বাংলাদেশে দুর্গাপূজায় বিভিন্ন জেলায় পূজা মণ্ডপে ও হিন্দুদের বাড়িতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের স্থানীয়ভাবে সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন৷ সরকারের দিক থেকে এখনও আর্থিক ক্ষতির হিসাব নিরূপণের কাজ চলছে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী, ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় আটটি মন্দিরে হামলার পর দেশের ২৩ জেলায় শতাধিক মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে৷ সমপরিমাণ বাড়িঘরে হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে৷ তবে তারা এর আর্থিক ক্ষতি নির্ণয় করেননি৷
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত জানান, তারা এখনো ক্ষয়-ক্ষতি নিরুপণের কাজ করছেন৷ আরো দুই-তিনদিন পর পুরো চিত্র জানাতে পারবেন৷ তিনি এর আগে ১৮ অক্টোবর জানিয়েছিলেন, ২০টি জেলায় প্রায় ৪২টি স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷ মারা গেছেন চারজন৷ রোববার তিনি জানান, এরপর আরো হামলার ঘটনা ঘটেছে৷
নির্মল কুমার চ্যাটার্জি
১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জ রামনাথপুর ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে হামলাকারীদের দেয়া আগুনে পুড়ে যায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি৷ সেখানে অনেকে বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন৷ বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ঘরবাড়ি করে দেয়ার কথা বলেছেন৷ রংপুরে সমস্যা হবে না৷ সেখানে সহায়তা দেয়া হচ্ছে৷ অন্যান্য জায়গায় এখানো পুরোমাত্রায় শুরু হয়নি৷ তবে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও সহায়তা করছেন৷ নারায়ণগঞ্জ থেকে ৫০ লাখ টাকা পঠানো হয়েছে রংপুরের জন্য৷ এখন প্রয়োজন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করে সহায়তা দেয়া৷’’
এদিকে কয়েকটি জেলার ডিসিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে সরকারের নির্দেশে তারা কমিটি করে ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয়ের চেষ্টা করছেন৷ সেটা করার পর প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিবেন৷ নোয়াখালী জেলার ডিসি মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান বলেন, ‘‘আমরা একটি কমিটি করে দিয়েছি তারা প্রাথমিকভাবে ক্ষয়-ক্ষতির একটা হিসাব করেছেন ৷ এখন সেটা আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি৷ চূড়ান্ত করার পর মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠাবো৷’’
তিনি জানান, তবে এরইমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাথমিক সহায়তা দেয়া হয়েছে৷ ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলোকে ৫০ হাজার করে টাকা এবং ৫ মেট্রিক টন করে চাল দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে পাঁচ হাজার করে টাকা, খাদ্য সহায়তা এবং ঢেউটিন দেয়া হয়েছে৷ অন্যান্য জেলায়ও ডিসিরা সরকারি তহবিল থেকে প্রাথমিক সহায়তা করছেন৷
‘পুরো ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করে আমরা আরো যে সহায়তা লাগে তা দেবো’
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, ‘‘রংপুরের পীরগঞ্জে যেদিন রাতে হামলা হয়েছে তার পরের দিন ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ১০০ বান্ডিল টিন, গৃহ নির্মাণের জন্য তিন লাখ টাকা, নগদ সাড়ে ছয় লাখ টাকা, শড়ি, লুঙ্গি এবং কম্বল বিতরণ করেছি৷ পীরগঞ্জে ১৮টি ঘর পুড়েছিলো সবই নতুন করে তৈরি করে দেয়া হয়েছে৷’’
এর বাইরে কুমিল্লা এবং নোয়াখালীতে সহায়তা দেয়ার কথা জানান তিনি৷ নোয়াখালীতে দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫০ মেট্রিক টন চাল এবং পাঁচ লাখ টাকা নগদ দেয়া হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন পুরো ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করে আমরা আরো যে সহায়তা লাগে তা দেবো৷ পীরগঞ্জে প্রত্যেকটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ঘর তৈরি করতে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে৷ যেসব ছাত্র-ছাত্রীর বই পুড়ে গেছে তাদের বই কিনে দেয়া হয়েছে৷ ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷’’
ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ ফরিদুল হক খান জানিয়েছেন, সরকার থেকে পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলো তৈরি করে দেয়া হবে৷ ‘‘আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব তৈরি করে দেব৷ কিন্তু সবগুলো পারবো বলে মনে হয় না৷ কারণ তাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লাগবে,’’ বলেন তিনি৷
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কতগুলো মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের কাগজপত্র না দেখে বলা যাবে না৷
হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা পরিক্রমা
কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কোরআন পাওয়া যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে৷ ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি কোরআনটি সেখানে রেখেছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
কুমিল্লায় শুরু
১৩ অক্টোবর বুধবার দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লার নানুয়া দীঘি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে চকবাজার এলাকায় (কাপুড়িয়াপট্টি) শত বছরের পুরনো চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরে সকাল ১১টায় প্রথম হামলা হয়৷ এর আগে সকালে পূজা মণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন উদ্ধার করেন কোতোয়ালী থানার ওসি আনোয়ারুল আজিম৷ কোরআন রাখার অভিযোগে ইকবাল হোসেন (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
অন্যান্য জেলায় হামলা
কুমিল্লা ছাড়াও একইদিন চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ভোলা, চট্টগ্রাম, ও কক্সবাজারে হামলা হয়েছে বলে ১৬ অক্টোবর জানায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ৷ এছাড়া ১৪ অক্টোবর বান্দরবান ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হামলার ঘটনা ঘটে৷ আর ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর চৌমুহনী ও চট্টগ্রামে হামলা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
তিন দিনে ৭০ মণ্ডপে হামলা
১৬ অক্টোবর শনিবার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানায়, দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন দিনে ৭০টি পূজা মণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে৷ এসবের বাইরে ৩০টি বাড়ি এবং ৫০টি দোকানেও ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
ফেনীতে হামলা
মন্দিরে মণ্ডপে হামলার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের আহ্বানে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছিল৷ ফেনীতে সেই কর্মসূচির প্রস্তুতি চলার সময় হামলা হয়৷ এরপর শহরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়৷ কয়েকটি মন্দির ও হিন্দুদের মালিকানাধীন বেশ কিছু দোকানপাটে ভাঙচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ পাওয়া যায়৷ বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ফেনীতে থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
রংপুরের পীরগঞ্জে হামলা
১৭ অক্টোবর রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের এক হিন্দু তরুণের ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে রামনাথপুর ইউনিয়নে জেলেপল্লির হিন্দু পরিবারের উপর হামলা হয়৷ হামলাকারীরা ঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটপাটও করে৷
ছবি: bdnews24.com
নয় বছরে ৩,৬৭৯ হামলা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর তিন হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে এক হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা৷ ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা৷ আর প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৬৭৮টি৷ এসব হামলায় আহত হয়েছেন ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী৷ নিহত হয়েছেন ১১ জন৷
ছবি: Tarun Chakraborty Bishnu
প্রতিবাদ
সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে৷ শাহবাগের আন্দোলনকারীরা তিন দফা দাবি পূরণ করতে সরকারকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছেন৷ দাবিগুলো হলো, দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে দোষীদের বিচার; ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আহত ও নিহতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
হিন্দুদের প্রতিবাদ
সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ১৮ অক্টোবর সোমবার হিন্দুদের প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়েছে৷
ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP/picture alliance
জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ
কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে ১৫ অক্টোবর শুক্রবার জুমার নামাজের পর ‘মালিবাগ মুসলিম সমাজ’ এর ব্যানারে ঢাকার বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করেন কয়েকশ মানুষ৷ কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ের কাছে পুলিশ বাধা দিলে মিছিলকারীরা দুই ভাগ হয়ে যান৷ তাদের একটি অংশ বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে শুরু করে৷ পুলিশ তখন বিভিন্ন গলির মুখে অবস্থান নেয় এবং টিয়ারশেল ও শটগানের গুলি ছোঁড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বিক্ষোভ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ব্যানারে প্রায় দশ হাজার মুসলিম ১৬ অক্টোবর শনিবার বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভ করেন৷ ইসলাম অবমাননার অভিযোগে তারা এই বিক্ষোভ করেন৷
ছবি: Abdul Goni/AP Photo/picture alliance
মাশরাফির প্রতিক্রিয়া
সোমবার ফেসবুকে পীরগঞ্জে হামলার ছবি শেয়ার করে মাশরাফি লেখেন, এই ঘটনা তার হৃদয় ভেঙে চুরমার করেছে৷ ‘‘এ লাল সবুজতো আমরা চাইনি৷ কতো কতো স্বপ্ন, কতো কষ্টার্জিত জীবন যুদ্ধ এক নিমিষেই শেষ৷ আল্লাহ আপনি আমাদের হেদায়েত দিন৷’’
ছবি: Facebook
১০২ মামলা, গ্রেপ্তার ৫৮৩
হিন্দুদের মন্দির, মণ্ডপ, প্রতিমা ও বাড়িঘরে সাম্প্রদায়িক হামলায় শুক্রবার পর্যন্ত ১০২টি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস৷ হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৫৮৩ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্যও দিয়েছে তারা৷