বাংলাদেশে উত্সাহ উদ্দীপনা এবং ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর৷ এই উত্সব সার্বজনীন উত্সবে পরিণত হয়েছে৷ আর ধনী গরিবের এক কাতারে নামাজই শুধু নয় তাদের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনাও ঈদের উদ্দেশ্য৷
বিজ্ঞাপন
ঈদের দিনেও রিকশা চালাতে হয়েছে মো. শাহ আলমকে (৪২)৷ রংপুরের মঙ্গা প্রবণ এলাকা থেকে ঢাকায় এসেছেন ৫ বছর আগে ৷ থাকেন বসিলা এলাকার বস্তিতে৷ ৪ ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সংসার৷ স্ত্রী জাহানারা বেগম গৃহকর্মীর কাজ করেন৷ আর তিনি রিক্সা চালান৷ এতে তাঁদের ৬ জনের সংসার কোনোভাবে চলে যায়৷ কিন্তু ঈদ-কোরবানির মত বড় কোনো উত্সবে তাঁরা পড়েন বিপাকে৷
‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’
সত্যিই তাই, ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে৷ বাংলাদেশ, ভারত, জার্মানি কি গোটা বিশ্ব৷ ঈদের আনন্দে উচ্ছ্বসিত গোটা মুসলিম সম্প্রদায়৷ তাদের উৎসবে সঙ্গী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ঈদ মুবারক
প্রায় এক মাস রোজা পালনের পর আসে ঈদ-উল-ফিতর৷ মুসলমানদের দুটি বাৎসরিক ঈদ উৎসবের একটি এটি৷ এই দিনটি তাই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই ভালোভাবে উদযাপনের চেষ্টা করেন৷ ঢাকায় শুক্রবার ঈদের জামাতে অংশ নেয়া এক নারীর ছবি এটি৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
জাতীয় মসজিদে ঈদের জামাত
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জাতীয় মসজিদে একাধিক ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়৷ ৯ই আগস্ট ঈদের দিন তোলা এই ছবিটি জাতীয় মসজিদের৷ মুসল্লিদের সুবিধার্থে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাধিক ঈদের জামাতের আয়োজন করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চাঁদ দেখে দিন নির্ধারণ
সাধারণত আরব এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে ঈদ উদযাপনের একদিন পর বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ঈদ পালন করা হয়৷ এই ধর্মীয় উৎসবের দিন নির্ধারণ করা হয় চাঁদ দেখার ভিত্তিতে৷ ছবিতে ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লির ঐতিহাসিক জামা মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ছেন মুসলমানরা৷
ছবি: Reuters
গান দেয় পূর্ণতা
পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল, বিশেষ করে বাংলাদেশে ঈদের একটি গান অত্যন্ত জনপ্রিয়৷ ঈদের আগের রাত থেকে টেলিভিশন, রেডিও থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের দোকান, মার্কেট সর্বত্র বাজতে শুরু করে, ‘‘...রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ৷’’ এই একটি গানই ঈদ-উল-ফিতরের জানান দিতে যথেষ্ট৷ ছবিতে কলকাতার ঈদ জামাতে অংশ নেওয়া মুসলিম নারীদের দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP
কবি নজরুলের কালজয়ী গান
উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় ও আনন্দের উৎসব ঈদ-উল-ফিতর নিয়ে বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী গান৷ বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবের আবশ্যকীয় অংশ৷ কবির শিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ-এর অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি নজরুল এই গান রচনা ও সুরারোপ করেন৷’’
ছবি: Noah Seelam/AFP/Getty Images
সবার বাড়িতেই দাওয়াত
ঈদের দিন প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যেতে প্রয়োজন হয় না কোন দাওয়াতের৷ আধুনিক শহুরে জীবনে প্রতিবেশীদের মধ্যে তেমন সখ্যতা না থাকলেও ছোট শহর, মফস্বল আর গ্রামে ঈদের জামাতের পরই প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে যান ছেলে, বুড়ো সবাই৷ কারো বাড়িতে ঈদের পায়েস, কারো বাড়িতে মাংস-পরোটা কিংবা পোলাও – ঈদের দুপুরটা এভাবেই কেটে যায়৷ ছবিতে কলকাতায় ঈদের জামাত শেষে মিষ্টি কিনছেন মুসল্লিরা৷
ছবি: picture-alliance/AP
দিনের বেলা বিক্রি নয়
ঈদ-উল-ফিতর এর আগের একমাস বাংলাদেশে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে খাবার বিক্রি একরকম বন্ধই থাকে৷ রাস্তার পাশের খাবার হোটেলগুলো ঢেকে দেওয়া হয় কালো পর্দায়৷ তবে সূর্যাস্তের খানিক আগে থেকে শুরু হয় খাবার বিক্রি৷ ঢাকায় তোলা এই ছবির মতোই ইফতারির পসরা সাজিয়ে রাস্তার পাশে বসেন অসংখ্য দোকানি৷ বিক্রিও হয় প্রচুর৷ ঈদের দিন থেকে পরের এগারো মাস আর এই বাণিজ্য দেখা যায়না৷
ছবি: dapd
লম্বা প্রস্তুতি
রমজানের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মূলত ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয়৷ নতুন পোশাক কেনার জন্য মার্কেটে ভিড় করেন মুসলমানরা৷ এ সময় দোকানগুলোতে দেখা দেয় উপচে পড়া ভিড়৷ আফগানিস্তানসহ অনেক দেশে দোকানিরা ঈদ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন বিশেষ অফার দিয়ে থাকেন৷ মিষ্টি এবং শুকনো ফল ঈদ উপহার হিসেবে আফগানিস্তানে বেশ জনপ্রিয়৷
ছবি: DW/I. Spezalai
যানবাহনে ভিড়
রমজানের শেষ সপ্তাহে যানবাহনেও সৃষ্টি হয় ব্যাপক ভিড়৷ এ সময় পরিবার, পরিজনের সঙ্গে ঈদ করতে শিকড়ের টানে ঢাকা ছাড়েন অনেক মানুষ৷ ঈদের ছুটিও বেশ লম্বা হয়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: dapd
পরিবারের সঙ্গে প্রার্থনা
জার্মানিতে ঈদের সকালে সাধারণত পুরো পরিবারই মসজিদে চলে যান৷ অধিকাংশ মসজিদে নারীর নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে৷ আর নামাজের পর সবাই মিলে মসজিদেই ঈদের খাবার খান৷ এরপর বাংলাদেশসহ অন্য অনেক দেশের মতো জার্মানিতেও কবরে পরিদর্শনে যান অনেক মুসলমান৷ ঈদের দিন পরিবারের মৃত সদস্যের কবর জিয়ারত করেন তারা৷
ছবি: Barbara Sax/AFP/Getty Images
উৎসব একই, নাম অনেক
জার্মানিতে ঈদ মূলত ‘বায়রাম’ অথবা ‘সুকারফেস্ট’ নামে পরিচিত৷ বায়রাম শব্দটি এসেছে তুরস্ক থেকে, এর অর্থ ছুটি৷ আর সুকারফেস্ট-এর বাংলা অর্থ হচ্ছে মিষ্টি উৎসব৷ তবে মুসলমানদের অন্যতম এই ধর্মীয় উৎসবটি বাংলাদেশ, ভারতসহ আন্তর্জাতিকভাবে ঈদ-উল-ফিতর হিসেবেই পরিচিত৷
ছবি: MUSTAFA OZER/AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
তিনি যেমন ঈদের দিন সকালেই রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছেন৷ তাঁর স্ত্রীও সকালেই কাজে বেরিয়েছেন৷ তাঁদের জীবনে ঈদ বাড়তি কোনো সুখবর বয়ে আনেনা৷ শাহ আলম বললেন, বরং এক ধরনের কষ্ট তাঁদের ওপর চেপে বসে৷ কারণ তাঁদের সন্তানদের তাঁরা তেমন কিছুই দিতে পারেন না ঈদে৷ অথচ যাত্রীদের সঙ্গে দামি পোশাক আর বাজারের বোঝা বয়েছেন৷ বাইরে থেকে দেখছেন আলো ঝলমলে দোকানপাট৷ যেখানে তাঁরা ঢোকারও সাহস করেন না৷ এই বেদনার কথা একজন শাহ আলমেরই শুধু নয়৷ ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এরকম অন্তত ৮ কোটি শাহ আলম পাওয়া যাবে৷
দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামায়াত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়৷ এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ সেই জামায়াতের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বললেন, ঈদের আদর্শ এক দিনের জন্য নয়৷ সারা বছরের জন্য৷ ধনী-গরিবের বৈষম্য কমানোর কথা বলে ঈদ৷ আর বলা হয়েছে ধনীর সম্পদে আছে গরিবের অধিকার৷ তাহলে এই ঈদে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনা কেন?
জবাবে তিনি বলেন, ঈদ উত্সব করা আর তার আদর্শকে ধারণ করা এক জিনিস নয়৷ ঈদে দামি পোশাক আর বিলাসব্যসন যেমন একদিকে, অন্যদিকে এক শ্রেণির মানুষের আছে না পাওয়ার বেদনা৷ এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না৷ ঈদ উত্সবের নামে সম্পদের উত্কট প্রকাশ ইসলাম সমর্থন করেনা৷ তাঁর মতে, ঈদ যেখানে অসাম্য দূর করবে, সেখানে কখনো কখনো ধনী গরিবের পার্থক্য আরো তীব্রভাবে প্রকাশ পায়৷ যা ইসলাম সমর্থন করে না৷ ইসলাম মনে করে ধনীর সম্পদে আছে গরিবের অধিকার৷
সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে এখন ৩১.৫ ভাগ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে৷ আর এই সংখ্যা হল ৫ কোটিরও বেশি৷ আর এদের মধ্যে বড় একটি অংশ হতদরিদ্র৷ তবে এই দারিদ্র্য সীমার উপরে বড় একটি অংশ যারা নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত, তারাও তেমন ভাল নেই৷ উত্সব আয়োজনে তাঁরাও দরিদ্রদের মত সংকটে পড়েন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, এটা দুঃখজনক হলেও সত্য, যে ঈদ-কোরবানির মত উত্সব আয়োজনে আয় বৈষম্য বা ধনী-দরিদ্রের পার্থক্যটা নগ্নভাবে প্রকাশ পায়৷ কারণ যারা ধনী, তাদের বড় একটি অংশ তাদের সম্পদের প্রদর্শন করার সুযোগ পান এই সময়ে৷ তবে এও সত্য যে ইসলামের বিধি বিধানের কারণে এই সময়ে ধনীদের কিছু সম্পদ গরিবের কাছে যায়৷ তবে এতে সাম্য বা সমতা আসেনা৷
তিনি জানান, বাংলাদেশে এখন বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৯২০ ডলারের বেশি৷ কিন্তু এই মাথাপিছু আয় দিয়ে বাস্তব অবস্থা বোঝা যাবেনা৷ কারণ অল্প সংখ্যক মানুষের হাতে অধিকাংশ সম্পদ পুঞ্জিভূত৷ আর মাথাপিছু আয় হল জাতীয় আয়ের মাথা পিছু গড় হিসাব৷ তিনি বলেন, বণ্টন ব্যবস্থা ভাল না হলে মাথা পিছু আয় বাড়লেও আয় বৈষম্য কমেনা৷ গরীব মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়েনা৷ যাদের বেশি সম্পদ, তাঁদের ওপর বেশি কর আরোপ করে দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা এবং বাজার ব্যবস্থাকে দরিদ্রবান্ধব করলে এই পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব৷