সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় এক বছরে ৪৫ খুন, দাবি ঐক্য পরিষদের
৯ জুলাই ২০২৪
বাংলাদেশে গত এক বছরে এক হাজার ৪৫টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা-নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ৪৫ জন মারা গেছেন৷ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে এ তথ্য দেয়া হয়৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছরে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৫টি। মরদেহ উদ্ধার (হত্যাকাণ্ড বলে প্রতীয়মান) হয়েছে ৭ জনের। ১০ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে ৩৬ জনকে।
হামলা/শারীরিক নির্যাতনে জখম হয়েছেন ৪৭৯ জন। ওই সময়ে চাঁদা দাবি করা হয়েছে ১১ জনের কাছে, বসতঘর/ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা/ভাঙচুর/লুটপাট/অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১০২টি। এছাড়া বসতবাড়ি/জমিজমা দখলের ৪৭টি এবং দখল বা উচ্ছেদের তৎপরতা ও হুমকির ঘটনা ঘটেছে ৪৫টি।
এর বাইরে দেশত্যাগের হুমকি বা দেশত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টার ১১টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে৷
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত এক বছরে দেবোত্তর/মন্দির বা গির্জার সম্পত্তি দখল ও দখলের চেষ্টা হয়েছে ১৫টি। শ্মশানভূমি দখল বা দখলের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে সাতটি। মন্দিরে হামলা/ভাঙচুর/লুটপাট/অগ্নিসংযোগ ১৪টি, প্রতিমা ভাঙচুর ৪০টি, দলবদ্ধ ধর্ষণ বা ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণচেষ্টার ঘটনাও ঘটেছে ২৫টি।
প্রতিবেদনে সংখ্যালঘুদের অপহরণ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ১২টি ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। আরো রয়েছে ধর্ম অবমাননার কল্পিত অভিযোগে আট জনকে আটক করার কথা।
ধর্মীয় সম্প্রীতি বাড়াতে কতিপয় উদ্যোগ
বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে৷ ছবিঘরে থাকছে বিস্তারিত৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
জাতিসংঘের উদ্যোগ
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ‘বিশ্ব আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি সপ্তাহ’ উদযাপন করে জাতিসংঘ৷ ধর্ম যা-ই হোক, সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা এর উদ্দেশ্য৷ এই সময় রাষ্ট্রগুলোকে গির্জা, মসজিদ, সিনাগগ, মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয়ে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও শুভেচ্ছার বার্তা প্রচারে উৎসাহিত করে জাতিসংঘ৷ জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ ২০১০ সালে এমন সপ্তাহ পালনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷
ছবি: Eduardo Munoz/AP/picture alliance
পোপ ও আল-আজহারের ইমামের উদ্যোগ
মিশরের আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম শেখ আহমেদ আল-তায়েব ও পোপ ফ্রান্সিস ২০১৯ সালে ‘বিশ্ব শান্তি ও একসাথে বসবাসের জন্য মানব ভ্রাতৃত্বের নথি’তে সই করেন৷ এই নথির উপর ভিত্তি করে ২০২০ সালে জাতিসংঘ ৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মানব ভ্রাতৃত্ব দিবস’ ঘোষণা করে৷ এদিন মানব ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিশ্বের যে কোনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে ‘জায়েদ অ্যাওয়ার্ড ফর হিউম্যান ফ্র্যাটার্নিটি’ দেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
সৌদি বাদশাহর উদ্যোগ
২০০৮ সালে সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহর উদ্যোগে স্পেনের মাদ্রিদে একটি আন্তঃধর্মীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর লক্ষ্যে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল৷ বৌদ্ধ, হিন্দু ও শিখদেরও সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সৌদি বাদশাহ৷
ছবি: Victor R. Caivano/AP Photo/picture alliance
পোপ ও সৌদি বাদশাহর উদ্যোগ
২০১২ সালে ভিয়েনায় ‘কিং আব্দুল্লাহ বিন আব্দুলআজিজ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টাররিলিজিয়াস অ্যান্ড ইন্টারকালচারাল ডায়ালগ’ বা কেএআইসিআইআইডি প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এটি একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা, যা সংঘাত প্রতিরোধ ও সমাধানের জন্য আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপকে উৎসাহিত করে৷ ২০০৭ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট ও সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহর বৈঠকের পর এই সংগঠন তৈরি করা হয়৷
ছবি: CHROMORANGE/IMAGO
বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ
‘ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ’ নামে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প আছে৷ এর আওতায় বিভিন্ন জেলায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আয়োজন করা হয়৷ এছাড়া গতবছর জুলাইতে বছরব্যাপী একটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়৷ এর আওতায় ওয়েব ড্রামা সিরিজ, টিভি কমার্শিয়াল, নাটক, টক শো, মিউজিক ভিডিও ও ডকুমেন্টারি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়৷ এছাড়া সম্প্রীতি ও সচেতনতামূলক বার্তা-সমৃদ্ধ লিফলেট, পোস্টার, বিজ্ঞাপন তৈরিরও পরিকল্পনা করা হয়৷
ছবি: Privat
বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ
‘ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ’ নামে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প আছে৷ এর আওতায় বিভিন্ন জেলায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আয়োজন করা হয়৷ এছাড়া গতবছর জুলাইতে বছরব্যাপী একটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়৷ এর আওতায় ওয়েব ড্রামা সিরিজ, টিভি কমার্শিয়াল, নাটক, টক শো, মিউজিক ভিডিও ও ডকুমেন্টারি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়৷ এছাড়া সম্প্রীতি ও সচেতনতামূলক বার্তা-সমৃদ্ধ লিফলেট, পোস্টার, বিজ্ঞাপন তৈরিরও পরিকল্পনা করা হয়৷
ছবি: Joy Saha/Zumapress/picture alliance
আন্তর্জাতিক সংস্থার আয়োজন
বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে শান্তি ছড়িয়ে দিতে ১৯৭০ সালে ‘রিলিজিয়নস ফর পিস’ আরএফপি সংগঠন যাত্রা শুরু করে৷ এর সদরদপ্তর নিউইয়র্কে৷ সংগঠনটি নিজেদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তঃধর্মীয় বেসরকারি সংস্থা মনে করে৷ জার্মান সরকারের আর্থিক সহায়তায় ২০১৯ সাল থেকে জার্মানির লিন্ডাও শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করছে আরএফপি৷
ছবি: Christoph Strack/DW
জার্মানিতে আন্তঃধর্মীয় সম্মেলন
প্রতি দুই বছরে একবার জার্মানির লাইপসিশে বিভিন্ন ধর্মের শীর্ষ নেতৃবৃন্দদের নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ এতে প্রোটেস্ট্যান্ট, ক্যাথলিক, রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ, ইহুদি, মুসলিম, বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মের প্রতিনিধিরা অংশ নেন৷
ছবি: DW
বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথার আদান-প্রদান
২০০২ সালে ইহুদি বন্ধু ও খ্রিস্টান এক কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ‘ইন্টারফেইথ ইয়ুথ কোর’ গঠন করেছিলেন এবু প্যাটেল নামের এক মুসলিম যুবক৷ লক্ষ্য ছিল, বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীর মধ্যে কথা আদান-প্রদান করা৷ এছাড়া ক্ষুধার্তদের খাওয়ানো ও শিশুদের পড়াশোনা করানোর কাজগুলোও একসঙ্গে করতেন তারা৷ সংগঠনটি ‘ইন্টারফেইথ অ্যামেরিকা’ নাম ধারণ করে এখনও সক্রিয় আছে৷ তাদের লক্ষ্য, আন্তঃধর্মীয় সহযোগিতাকে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত করা৷
ছবি: Stephen Shugerman/Getty Images
9 ছবি1 | 9
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩২টি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে পাঁচটি। এ ছাড়া অন্যান্য ঘটনা ঘটেছে ১৪টি।
সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘বিগত বছরগুলোর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সহিংসতার ঘটনার খুব বেশি হেরফের আজও হয়নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘু ছিল প্রায় ১৯ শতাংশ, এখন তা ৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার পরিবেশ একেবারেই সংকুচিত করা হয়েছে। পুলিশি প্রহরায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে।''
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলাকালে সন্ত্রাসীদের কাউকে জনগণ আটক করলে পুলিশ-প্রশাসন তাকে ‘পাগল' বানিয়ে মূলত সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেই উৎসাহিত করে বলেও দাবি করেন রাণা দাশগুপ্ত৷
তিনি বলেন, ‘‘সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তি রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, রাজনীতি, সমাজসহ সর্বক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে। তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অধিকতর নিরাপত্তাহীন ও আস্থাহীন করে তুলছে। কৌশলে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে।''
বগুড়ার রথযাত্রায় পূণ্যার্থীদের মৃত্যুর প্রসঙ্গে রাণা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত।'' তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন পরিষদের অন্যতম সভাপতি নিমচন্দ্র ভৌমিক ও নির্মল রোজারিও, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ ও ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক শুভ্র দেব কর।