আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধ মামলার চতুর্থ রায় দেয়া হচ্ছে বৃহস্পতিবার৷ এই রায় হবে জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে৷ এ রায়কে সামনে রেখে শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের নিরাপত্তাই জোরদার করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ২০১০ সালের ২৯শে জুলাই৷ এরপর তাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখান হয় একই বছরের ২রা আগস্ট৷
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ সাত ধরণের মানবতাবিরোধী অভিযোগ আনা হয় কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে৷ ট্রাইব্যুনাল ২-এ গত ১৬ই এপ্রিল মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনসহ সব ধরণের কাজ শেষ হয়৷ রায়ের জন্য অপেক্ষমান এই মামলাটির রায় ঘোষণার দিন জানানো হয় বুধবার৷
কামারুজ্জামান শেরপুর অঞ্চলে হত্যা ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ৷ আর আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বরসহ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে৷ প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান যে, তারা আদালতে কামারুজ্জানের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছেন৷ তাই তারা আশা করেন, তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে৷
সাঈদীকে ফাঁসির রায়, জামায়াতের তাণ্ডব
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের একাধিক অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় বৃহস্পতিবার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এই রায় ঘোষণার পর গোটা বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত-শিবির৷ এতে হতাহত অনেক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ট্রাইব্যুনালের রায়
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের কথা বলা হয়েছে৷ কয়েকটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী ২০টি অভিযোগের ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে৷
ছবি: AP
রায়ের পরই তাণ্ডব
সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়াত-শিবির৷ শুধু বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৩৫ ব্যক্তি৷ বার্তাসংস্থা এএফপি এবং আমাদের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নিশ্চিত করেছে এই তথ্য৷ তবে শুক্রবার মৃতের সংখ্যা আরো বেড়েছে৷
ছবি: Reuters
আক্রান্ত পুলিশ
বৃহস্পতিবার জামায়াতের তাণ্ডবে প্রাণ হারান চার পুলিশ সদস্য৷ এদের মধ্যে তিনজন নিহত হন গাইবান্ধা জেলায়৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম জানিয়েছে, ‘পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে মারা হয় তাদের’৷ অপর একজন প্রাণ হারান চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় সংঘর্ষের সময়৷ বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আহত এক পুলিশ সদস্য শুক্রবার প্রাণ হারান৷ সবমিলিয়ে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর শুক্রবার দুপুর অবধি পুলিশ সদস্য নিহতের সংখ্যা ৫৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
‘অধিকাংশই জামায়াত-শিবির কর্মী’
জামায়াত দাবি করেছে, ‘‘পুলিশের গুলিতে তাদের ৫০ জন ‘নিরপরাধ’ সমর্থক নিহত হয়েছে৷ পুলিশ তাদেরকে ‘পাখির মতো গুলি করে’ হত্যা করেছে৷’’ তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান সুলতানা কামাল পুলিশের উপর সন্ত্রাসী হামলার জন্য জামায়াতকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষও
জামায়াতের তাণ্ডবে পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকও৷ তবে সাধারণ মানুষও মরছে এই তাণ্ডবে৷ ঢাকায় বৃহস্পতিবার প্রাণ হারান এক পথচারী, নোয়াখালি এবং বাঁশখালীতে নিহত হন হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তি৷ শুক্রবারও গাইবান্ধায় এক রিকশা চালক নিহত হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এবং জামায়াতের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষের মাঝে পড়ে৷ নিরীহ প্রাণহানির এরকম খবর আরো শোনা যাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘ফেসবুক বন্ধ’
সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার সময় বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার ব্যবহার করে স্বাভাবিক উপায়ে ফেসবুকে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘কারিগরি সমস্যার জন্য এমনটা হয়েছে’৷ তবে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তারা (বিটিআরসি) কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল এবং পুনরায় আবারো চালু করেছে৷’
সতর্ক নিরাপত্তা বাহিনী
জামায়াত-শিবির তাণ্ডব আর নাশকতা রুখতে গোটা দেশে সতর্ক রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা৷ বৃহস্পতিবার রাতেই বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি৷
ছবি: Reuters
ভিন্ন চিত্র
তবে সাঈদীর ফাঁসির রায়ে সামগ্রিকভাবে সন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ৷ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন শাহবাগে অবস্থানরতরা৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়৷ ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান অগুনতি মানুষ৷
ছবি: Reuters
‘শহীদের আত্মা শান্তি পাবে’
সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদি ও প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার৷ রায় ঘোষণার পরে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ায় দেশমাতৃকা কিছুটা পাপমুক্ত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির জন্য ৪২ বছরের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে৷’
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আরো রায় বাকি
এখন পর্যন্ত তিন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ বাকি আছে আরো যুদ্ধাপরাধীর বিচার৷ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি অপেক্ষায় আছে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখার৷ বর্তমান তরুণ প্রজন্মও তাই জেগে আছে প্রজন্ম চত্বরে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
২০১০ সালের ২৫শে মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর, এখন পর্যন্ত মট তিনটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে৷ প্রথম রায়ে জামায়াতের সাবেক নেতা মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে পলাতক অবস্থায় মৃতু্যদণ্ড দেয়া হয়৷ দ্বিতীয় রায়ে জমায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তৃতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে মৃতু্যদণ্ড দেয়া হয়৷ ২৮শে ফেব্রুয়ারি সাঈদীর মৃতু্যদণ্ডের রায় ঘোষণার পর, জামায়াত শিবির সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়৷ চার দিনের তাণ্ডবে তারা দেশের ২১টি জেলার পুলিশ স্টেশনগুলিতে হামলা, পুলিশের ওপর হামলা, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং তাদের বাড়িঘর ও উপসনালয়ে আগুন দিয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে৷ সে সময় সারা দেশে পুলিশসহ প্রায় ১০০ জন নিহত হন৷
সেই ত্রাসের ঘটনার পর বৃহস্পতিবার জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হচ্ছে৷ ব়্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কর্ণেল জিয়াউল আহসান ডয়চে ভেলেকে জানান, রায় ঘেষণার পর এবার আর তাণ্ডব সৃষ্টির কোনো সুযোগ দেয়া হবে না৷ তাই শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে৷ পুলিশ এবং ব়্যাব ছাড়াও গোয়েন্দা জাল বিস্তার করা হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে৷ আর ঢাকার ট্রাইব্যুনাল এবং আশপাশের এলাকা তিন স্তরের নিরপত্তার চাঁদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে বলে খবর৷
এদিকে, বুধবার সন্ধ্যা থেকেই শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে অবস্থান নিতে শুরু করেছে তরুণ প্রজন্ম৷ তারা সেখানে মাইক লাগিয়ে স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তুলছে শাহবাগ এলাকা৷ গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের একজন মারুফ রসূল ডয়চে ভেলেকে জানান, প্রতিটি রায়ের আগেই তাদের গণজাগরণ মঞ্চে সমবেত হওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা আছে৷ তারা সেই কর্মসূচি অনুযায়ীই সমবেত হয়েছেন৷ মঞ্চ সরিয়ে তাদের আন্দোলন থামানো যাবেনা বলেও জানিয়েছেন তিনি৷
উল্লেখ্য, গত ৫ই ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রতিবাদে এবং ফাঁসির দাবিতে শুরু হয় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ৷ তবে গত রবিবার রাতে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান ভেঙে দেয়ার পর, ভোররাতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের মঞ্চসহ সব স্থাপনা সরিয়ে নেয় পুলিশ৷