মতে, এই ক্রসিংগুলোর কারণে দিনে প্রায় ছয় ঘণ্টা যানবাহন আটকে থাকে ঢাকায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
ডাস্টবিনের কারণেও যানজট
ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ডাস্টবিনই সড়কের ওপরে৷ এ সব ডাস্টবিনে উপচে পড়া ময়লা আবর্জনা সড়কের ওপরেও ছড়িয়ে পড়ে৷ ফলে সেসব জায়গায় স্লথ গতিতে চলে যানবাহন৷ তাছাড়া রাতেরবেলা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না৷ যত্রতত্র এ সব ডাস্টবিনের কারণেও যানজটের সৃষ্টি হয় মহানগরীতে৷
ছবি: DW/M. Mamun
12 ছবি1 | 12
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকাসহ সব সমস্যা মেনে নিয়েও শুধুমাত্র নিয়ম মানার মধ্য দিয়ে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার অনেক উন্নতি সম্ভব৷ এখানে নিয়ম না মানার শীর্ষে প্রাইভেট কার৷ তারা ইচ্ছে মতো চলাচল করে৷ আমি ডানের গাড়ি ডানে, বামের গড়ি বামে – এই নীতি অবলম্বন করে আমার এলাকায় যানজট অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিলাম৷ তাছাড়া রাস্তায় ঘন ঘন ক্রসিং বন্ধ করেও সুফল পেয়েছি৷’’
পথচারীরাও যানজটের একটা প্রধান কারণ৷ তারা যদি আন্ডার পাস অথবা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন তাহলে যানবাহনের গতি বাড়ে৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি নিজে রাস্তায় নেমে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করেছি৷ মানুষকে বুঝিয়েছি, প্রচারণা চালিয়েছি সচেতন করেছি৷ রিক্সার জন্য আলাদা লেন করেছি৷ কারণ যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন একই সড়কে চললে গতি কমতে বাধ্য৷’’
তাই ‘‘আমার বিবেচনায়, গাড়ি চলাচলে ডান-ডান, বাম-বাম নীতি না মানা, একই সড়কে যান্ত্রিক অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল, রাস্তায় নির্মাণ কাজ, খোড়াখুড়ি, রাস্তায় পার্কিং, ঘন ঘন ক্রসিং এবং ট্রফিক আইন অমান্য করা, উলটোপথে গাড়ি চালানো যানজটের প্রধান কারণ৷ এর সাথে আছে রাস্তার সমতা না থাকা৷ চওড়া সড়ক যখন সরু সড়কে গিয়ে মেশে তখন যানজট তো হবেই৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের এখন যা আছে তা দিয়েই আমি সমস্যার সমাধান খুঁজেছি৷ বর্তমান কাঠামোর মধ্যেই ট্রাফিক ব্যবস্থা আরো কীভাবে ভালো করা যায় আমি তার চেষ্টা করেছি৷ আর কাঠামোগত সংস্কারসহ আরো অনেক বিষয়ের কথা বলতে পারবেন বিশেষজ্ঞরা৷’’
বলা বাহুল্য, ঢাকার যে ট্রাফিক চিত্রের কথা বলা হলো, তা স্বাভাবিক পরিস্থিতি৷ কিন্তু জলাবদ্ধতা, বৃষ্টি বা বিশেষ পরিস্থিতিতে কী হতে পারে বা হয়, তা মনে হয় গবেষণায়ও বোঝা কঠিন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷