সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরাধ
১ আগস্ট ২০১৬জঙ্গিবাদ এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর অভিযোগে গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের ৩০টি পেজ ও আইডিকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার ক্রাইম ইউনিট৷ এই পেজগুলো বন্ধ করতে তারা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়ে সহায়তা চেয়েছ৷ পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ সব ফেসবুক পেজের মাধ্যমে নানারকম ধর্মীয় উগ্র মতবাদ প্রচার, জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা, জিহাদের ডাকসহ রাষ্ট্রবিরোধী নানারকম অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে৷
তাঁরা জানান, জঙ্গিরা এখন অনলাইন বা ইন্টারনেটকে তাদের যোগাযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে৷ পারস্পারিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে উগ্র ধর্মীয় মতবাদও প্রচার করছে অনলাইনে৷ পুলিশের কথায়, এ সব পেজের অ্যাডমিন বা ব্যবহারকারীরা বেশিরভাগই বিদেশে অবস্থান করে৷ ফলে তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না৷
ফেসবুকের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েবসাইটেও চলছে ধর্মীয় উগ্র মতবাদের প্রচারণা৷ এর আগেও বেশ কিছু ফেসবুক পেজ, আইডি, ব্লগ আর ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে৷ কিন্তু একটি বন্ধ করা হলে জঙ্গিরা নতুন নামে আরেকটি পেজ বা আইডি খুলে একই কাজ শুরু করছে৷ পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, জঙ্গিরা নাকি অনলাইনের মাধ্যমে সদস্যও সংগ্রহও করছে৷
বাংলাদেশে ব্লগার হত্যাসহ লেখক-প্রকাশক হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে৷ হুমকি দেয়া হয়েছে টুইটারেও৷ আর হত্যার পর দায় স্বীকারের সময়ও ব্যবহার করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম৷ গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে ২০ জনকে হত্যার কথা জঙ্গিরা সামাজিক যোগাযোগোর মাধ্যমেই প্রকাশ করে৷ এছাড়া হত্যাকে সমর্থন করে পরবর্তীতে তিনজন জঙ্গির ভিডিও বার্তাও ছড়ানো হয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে৷ পুলিশ জানায়, নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর প্রথম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের অ্যাপসকে৷
গত বছরের ২৭শে জুলাই জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি-র ভারপ্রাপ্ত আমির আবু তালহা মোহাম্মদ ফাহিম ওরফে পাখিসহ জেএমবি-র যে আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের বেশিরভাগই আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা৷
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায় যে, দেশে সাইবার সন্ত্রাসীদের তৎপরতা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে৷ প্রযুক্তি জ্ঞানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো আগের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ হলেও, সাইবার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে অনেকসময়ই তারা পেরে উঠছে না৷
শিকার যখন নারী
সাইবার হয়রানি থেকে সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে একটি ‘সাইবার হেল্প ডেস্ক' রয়েছে৷ এই হেল্প ডেস্কে গত দু'বছরে ১৭ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে৷ অভিযোগকারীদের ৭০ ভাগই নারী৷ আরও সুর্দিষ্ট করে বললে, নারীদের অভিযোগের ৬০ ভাগেরও বেশি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুককে কেন্দ্র করে৷
এরমধ্যে ১০ ভাগ অভিযোগ সত্যিই ভয়াবহ৷ এর মধ্যে রয়েছে অন্যের ছবিতে ছবি জুড়ে দেওয়া (সুপার ইম্পোজ) এবং পর্নোগ্রাফি৷ ইউটিউব ও বিভিন্ন সাইটে এ সব পর্নোগ্রাফি ও ছবি ‘আপলোড' করার হারও বেড়ে চলেছে৷
অভিযোগকারীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ফেসবুকের চ্যাট বা ভিডিও চ্যাটের ছবি একটু এদিকে-ওদিক করে বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিডিও-চিত্র দ্রুত ইউটিউবে অথবা বিভিন্ন পর্নো সাইটে শেয়ার করা হচ্ছে৷ চিন্তার বিষয়, এনেকেরই এখন এ সব ইউটিউবে শেয়ার করা এবং করে কমেন্ট পাওয়াটা নেশায় পরিণত হয়েছে৷ তাছাড়া অভিযোগ আসার দু-একদিনের মধ্যে রিপোর্ট করতে গিয়ে দেখা যায় যে, তা তার মধ্যেই কয়েক হাজারবার শেয়ার হয়ে গেছে৷ তাই তখন ফেসবুকে রিপোর্ট করেও কাজ হয় না৷ গুগলও চায় না তা মুছে ফেলতে৷ ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে৷
অভিযোগগুলোর মধ্যে এছাড়াও আছে ফেসবুক আইডি হ্যাক, ই-মেল আইডি হ্যাক, বিভিন্ন ধরনের পর্নোসাইট বা ব্যক্তিগত ছবি পর্নোসাইটে ছেড়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও৷
প্রতারণায় ফেসবুক
গত মার্চ মাসে র্যাব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগে ১২ জন বিদেশিসহ মোট ১৪ জনকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে৷ তারা নাকি দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের অর্থ হাতিয়ে আসছিল৷
জানা যায়, খুলনার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নারী চাকরিজীবী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের একজন নারী চিকিৎসক, রাঙ্গামাটির একজন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষিকাসহ অনেকের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে সখ্য গড়ে তোলে তারা৷ তারপর এই সম্পর্ক আরও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তারা হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ট্যাংগো এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমও ব্যবহার করতে শুরু করে৷
র্যাব জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগে কর্মরত নারী চিকিৎসকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কের সূত্র ধরে স্কট মুরি নামে এক ব্যক্তি লন্ডন থেকে কিছু উপহার সামগ্রী বিমানযোগে ঢাকা পাঠায় বলে জানায়৷ বিমানবন্দর থেকে ওই পার্সেলটি খালাস করতে আনুষাঙ্গিক ব্যয় ৬০ হাজার টাকা হবে বলেও নারী চিকিৎসককে জানায় সে৷ এবং একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নম্বর দিয়ে মেয়েটিকে সেই অ্যাকউন্টে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করে৷
কথা অনুযায়ী ঐ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নারী চিকিৎসক ৬০ হাজার টাকা পাঠান৷ এরপর শাহজালাল বিমানবন্দরে পার্সেলটি গ্রহণ করতে গিয়ে তিনি দেখেন যে, আদৌ কোনো পার্সেল আসেনি৷ তখন তিনি র্যাবের কাছে প্রতারণার অভিযোগ করলে প্রতারক চক্রের সদস্যদের আটক করা হয়৷
বর্তমানে এ ধরনের সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের কিশোররাও৷ গত মার্চ মাসে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার একটি স্কুলের এক ছাত্রকে প্রকাশ্যে মারধোর করে আরেক কিশোর৷ কিন্তু সেই ছাত্রের এক সহযোগী ঘটনমাটি ভিডিওতে ধারণ করে এবং তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়৷ এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিযার সৃষ্টি হয়৷ সেই কিশোরও এখন কারাবন্দি৷
বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশে এই সময়ে সাইবার অপরাধের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলাদেশে ব্যাংক'-এর ৮১ মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ চুরির ঘটনা৷ শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর প্রায় সব প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমই গুরুত্বের সঙ্গে এই সাইবার ডাকাতি নিয়ে খবর পরিববেশন করে৷ এই অপরাধে জড়িত চক্রটি আন্তর্জাতিক৷ তবে ঘটনাটির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশের কেউ জড়িত থাকার বিষয়টিকেও একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারীরা৷
আইন ও প্রতিরোধ
বাংলাদেশে ২০০৬ সালে প্রথম সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণয়ন করা হয়৷ এরপর ২০১৩ সালে এই আইন সংশোধন করা হয়৷ কিন্তু আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে এখনও থেকে গেছে৷ এর কারণ, ৫৭ ধারাটিকে সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে৷ এতে এমন সব ইস্যু যুক্ত করা হয়েছে, যার ব্যখ্যা আইনে নেই৷ ফলে পুলিশ আইনটিকে ইচ্ছেমতো ব্যবহারে সক্ষম৷ ঢাকায় একটি সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনালও খোলা হয়েছে৷
এছাড়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের আছে একটি সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ ইউনিট৷ এর পাশাপাশি নবগঠিত কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটও সাইবার অপরাধ দমনে কাজ করে৷ এই ইউনিটের প্রধান এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, ‘‘এখন সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে পুলিশের দক্ষতা অনেক বেড়েছে৷ আমরা নানা তথ্য সংগ্রহ করি এবং যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ আমরা মনিটরিং-ও করি৷ তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই অপরাধের শিকার অনেকেই অভিযোগ করেন না৷ তবে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নিই৷''
বাংলাদেশে ‘ফাইবার অ্যাট হোম' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চিফ স্ট্যাটেজি অফিসার সুমন আহমেদ৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে হয়রানির মাত্রা বেড়েছে৷ সংঘবদ্ধ অপরাধ ছাড়াও, ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ আর এতে প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম৷ কারণ প্রতিকার পেতে হলে ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার সহায়তা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন আন্তঃরাষ্ট্র সহায়তা৷''
এই তথ্য-প্রযুক্তিবিদের মতে, ‘‘হেট স্পিস ছাড়ানো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমস্যা হচ্ছে যে, তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বা সাইবার ক্রাইম চিহ্নিত ও দমনে ততটা দক্ষ নয়৷ আমার মতে, এর জন্য বিশেষায়িত ইউনিট দরকার৷ আজ সাইবার ক্রাইম ইউনিটে, কাল দাঙ্গা দমন বিভাগে, তাহলে তো হবে না৷ বরং আমার মনে হয়, এখন প্রত্যেক পুলিশ সদস্যেরই সাইবার অপরাধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকা উচিত৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷