সারা দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নিহতদের স্মরণে শোক
৩০ জুলাই ২০২৪
আজ ৩০ জুলাই সারাদেশে শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার৷ সোমবার ১৪ দলের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়৷
বিজ্ঞাপন
শোক উপলক্ষে জনগণকে কালো ব্যাজ ধারণ করার পাশাপাশি মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ সব উপাসনালয়ে নিহতদের জন্য বিশেষ প্রার্থনা করার আহ্বানও জানানো হয়েছে৷
তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সমমনাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকের কালো রঙের পরিবর্তে লাল রঙের ছবি ও পোস্টার শেয়ার করতে দেখা গেছে৷
মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রাণহানির ঘটনায় 'সন্তানের পাশে অভিভাবক' ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গেলে তাদের বাধা প্রদান করে পুলিশ৷ অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেয়া এক অভিভাবক জানান , তারা মাত্র ১০ মিনিটের জন্য সেখানে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশি বাধার মুখে তাদের সরে যেতে হয়৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) রমনা জোনের এডিসি মো. আকতারুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, অভিভাবকরা ডিএমপি থেকে অনুমতি না নেওয়ায় তারা অবস্থান কর্মসূচির পালন করতে দিচ্ছেন না৷
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে খুলনা নগরীর শিববাড়ি মোড় অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা৷ মঙ্গলবার (৩০ জুলাই ) সকাল সারে ১১টা থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করে শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান নেন৷
সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতায় কোটা সংস্কার আন্দোলন
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বাংলাদেশ৷ দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ কিন্তু সংঘাতময় পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন সাংবাদিকেরা৷ তাদের অভিজ্ঞতা নিয়েই এই ছবিঘর৷
ছবি: AFP
হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে
১৬ জুলাই দুপুরে ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সংঘর্ষের সময় সহকর্মী সমীর কুমার দে সহ যাই লাইভ করতে৷ শুরু হয় গোলাগুলি৷ আমাদের সামনেই একজন পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করছিলেন৷ পাল্টা গুলি ছোঁড়ে পুলিশও৷ আমাদের দিকে ধেয়ে আসে গুলি আর ইট-পাটকেল৷ নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না৷ ইটের একটি টুকরো এসে লাগে আমার বাম পায়ে৷ রক্তক্ষরণ আর প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে কাহিল আমি৷ অনেকক্ষণ পর নিজেদের নিরাপদ করতে পেরেছিলাম আমরা৷
ছবি: Harun Ur Rashid/DW
সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে
১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বরে জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা৷ চারদিকে ছিল পুলিশ আর বিজিবি৷ হঠাৎ শুরু হয় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, পাল্টা গুলি ছোঁড়ে পুলিশ ও বিজিবি৷ এমন দৃশ্য দেখা যায় না! আন্দোলনরতদের কয়েকজন মেট্টোরেলে স্টেশনে ভাঙচুর শুরু করে, আগুন ধরিয়ে দেয়৷ আমি তখন সেখানেই ছিলাম৷ যারা আগুন দিয়েছে, তাদের কাউকে আমার শিক্ষার্থী মনে হয়নি৷ তখন নিজেকে নিরাপদ করা ছিল খুব কঠিন৷
ছবি: Shamsul Hider Badsha
সাজ্জাদ হোসেন, আলোকচিত্রী, বাংলা ট্রিবিউন
১৮ জুলাই সায়েন্স ল্যাবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় ছবি তুলছিলাম৷ ফুটওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় সময় আন্দোলনকারীরা নিচ থেকে ঢিল ছুঁড়ে৷ পায়ে আঘাত পাই৷ দৌড়ে নামার সময় পেছন থেকে রড দিয়ে আঘাত করে৷ ব্যাগ থাকায় আঘাত পাইনি৷ কিন্তু পরে বাঁশ দিয়ে পায়ে আঘাত করে৷ শরীরে কিলঘুষি মারতে থাকে৷ ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে৷ ছবি মুছে দিতে বাধ্য করে৷ সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ছেড়ে দেয় তারা৷
ছবি: K M Asad
সাজ্জাদ হোসেন, আলোকচিত্রী
১৬ জুলাই ঢাকা কলেজ এলাকায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে চলছিল ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া৷ একজনকে মারধর করা হয়৷ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি৷ তাকে বাঁচানোর এগিয়ে যাই কয়েকজন৷ তাকে একটি ভ্যানে তুলে হাসপাতালে পাঠাই৷ রাতে এক সহকর্মী জানালো মারা গেছেন সেই আন্দোলনকারী৷ তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম৷ যদি সেটুকু না পারতাম সারা জীবন নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতাম৷ এখনও মাঝে মাঝে তার চেহারাটা ভেসে উঠে চোখের সামনে৷
ছবি: Mahmud Zaman Ovi
নাদিয়া শারমিন, একাত্তর টিভি
১৮ জুলাই দুপুরে যাত্রাবাড়ীতে সংঘর্ষের সময় পুলিশের দিকে আচমকা তেড়ে আসে আন্দোলনকারীরা৷ পুলিশ গুলি করতে করতে পিছিয়ে যায়, আমরাও পেছাতে থাকি৷ সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী রাশেদ৷ ওইসময় আমার গলার ডানদিকে, বাম বাহু ও ডান পায়ের পাতায় শটগানের ছররা গুলি লাগে৷ চিকিৎসার পর পা ও হাতের দুটি বেরিয়ে গেলেও গলারটি আটকে আছে৷ ভাইটাল নার্ভ থাকায় এখনই অপারেশন সম্ভব নয়৷ এতে প্যারালাইসিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে৷
ছবি: privat
রাশেদ, একাত্তর টিভি
নাদিয়ার সঙ্গে থাকা ক্যামেরাপারসন রাশেদেরও গলায় আঘাত করে একটি ছররা গুলি৷ প্রথম দফায় ঢাকা মেডিকেল এবং পরে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তারা৷ রাশেদের গুলিটি বের করে নেয়া সম্ভব হয়েছে৷ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন তিনি এখন বিপদমুক্ত৷
ছবি: privat
আরিফুর রহমান সবুজ, যমুনা টিভি
১৯ জুলাই সকালে যাত্রাবাড়ী পৌঁছাতেই মুখোমুখি হতে হয় ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার৷ সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থানায় আসে আট জনের রক্তাক্ত দেহ৷ তাদের কাউকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে, কারো মাথা থেঁতলে দেয়া হয়েছে ইট দিয়ে৷ তাদের সবাই ছিলেন পুলিশ সদস্য৷ কেউ কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন, কেউ আসছিলেন কাজে৷ আন্দোলনের এই সহিংস রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল তীব্র ঘৃণা৷ এমন অভিজ্ঞতা আর কখনও হয়নি৷
ছবি: privat
খাইরুল ইসলাম বাশার, সকাল সন্ধ্যা
সাত বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এমন পরিস্থিতিতে খুব কমই পড়তে হয়েছিল আমাকে৷ সংবাদমাধ্যমের উপর কখনো কখনো ক্ষুব্ধ ছিলেন আন্দোলনকারীরা৷ পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছিল আরেক আতঙ্ক৷ অনলাইন সংবাদমাধ্যমে কাজ করি, কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সংবাদ পাঠানোর সুযোগ ছিল না৷ মোবাইলে ফোন দিয়ে সংবাদ দিতে হয়েছে৷ কারফিউ দেয়ার পর ছিল না গণপরিবহণ৷ সবমিলিয়ে এটি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা৷
ছবি: Private
জুয়েল থিওটোনিয়াস, ডিবিসি নিউজ চ্যানেল
একপেশে সংবাদ প্রচারের অভিযোগে সংবাদকর্মীদের উপর চড়াও হয় আন্দোলনকারীরা৷ ১৮ জুলাই আমার নিজের অফিস ঘিরে রেখেছিলেন তারা৷ সেদিন সন্ধ্যা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন আমার সহকর্মীরা, অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন৷ আমি ছিলাম পেশাগত কাজে বাইরে। আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে টিয়ারশেলের ধোঁয়া সহ্য করতে হয়েছে প্রায় সব সংবাদকর্মীকে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমাকেও নিতে হয়েছে ধোঁয়ার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা৷
ছবি: Privat
তানভীর খন্দকার দিপু, ইনডিপেনডেন্ট টিভি, কুমিল্লা
আন্দোলনকে ঘিরে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আমার সাংবাদিকতা জীবনে দেখিনি৷ একদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, অন্যদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থান৷ দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি অবরুদ্ধ থাকায় তৈরি হয় জনদুর্ভোগ৷ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছিল অগুণতি গুজবের ছড়াছড়ি৷ ইটপাটকেল, লাঠিচার্জ, গুলি-টিয়ারশেল এড়িয়ে নিজেকে নিরাপদ রেখে ছবি ও সংবাদ সংগ্রহ ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং৷
ছবি: Privat
মাফুজ নান্টু, এনটিভি, কুমিল্লা প্রতিনিধি
১৮ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়িতে পুলিশ-শিক্ষার্থী মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়৷ গুলির খোসা আর ইট-পাটকেল ঢেকে যায় সড়ক৷ পুড়িয়ে দেয়া হয় পুলিশ ও বিজিবির গাড়ি৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিক্ষেপ করা হয় টিয়ারশেল৷ ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসে আমার৷ পথচারীরা আমাকে উদ্ধার করেন৷ সেদিনের সংঘর্ষে কেউ নিহত হয়নি৷ অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন৷ তাদেরকে নেয়া হয় ঢাকায়৷ আতঙ্কিত ছিল গোটা কুমিল্লা৷
ছবি: Privat
11 ছবি1 | 11
এদিকে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট জামায়াত–শিবিরকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার। আগামীকাল বুধবারের মধে এই দুইটি রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হবে। তিনি বলেন, 'সংগঠনগুলোকে কোন প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করা হবে তা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হবে।'
জোটের প্রধান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সোমবার (২৯ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী সরকারি বাসভবন গণভবনে এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়৷
একই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,‘বাংলাদেশে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, আসলে এটা কিন্তু রাজনৈতিক কিছু না, এগুলো সম্পূর্ণ জঙ্গিবাদী কাজ৷ এদের উদ্দেশ্য এখন বোঝা যাচ্ছে, কোটা কোনো ইস্যু না, একে একে যে কটা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের জনগণের সেবা দেয়, যে কটা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নত করে সেটা ধ্বংস করা’ বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)-র সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জুকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গতকাল সোমবার (২৯ জুলাই) দিবাগত রাতে তুলে নিয়ে গেছেন দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে৷ মিরপুরের ডিওএসএইচ এলাকা থেকে গতকাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়৷এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে এবি পার্টি৷