সামরিক শাসন ছাড়া জাতীয়তাবাদ আসত কি?
২৩ জুলাই ২০১৮ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে কি হঠাৎ করেই জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে?
অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার: বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ বিষয়ক আলোচনা অনেকদিন ধরেই হচ্ছে৷ জাতীয়তাবাদ বিষয়ক আলোচনা প্রথম শুরু হয়েছে সামরিক সরকারের আগমনের পর৷ বাঙালি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ – এই ধারণার ভিত্তিতে পাকিস্তানবিরোধী আলোচনা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে৷ মুক্তিযুদ্ধের পরও সরকারি দল, এমনকি বিরোধী দল যারা ছিল, তারাও এই চিন্তার মধ্য দিয়ে রাজনীতিটা করেছে৷ আমরা দেখলাম, সামরিক সরকার আসার পর তাঁদের বুদ্ধিজীবীরা নতুন একটা ধারণা নিয়ে বিতর্ক তুললেন এবং তাঁরা বলতে চাইলেন, আমাদের দেশে নতুন একটি জাতি এবং জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়েছে৷ মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা সেই আলামত কখনো শুনিনি৷ এখানে আমি সুনির্দিষ্ট করে দু'টি বিষয় বলতে চাই৷ ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারনীতি, অসাম্প্রদায়িক এবং আধুনিক মূল্যবোধ নিয়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবধারা, তার বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে কথা বলা হলো, সেটার মধ্যে মূলত ধর্মীয় মূল্যবোধ, সুনির্দিষ্ট করে বললে রাজনীতির প্রয়োজনে ইসলামকে সামনে এনে ধরে একটা নতুন বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে৷ আর তখন থেকেই আমরা সেই চক্রের মধ্যে পড়ে গেলাম যে, আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি? তাঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর একটা কৃত্রিম জাতীয়তাবাদ এখানে চালু করেছে৷ একাত্তরে যে দ্বিজাতিতত্ব তার রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে৷ কিন্তু সেটা সামাজিক পর্যায়ে পুরোপুরি মুছে যায়নি৷ ১৯৭৫-এর পর যখন অনুকূল পরিবেশ পাওয়া গেল, তখন সেই জিনিসটা উজ্জ্বীবিত হলো ভিন্ন নামে৷ ৭৫-এর পর থেকে এটাকে লালনপালন করা হয়েছে৷ প্রথম যে দুই সামরিক শাসক ক্ষমতায় আসে, আমি যদি তাঁদের প্রয়োজনের জায়গা থেকে দেখি, তাহলে বলবো, ওনাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না৷ কারণ, ওনারা রাজনৈতিক গোত্র বা পরিচয় ছাড়া এসেছিলেন৷ সেই সময় মানুষের মধ্যে যে ধর্মীয় আবেগ আছে, সেটার ব্যবহার ছাড়া আর কোনো সুযোগ ছিল না৷
তাহলে কি আমাদের জাতীয়তাবাদ কোনো সংকটের মুখে পড়েছে?
আমি তা মনে করি না৷ তবে বিষয়টা হলো আমি কোন ‘লেন্স' দিয়ে দেখছি৷ বাংলাদেশ একটা ‘ইয়াং নেশন', যার বয়স ৫০ বছর হয়নি৷ যার ভেতর থেকে, অর্থাৎ যে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, সেই পাকিস্তানের জন্ম কিন্তু হয়েছে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে৷ আমি যদি খুব অধৈর্য্যের জায়গা থেকে দেখি, তাহলে মনে হবে, সব শেষ হয়ে গেল, কোনো আশা নেই৷ আমি আসলে এভাবে দেখি না৷ আমি দেখি, সামরিক শাসন যদি না আসতো তাহলে জাতীয়তাবাদভিত্তিক যে মতাদর্শ, সেটা আসতো না৷ সেটা হতে পারতো গণতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র৷ তবে কী হতো, সেটা আমরা বলতে পারবো না৷ হতে পারতো পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র, কিংবা গণতন্ত্র বনাম মৌলবাদ৷ কিছু একটা হতে পারতো৷ কিন্তু জাতীয়তাবাদ বিষয়ক যে উটকো বিতর্ক, সেটা আসতো না৷ আবার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা যখন আসে, তখন এই ব্যানারে অনেক কিছুই আসে, যা আমরা চেপে রাখি, ঢেকে রাখি৷ আসলে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ' কথাটা একটা স্মারকের মতো, একটা তাঁবুর মতো৷ এর মধ্যে নানা পক্ষের লোক – মোটা দাগে আমি যদি বলি, অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ, অ্যান্টি-হিন্দু, অ্যান্টি-ভারত, অ্যান্টি-মাইনরিটি, অ্যান্টি-জাতিগত সংখ্যালঘু – এই ধরনের নানা অ্যান্টি লোকজনের এই তাঁবুর নীচে সহাবস্থান থাকে৷
গণতন্ত্রের যে বৈশিষ্ট্য, তা অনুযায়ী এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু?
গণতন্ত্র আছে, আবার নেইও – এই পরিস্থিতিতে আমাদের মতো দেশগুলোতে এখনো গণতন্ত্র নিয়ে সুখী হওয়ার মতো সময় আসেনি৷ আমরা এখনো সেই পর্যায়ে যাইনি যে, আমরা এটা নিয়ে রিল্যাক্স করতে পারি৷ গণতন্ত্রের অন্যতম একটা ইন্ডিকেটর হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা৷ মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হবে৷ আমার কাছে যদি জানতে চান, তাহলে বলবো – হচ্ছে এবং হচ্ছেও না৷ আমার জায়গা থেকে বলি৷ যদি বিরোধী দল যে দাবি করছে, এই দাবির একেবারেই কোনো ভিত্তি না থাকে, সেটা ঠিক হবে না৷ তাদের কাছ থেকে মাঝে মধ্যে শোনা যায় যে তারা কথা বলতে পারছেন না৷ বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে কথা বলার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না৷ আবার অন্যভাবে যদি বলি, বড় ধরনের শো-ডাউন ছাড়া বিরোধী দলের লোকেরা কি টকশো-তে যেতে পারছেন না? আমি যখন টকশো দেখি, তখন তো বিরোধী দলের লোকদের দেখা যায়৷ আমি যদি বলি গত ৮/১০ বছরে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কার খর্ব হয়েছে? বলেন? তাহলে আমি বলবো, মুক্তমনা মানুষ, উদার চিন্তার মানুষ, প্রগতিশীল চিন্তার মানুষের৷ যে শক্তিটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে, মানুষের জান নিয়ে ফেলছে, সেখানে রাষ্ট্র কতটুকু তাদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন? কখনো কখনো এটা দেখেছি, রাষ্ট্র দুই পক্ষকেই শাসাচ্ছেন৷ তাই আমি বলবো, যাঁরা মুক্ত চিন্তার মানুষ, তাঁরা নিজেদের এখান থেকে সরিয়ে নিয়েছেন, প্রাণের ভয়ে৷ বিরোধী দল মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাচ্ছে, আবার পাচ্ছে না৷ তবে কোনো জায়গা থেকেই সহযোগিতা পাচ্ছে না মুক্ত চিন্তার মানুষ৷
গণতন্ত্র থাকলেই জাতীয়তাবাদ আছে, এমন কি মনে করা যায়?
আমাদের এই অঞ্চলে জাতীয়তাবাদ কিন্তু স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয়নি৷ আমাদের এখানে জাতীয়তাবাদ এসেছে ঔপনিবেশিক শাসকবিরোধী সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে৷ এখানে জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্র বা শাসকবিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে এসেছে৷ এটা ব্রিটিশ আমলেও সত্য ছিল, পাকিস্তান আমলেও সত্য ছিল৷ আমরা যখন বলছি জাতীয়তাবাদ, তখন একটা জিনিস আমরা মাথায় রাখছি না যে, জাতীয় রাষ্ট্র যদি বলি, তাহলে জাতীয়তাবাদ দুই ধরনের৷ এক, আগে জাতি বা জাতীয়তাবাদী ধারণার জন্ম, তারপর রাষ্ট্র৷ যেমন জার্মানি৷ দুই, রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পরও জাতীয়তাবাদের ধারণার জন্ম হতে পারে৷ যেমন ফ্রান্স৷ এটা খুবই জটিল এবং গোলমেলে৷ তাই গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ একসঙ্গে যায় কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে আমি এটাই বলবো যে, উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যেগুলো, সেগুলো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথাই ভেবেছে এবং তাদের আন্দোলনের মাধ্যম ছিল জাতীয়তাবাদ৷ এখানে ভারতে গান্ধীর কথা বলতে পারি আমরা৷
একটা দেশ কি গণতন্ত্র রক্ষা করে ফ্যাসিবাদের দিকে যেতে পারে?
প্রথম কথা হচ্ছে, ফ্যাসিবাদ বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? আমরা জানি, এটা এসেছে ইটালির মুসোলিনির কাছ থেকে৷ গণতন্ত্র বলতে আমরা যদি বুঝি শুধু ভোটে জয়লাভ, তাহলে সেটা আশঙ্কাজনক৷ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমি যে মিডিয়ার জন্য সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, সেই দেশটার শাসক যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে, তখন তার পক্ষে কিন্তু জার্মানির সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ ছিলেন৷ এখন সংখ্যা গরিষ্ঠের মত যদি গণতন্ত্র হয়, যেমন একটা দেশে ৩০০ আসনের মধ্যে যদি ২০০ জন যুদ্ধাপরাধী ভোটে জিতে আসেন, তখন তো বলতে হবে যে, মানুষ তাদের ভোট দিয়েছে এবং তারা জিতেছে, অতএব সেটা গণতন্ত্র৷ তাহলে এর মধ্যে ফ্যাসিজমের ঝুঁকি থাকতেই পারে৷ আমরা যদি সত্যিকারের গণতন্ত্র বলতে চাই, তাহলে নির্বাচন হলো প্রথম শর্ত৷ কিন্তু একমাত্র শর্ত না৷ এর মধ্যে উদারনীতি থাকতে হবে৷ খেয়াল করবেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা যখন গণতন্ত্র বলি, তখন বলি উদার গণতন্ত্রের কথা৷ নির্বাচিত গণতন্ত্রের কথা কিন্তু বলি না৷ উদার গণতন্ত্র হলে সেখানে চিন্তার স্বাধীনতা থাকতে হবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে৷
বাংলাদেশ কি ফ্যাসিবাদের ঝুঁকির মুখে পড়েছে?
এখানে ফ্যাসিবাদের ঝুঁকি কী অর্থে বলা হচ্ছে? সরকারি দল তাদের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে কিনা, সেটা দেখতে হবে৷ আমি বলবো, আমি সেরকমের বিপদ দেখতে পাচ্ছি না৷ যে কোনো সরকার যত প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন হবে, তাদের ফ্যাসিবাদের দিকে যাওয়ার সুযোগ আছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটা বৈশ্বিক প্রবণতা৷ নির্বাচিত, কিন্তু গণতান্ত্রিক মনোভাবের অভাব হয়েছে সরকারগুলোর মধ্যে৷ আর এই ধরনের শাসক ক্রামাগত সংখ্যায় বাড়ছে৷ রাশিয়ায় পুটিন, অ্যামেরিকায় ট্রাম্প, ইউরোপের একাধিক দেশেও আজ এই ধরনের ঝুঁকি বাড়ছে৷ এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এটাই পরবর্তী মডেল হতে যাচ্ছে কিনা৷ বৈশ্বিক আশঙ্কার পার্ট হিসেবে বাংলাদেশও এর থেকে মুক্ত নয়৷
আপনি কি শান্তনু মজুমদারের সঙ্গে একমত? লিখুন নীচের ঘরে৷