সার্বজনীন পেনশন স্কিম : যেমন হতে পারে, যেমন হওয়া ‘উচিত’
১০ জুন ২০২২অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা বলছেন সরকার যেটা বলছে, সেটা কন্ট্রিবিউটরি পেনশন, সার্বজনীন নয়৷
খসড়ায় এর নীতিমালা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়৷ বলা হয়েছে, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৫০ বছর, তারা এই পেনশন স্কিম খুলতে পারবেন৷ ১০ বছর ধারাবহিকভাবে চাঁদা জমা দেয়ার পর একজন মাসিক পেনশনের যোগ্য হবেন৷
এই পেনশনের মোটা দাগে নীতিমালাগুলো হলো :
১. বয়স ১৮ থেকে ৫০-এর মধ্যে হতে হবে
২. ধারাবাহিকভাবে ১০ বছর পেনশনের চাঁদা জমা দেয়া সাপেক্ষে মাসিক পেনশনের যোগ্য হবেন৷
৩. পেনশন পাবার বয়সসীমা ৬০ বছর৷
৪. পেনশনধারীরা আমৃত্যু পেনশন সুবিধা পাবেন৷
৫. বয়স ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে পেনশনধারীর নমিনি পেনশনধারীর বয়স ৭৫ বছর হওয়া পর্যন্ত পেনশন পাবেন৷
৬. পেনশনের টাকা মাসিক ভিত্তিতে পাবেন, এককালীন তোলার সুযোগ থাকবে না৷ তবে জমা করা টাকার শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত ঋণ পাবেন৷
৭. পেনশনের টাকা জমা দেয়ার মেয়াদ ১০ বছরের আগে জমাকারী মারা গেলে তার নমিনি সুদসহ জমা দেয়া টাকা পাবেন৷
৮. পেনশনের জন্য জমা দেয়া টাকা এবং মাসিক পেনশন আয়করমুক্ত থাকবে৷
৯. নিম্ন আয় সীমার নাগারিকদের পেনশনের মাসিক কিস্তির একটি অংশ সরকার দেবে৷
১০. পেনশনের জন্য প্রত্যেকের একটি একাউন্ট থাকবে ফলে চাকরি পরিবর্তন করলেও সমস্যা হবে না৷
১১. আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে সর্বনিম্ন মাসিক চাঁদার অতিরিক্ত টাকাও জমা দেয়া যাবে৷
১২. সরকারি ও সায়ত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা আপাতত এই পেনশন সুবিধা পাবেন না৷
১৩. বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা এই পেনশন সুবিধা পাবেন৷
১৪. নিয়মিত চাঁদা জমা না দিলে স্কিম স্থগিত থাকবে এবং জরিমানা ও কিস্তি শোধ করে নিয়মিত করা যাবে৷
সর্বনিম্ন মাসিক চাঁদা কত হবে, তার ভিত্তিতে মাসিক পেনশন কত পাওয়া যাবে তা নিয়ে এখন কাজ চলছে৷ তবে অর্থমন্ত্রী আ ন হ মোস্তফা কামাল গত ফেব্রুয়ারি মাসে একটি উদাহরণ দিয়ে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ তিনি জানান, ‘‘যদি মাসিক চাঁদা এক হাজার টাকা হয়, মুনাফা ১০ শতাংশ ও আনুতোষিক আট শতাংশ ধরা হয়, ১৮ বছর বয়সে যদি কেউ চাঁদা দেওয়া শুরু করে এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালু থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা করে পেনশন পাবেন৷ যদি ৩০ বছর বয়সে চাঁদা দেওয়া শুরু হয় এবং ৬০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, তাহলে অবসরের পর প্রতিমাসে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন৷’’
তবে চাঁদার পরিমাণ বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনও বেশি হবে৷
মন্ত্রী বলেন, ‘‘এটি একটি আনুমানিক হিসাব৷ আইন ও বিধি প্রণয়ন এবং পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার পর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে৷’’
এই পেনশন স্কিমের জন্য একটি কর্তৃপক্ষ থাকবে এবং তাদের ব্যয় সরকার বহন করবে৷
অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘‘সার্বজনীন পেনশন স্কিমে কোনো নাগরিককেই বাদ দেয়া যায় না৷ এটা রাষ্ট্রীয় একটি সেফটি নেটের মতো৷ করোনার পর এই সুরক্ষার বিষয়টি এখন বড় করে সামনে আসছে৷ সার্বজনীন করতে হলে যাদের সুনির্দিষ্ট আয় নেই বা আয় কম, তাদেরও এর মধ্যে রাখতে হবে৷ সর্বোচ্চ বয়স সীমাও থাকা উচিত নয়৷ আর এটা চূড়ান্ত করার আগে সবার মতামত নেয়া দরকার৷ কারণ, এখানে সরকার যে অংশ দেবে, সেখানে নাগরিকদের করের অর্থও থাকবে৷’’ তার কথা, ‘‘এখানে অর্থনীতির কাঠামো, চাপ নেয়ার ক্ষমতা- এইগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে৷’’
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদের কথা, ‘‘সরকার যেটা বলছে সেটা সার্বজনীন পেনশন নয়, কন্ট্রিবিউটরি পেনশন৷ কন্ট্রিবিউটরি হলে তো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমার বিপরীতে সরকার পেনশন দেবে৷ সরকারেরও অংশগ্রহণ থাকবে৷’’
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ মনে করেন, ‘‘এখনো এই পেনশনের পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি৷ আইন ও বিধিমালা হলে বোঝা যেতো কোথায় ত্রুটি আছে, কতটা সুবিধা আছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এর নীতি হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নাগরিকদের কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়৷ সর্বোচ্চ বয়সসীমা যদি ৫০ বেধে দেয়া হয়, তাহলে নাগরিকদের একটি অংশ বঞ্চিত হবেন৷ তাই এই স্কিমের শুরুতে সবাইকে অন্তর্ভূক্ত করার একটি নীতি থাকা উচিত৷ এই স্কিম নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে৷ সেগুলো নিয়ে কথা হবে৷’’
তবে তিনি এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, আলোচনা ও কথা বলার অনেক সুযোগ এবং দরকার আছে৷ সেটা করা হলেই সর্বজন গ্রহণযোগ্য হবে৷
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআইবি)-র প্রধান নির্বাহী ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, ‘‘স্কিমটি চালু হওয়া দরকার৷ চালু হলে এর সুবিধা-অসুবিধা বোঝা যাবে৷ তখন সংশোধনও করা যাবে৷’’
তার কথা, ‘‘সরকারের সার্বজনীন সেফটি নেটের মতো এটা নয়, এটা হবে কন্ট্রিবিউটরি৷ তবে এখানেও সবার অংশ নেয়ার সুযোগ থাকতে হবে৷ সেটা সরকার কীভাবে দেবে তার সঠিক পলিসি করা প্রয়োজন৷’’
‘‘আর এটা যেহেতু কন্ট্রিবিউটরি তাই সরকার একটা সর্বোচ্চ বয়স নির্ধারণ করছে, যাতে কন্ট্রিবিউশনের পর্যাপ্ত সময় থাকে৷ তাই আমরা যারা বুড়ো, তারা বাদ পড়ে যাবো৷ তবুও তারা পাক,’’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ৷
অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘‘২০২০ সালে দেশে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ, যা ২০৪১ সালে ৩ কোটি ১০ লাখ এবং ২০৬১ সালে ৫ কোটি ৫৭ লাখে দাঁড়াবে৷ প্রত্যাশিত গড় আয়ু বর্তমানে ৭৩ বছর, যা ২০৫০ সালে ৭৯ দশমিক ৯ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৪ দশমিক ৩ বছর হবে৷’’