সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এশিয়ার দুঃসাহসী দুই নারী এবার যৌথভাবে ‘আন্না পোলিটিকোভসকায়া' পুরস্কার পেয়েছেন৷ তাদের একজন ভারতের গৌরী লঙ্কেশ, যিনি এ লড়াই করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
‘রিচ অল উইমেন ইন ওয়ার আন্না পোলিটিকোভসকায়া' নামের বার্ষিক এই পুরস্কারটি যৌথভাবে পেয়েছেন ভারতের গৌরী লঙ্কেশ এবং পাকিস্তানের গুলালাই ইসমাইল৷ ৫৫ বছর বয়সি গৌরী লঙ্কেশ ভারতের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক ছিলেন৷ তাঁর পত্রিকায় প্রায়ই উঠে আসতো ধর্মীয় সহিংসতা, হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা এবং উগ্রহিন্দুত্ববাদী দলগুলোর অত্যাচারের কথা, ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷
গত মাসে বেঙ্গালুরুতে নিজের বাসভবনের সামনে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি৷ লঙ্কেশের বোন কবিতা থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বললেন, ‘‘এই পুরস্কারটি আমার বোনের মতো যারা লেখার মাধ্যমে লড়াই করছেন, তাঁদের অনুপ্রেরণা জোগাবে, কেননা, গৌরী বরাবরই বলতেন, তোমরা আমার কণ্ঠরোধ করতে পারবে না৷ তাঁর সেই বোধের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবেই যেন এ পুরস্কার দেয়া হলো৷''
উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের কারণে বর্তমান ভারতে সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে৷ প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী সাংবাদিকদের হুমকি দেয়া হয়৷ কবিতা বললেন, ‘‘নৈতিকতা বজায় রেখে যাঁরা কাজ করতে চান, তাঁদের জন্য সাংবাদিকতা আজ খুবই কঠিন একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷''
অপর পুরস্কার বিজয়ী পাকিস্তানের শান্তি কর্মী গুলালাই ইসমাইল৷ ৩১ বছর বয়সি এই নারী পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে তালিবানদের বিরুদ্ধে সোচ্চার৷বিভিন্ন সময় হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে তাঁকে৷ পেশাওয়ারের গুলালাই বলছিলেন, গৌরীর মৃত্যু সংবাদে তিনি শোকাহত হয়ে পড়েছিলেন৷ তিনি বললেন, ‘‘এটা খবই দুঃখজনক যে, এমন একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেয়া হলো৷ এই পুরস্কার একইসাথে আমাদের সংগ্রাম এবং সাহসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর নিদর্শন৷ ''
মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকে উত্তর পশ্চিম পাকিস্তানে নারীদের সহিংসতা রোধ এবং তাঁদের শিক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি৷ এছাড়া জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে তরুণ শান্তিকর্মী সৃষ্টিতেও কাজ করছেন গুলালাই৷ থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে তিনি জানালেন, ‘‘আমার বাড়িতে দু'দুবার হামলা চালানো হয়েছে৷ আমার গায়ে বিশ্বাসঘাতকের তকমা এঁটে দেয়া হয়েছে৷ বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় একবার আমার পথ আটকে হুমকি দিয়েছিল চার বন্দুকধারী৷''
নারী সাংবাদিক বা নারী অধিকার কর্মীদের ১১ বছর ধরে এই পুরস্কারটি দেয়া হচ্ছে৷ ২০০৬ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক পোলিটিকোভসকায়াকে মস্কোতে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তিনি চেচনিয়ায় দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লংঘন নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করছিলেন৷ সে বছর থেকেই তাঁর নামে এই পুরস্কারটি চালু করে লন্ডনভিত্তিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যারা নারী অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে৷ এ বছর তারা রোহিঙ্গা শরণার্থী জামালিদা বেগমকেও বিশেষ সম্মান জানিয়েছে৷ জামালিদা মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে তাঁকে ধর্ষণ করেছে তা প্রকাশ্ করার সাহস দেখিয়েছেন৷
বাবরি মসজিদের প্রতিষ্ঠা থেকে ভাঙচুরের ইতিহাস
হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, রাম মন্দির, নাকি মোগল সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত একটি মসজিদ? বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৩ সাল থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চলেছে, যা চরমে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে৷
ছবি: dpa - Bildarchiv
১৫২৮ সালে নির্মাণ
রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত৷ তারই কাছে রামকোট পর্বত৷ ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান' বলেও পরিচিত ছিল৷
ছবি: DW/S. Waheed
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার৷ অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. E. Curran
সংঘাতের সূত্রপাত
প্রথমবারের মতো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত৷১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
হিন্দুদের দাবি
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি৷ তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি৷
ছবি: AP
বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর – বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷
ছবি: DW/S. Waheed
নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন ‘‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে’’৷
ছবি: Getty Images
মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে৷ ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ৷ অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন৷
ছবি: AP
‘রাম রথযাত্রা'’
১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস'-এর অনুমতি পায়৷ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা'’ শুরু করেন৷
ছবি: AP
১৯৯২
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছান৷ ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়৷ ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
ছবি: AP
শিলালিপি কী বলে
পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল৷ আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী'-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির৷
ছবি: CC-BY-SA-Shaid Khan
বিজেপি দোষী
বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়৷ প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়৷
ছবি: AP
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত৷ এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন৷ রায়ে আরো বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে৷ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই জমিটি ভাগ করতে চান না৷
ছবি: AP
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷