ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এবং ব্রিটিশ চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে রোববার তলব করেছে ইরান৷ ইরান সরকারের অভিযোগ, এই রাষ্ট্রগুলি আহভাজ শহরে জঙ্গি হামলায় মদদ দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
এর আগে শনিবার হামলার পরপরই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভাদ জারিফ টুইটারে জানিয়েছিলেন, বন্দুকধারীরা ‘বিদেশি একটি শক্তির অর্থে নিয়োগপ্রাপ্ত, প্রশিক্ষিত এবং সশস্ত্র জঙ্গি৷'
ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যদের সহায়তার অভিযোগ এনেছে ইরান সরকার৷ দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আল-আহভাজিয়েহ সংগঠনটিকে কালো তালিকাভুক্ত না করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেবে না ইরান সরকার৷
এর আগে বন্দুকধারীদের ‘তাকফিরি' বলে উল্লেখ করে আইআরএনএ৷ ইসলামিক স্টেটের সদস্যদের এই নামে ডাকা হতো৷ পরে আইএসের মুখপত্র আমাক-এর মাধ্যমে সংগঠনটি দায় স্বীকার করলেও তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি৷
ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, মোটরসাইকেলে চড়ে আসা দুই বন্দুকধারী চালিয়েছে এই হামলা৷
আঞ্চলিক উত্তেজনা
শনিবারের টুইটে কিছু ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্র' ও তাদের ‘মার্কিন প্রভু'কে এই হামলার জন্য দায়ী করেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভাদ জারিফ৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনার মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াতে ইরান ও সৌদি আরব কতটা মরিয়া, তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷
তেহরান বরাবরই মধ্যপ্রাচ্যে রিয়াদকে পেছন থেকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় ওয়াশিংটনকে দোষারোপ করে আসছে৷
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ ইরানের সাথে পশ্চিমা ক্ষমতাধর দেশগুলোর পরমাণু চুক্তি থেকে নাম প্রত্যাহার ও নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের পর তা বাজে দিকে মোড় নিয়েছে৷
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি আহভাজে হামলাকে ‘এই অঞ্চলের মার্কিন সমর্থিত সরকারগুলোর ষড়যন্ত্র' বলে আখ্যা দিয়েছেন৷ ইরানকে অস্থিতিশীল করতেই এই ‘চক্রান্ত' বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি৷
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের এক মুখপাত্র হামলাকারীরা ‘সৌদি সমর্থিত' বলে অভিযোগ করেছেন৷
ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের রাজধানী আহভাজ৷ তেল-সমৃদ্ধ এই এলাকায় আরব বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অতীতে অনেকবার তেলের পাইপলাইনে হামলা চালিয়েছে৷ শিয়া অধ্যুষিত ইরানের এই অঞ্চলে সুন্নিদের প্রাধান্য বেশি৷ আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসও সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী৷
গত বছরের ৭ জুন রাজধানী তেহরানে পার্লামেন্ট ভবনে হামলা চালায় আইএস জঙ্গিরা৷ হামলা হয় আয়াতুল্লাহ রুহোল্লাহ খোমেনির মাজারেও৷ সেসব হামলায় অন্তত ১৮ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হন৷
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷