আজকের সাহারা মরুভূমি এককালে সবুজ, উর্বর এক জনবসতি ছিল৷ আফ্রিকার দক্ষিণ অংশ থেকে আদি মানব এখান দিয়েই ইউরোপে রওয়ানা হয়েছিল৷ জার্মানির এক গবেষক ৪ দশক ধরে সেই অঞ্চলে কাজ করছেন৷
বিজ্ঞাপন
সাহারা মরুভূমির মাঝে এই এলাকা আয়তন প্রায় সুইজারল্যান্ডের মতো বড়৷ বাতাসের ধাক্কায় স্যান্ডস্টোন বা বেলেপাথরে ক্ষয়ের ফলে সেখানে অপূর্ব এক নিসর্গ সৃষ্টি হয়েছে৷ সরু খাদ, ছোট নদী ও অসংখ্য জলাধারে ভরা আশ্চর্য প্রকৃতি৷
বিশ্বের সবচেয়ে বড় মরুভূমির মাঝে এমন এক জায়গায় হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ ও প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে৷ এই এলাকাকে ঘিরে ভূ-বিজ্ঞানী স্টেফান ক্র্যোপলিন-এর উৎসাহ-ঊদ্দীপনার শেষ নেই৷ ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই অঞ্চল ও সেখানকার জলবায়ুর ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন৷ কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই এই বিজ্ঞানী অভিযানগুলির প্রস্তুতি নেন৷ অভিযানে যেসব নমুনা সংগ্রহ করেন, সেগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করেন৷ আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল থেকে আদি মানুষ কীভাবে সাহারা অঞ্চল হয়ে ইউরোপে এসেছিল, তা জানার চেষ্টা করছেন তিনি৷
নামিব মরুভূমিতে যাদের বাস
দিনের বেলা সূর্যের জ্বলন্ত আগুন, রাতে ঠিক সেইরকম ঠান্ডা, ওদিকে পানির চিহ্নমাত্র নেই: এমন দেশে মানুষ তো দূরের কথা, প্রাণীরা বাঁচে কী করে? প্রকৃতিই তার সমাধান জুটিয়ে দিয়েছে৷
ছবি: R. Dückerhoff
নামই যাদের উটপাখি
তারা যে মরুভূমিতে বাস করতে পারবে, সে তো জানাই কথা৷ উটপাখিরা উড়তে পারে না বটে, কিন্তু দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে স্বেদ কমাতে পারে, যার ফলে শরীর থেকে কম পানি ক্ষয় হয়৷ অন্যদিকে উটপাখিদের পানি খাবার দরকার পড়ে না; ঘাসপাতা যা খায়, তা থেকেই যথেষ্ট পানি পায়৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images/C. Hütter
জ্বর হলে আর গরম লাগবে কেন?
গেম্সবক আসলে একটি অরিক্স জাতীয় হরিণ৷ গরমের দিনে এরা শরীরের তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ১১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট অবধি বাড়াতে পারে৷ তাতেও এদের কিছু হয় না, কারণ এদের নাকে বহু ছোট ছোট শিরা-উপশিরা আছে, যেগুলো এদের রক্তকে ঠান্ডা রাখে৷ এদের শরীরের নীচের দিকটা সাদা, যার ফলে মাটির তাপ প্রতিফলিত হয়৷ এরা পানি পায় মরুভূমির শেকড়-বাকড় ও সামা নামের এক ধরনের তরমুজ থেকে৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
বহুরূপী হওয়ার সুবিধে
নামাকোয়া গিরগিটিরা রং বদলাতে পারে; কাজেই ভোরের ঠান্ডায় তাদের রং কালো হলেও, রোদ আর গরম যত বাড়ে, ততই তাদের রং হালকা হয়ে পড়ে, কেননা হালকা রং সূর্যের আলো বেশি প্রতিফলন করতে পারে৷ ভরদুপুর বেলা মরুভূমির বালি যখন তেতে আগুন হয়ে থাকে, তখন নামাকোয়া গিরগিটিরা ছোট-বড় পাথর কিংবা ঝোপে-ঝাড়ে বসে বালি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে৷
ছবি: R. Dückerhoff
লম্বা ঠ্যাংও কাজে লাগে
নামিব মরুভূমির পিঁপড়েদের পা প্রায় পাঁচ মিলিমিটার লম্বা৷ এই লম্বা ঠ্যাঙের ফলে পিঁপড়েদের শরীর যে উচ্চতায় থাকে, সেখানকার তাপমাত্রা বালি থেকে প্রায় ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কম৷
ছবি: DW/B. Osterath
মরুভূমিতে গরম? গর্তের মধ্যে থাকলেই পারো...
নামিব স্যান্ড গেকো বা বালিয়াড়ির টিকটিকি বালিতে গর্ত করে দিনেরবেলা তার মধ্যে থাকে, বেরোয় শুধু রাতে৷ পায়ের আঙুলগুলো জোড়া, কাজেই বালি সরাতে কোদালের মতো কাজ করে৷ চোখগুলো বড় বড়, যাতে রাতে শিকার ধরতে পারে৷ গায়ের চামড়া এত স্বচ্ছ যে, ভিতরে দেহযন্ত্রের কিছু কিছু অংশ দেখা যায়৷ সব মিলিয়ে গায়ের রংটা মরুভূমির বালির সঙ্গে মেলে – যা কিনা গা ঢাকা দিতে ভালো৷
ছবি: R. Dückerhoff
শাঁকচুন্নি
ইংরেজি নাম ড্যান্সিং হোয়াইট লেডি স্পাইডার, ল্যাটিন নাম লয়করকেস্ট্রিস আরেনিকোলা, আমরা নামিব মরুভূমির ভুতুড়ে মাকড়শা বলতে পারি৷ এরা গরম পছন্দ করে না, তাই বালির দেড় হাত নীচে বালি আর নিজের লালা মিশিয়ে বাসা তৈরি করে দিনের বেলাটা সেখানেই কাটায়৷ রোদ্দুরে বেরোয় না বলে এদের গায়ের রং ফ্যাকাশে৷
ছবি: R. Dückerhoff
নামিব বালিয়াড়ির কাঁকড়া বিছে
ইংরেজি নাম নামিব ডিউন স্কর্পিয়ন৷ এদের মেটাবলিজম বা বিপাকের প্রক্রিয়া এতই মন্থর যে, এরা মাসের পর মাস না খেয়ে থাকতে পারে৷ এদের শরীরের অক্সিজেন পরিবহণ প্রণালীও মানুষের থেকে স্বতন্ত্র – তাই এদের গরম লাগে না৷ বালির তিন মিটার নীচে গর্ত করে বাস করে, কাজেই গরম কোথা?
ছবি: R. Dückerhoff
বালিতে সাঁতার
নামিবের বালিয়াড়ির বালি এতোই মিহি যে ‘কোদালে নাক টিকটিকি’ সেই বালিতে সাঁতার দিতে পারে৷ গর্ত খোঁড়ারও দরকার হয় না, কেননা এই জীবটির নাকটাই কোদালের আকারের৷ বালিতে সাঁতার দেয় বলে এর নাকের ফুটোগুলো পিছন দিকে করে বসানো; তায় আবার সেগুলোয় এক ধরনের ঢাকনা লাগানো আছে, যাতে তাড়াহুড়োতে নাকে বালি না ঢোকে৷
ছবি: R. Dückerhoff
কুয়াশা খেকো পোকা
‘ফগ বাস্কিং বিটল’-এর একটি বিশেষত্ব হলো, তার পানি খাওয়া৷ ভোরবেলা বালিয়াড়ির উপর উঠে শীর্ষাসন করে দাঁড়ায়৷ ভোরের কুয়াশার বাষ্প জমে পানি হয়ে, সেই পানি এই পোকার পীঠ বেয়ে তার মুখে এসে পড়ে৷ কুয়াশা খেকো পোকা এভাবে একটি সকালে তার নিজের ওজনের ৪০ শতাংশ পানি সংগ্রহ করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Wildlife/M. Harvey
9 ছবি1 | 9
এ ক্ষেত্রে জলবায়ুর এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে৷ স্টেফান ক্র্যোপলিন গবেষণার কাজে ৬০টিরও বেশি অভিযান পরিচালনা করেছেন৷ এর মধ্যে ঔনিয়াগা এলাকার হ্রদগুলি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য৷ ৪ থেকে ১২ হাজার বছর আগে সাহারা অঞ্চল ছিল সবুজ ও উর্বর৷ সেখানে আরও বড় একটি হ্রদ ছিল৷ বর্তমানে তারই কিছু অংশ বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে রয়েছে৷
হ্রদের তলদেশে মাটির মধ্যে সেই যুগের জলবায়ুর খতিয়ান লুকিয়ে রয়েছে৷ তাই গবেষকদের দল সেখান থেকে অসংখ্য নমুনা সংগ্রহ করেছে৷ ড্রিলিং কোরের মধ্যে ধাপে ধাপে অতীত যুগের চিত্র ধরা পড়ে৷ ভূ-বিজ্ঞানী স্টেফান ক্র্যোপলিন বলেন, ‘‘এই ড্রিলিং কোর নিঃসন্দেহে গোটা সাহারা অঞ্চলের জলবায়ুর ইতিহাসের সেরা সংগ্রহ৷ আমি বলবো, গত ১১,০০০ বছরে গোটা আফ্রিকার সেরা সংগ্রহ৷ এমনকি গোটা বিশ্বে এর তুলনা মেলা ভার৷’’
সাহারা মরুভূমির রহস্যের জট খুলছেন জার্মান গবেষক
03:26
অতীত যুগের জলবায়ু সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন করতে স্টেফান ক্র্যোপলিন এনেডি মালভূমিতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর চিহ্নের খোঁজ করছেন৷ হাজার হাজার বছর আগে পাথরের উপর আঁকা ছবি এই এলাকায় মানুষের বসতির সাক্ষ্য বহন করে৷ সাহারা অঞ্চল তখন আর্দ্র, সবুজ ও জৈব বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল৷
সাহারাসম্পর্কে স্টেফান ক্র্যোপলিনের উৎসাহ-উদ্দীপনার শেষ নেই৷ নভেম্বর মাসে তিনি আবার সেখানে যাচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আবার স্থানীয় মানুষ ও উটের দলের সঙ্গে পাড়ি দেবার কথা ভাবলে রোমাঞ্চ হয়৷ পরিমিত জীবনযাপন সত্ত্বেও সেই নিসর্গে প্রতিটি প্রান্তের কোনো নতুনত্ব থাকতে পারে৷ সেটাই আমাকে টানে৷’’
স্টেফান ক্র্যোপলিন নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘‘কোলন আমার প্রিয় শহর, কিন্তু আফ্রিকা আমার স্বভূমি৷’’
টোমাস হিলডেব্রান্ট/এসবি
একটু পানির জন্য
মরক্কোতে সাহারা মরুভূমির কাছে প্রত্যন্ত ১৩টি গ্রামের মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে অভিনব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ জার্মানির এক ফাউন্ডেশন এতে সহায়তা করছে৷
ছবি: M. Gundlach
প্রত্যন্ত এলাকা
মরক্কোতে সাহারা মরুভূমির কাছে অবস্থিত ১৩টি গ্রামে প্রায় ৪০০ মানুষের বাস৷ গ্রামগুলো এতই প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত যে, সেখানকার বাসিন্দাদের পানির জন্য অনেক দূরে যেতে হয়৷ প্রতিদিন এই কাজে গড়ে অন্তত তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়৷ সাধারণত নারীরাই এই কাজটি করে থাকেন৷ তবে একটি প্রকল্প তাঁদের কষ্ট লাঘবের স্বপ্ন দেখাচ্ছে৷
ছবি: M. Gundlach
সমাধান কুয়াশা
এলাকাটি বছরের প্রায় ছ’মাস ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে৷ সেই কুয়াশাকে কাজে লাগিয়েই গ্রামবাসীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷
ছবি: M. Gundlach
কুয়াশা ধরতে জাল
পাহাড়ের উঁচুতে স্থাপিত বিশেষ জালে কুয়াশা আটকে পানি হয়ে ঝরবে৷ পানি ধরার জন্য থাকবে বড় বড় পাত্র৷ এরপর পাইপের মাধ্যমে তা পাহাড়ের নীচে অবস্থিত গ্রামগুলোতে সরবরাহ করা হবে৷ ঘন কুয়াশার সময় এক বর্গমিটার জাল থেকে দিনে প্রায় ২২ লিটার পানি পাওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা৷ ভিডিও দেখতে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: M. Gundlach
জার্মান সহায়তা
যে প্রযুক্তিতে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহ করা হবে তার নাম ‘ক্লাউডফিশার’৷ জার্মানির ভাসাস্টিফটুং ফাউন্ডেশনের প্রকৌশলী পেটার ট্রাউটভাইন এটি উদ্ভাবন করেছেন৷ মরক্কোর বেসরকারি সংস্থা ‘দার সি হামদ’ ঐ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ইতিমধ্যে প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কাজ শেষ করেছে৷ ফলে কিছু গ্রামের বাসিন্দারা এখনই তাদের ঘরে পানি পাচ্ছেন৷ কয়েকদিনের মধ্যে সবার জন্য পানির ব্যবস্থা করতে আরও জাল স্থাপনের কাজ শুরু হবে৷
ছবি: M. Gundlach
শিক্ষিত হচ্ছেন নারী
যে গ্রামগুলোতে ইতিমধ্যে পানি পাওয়া যাচ্ছে সেখানকার নারীদের প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সময় বেঁচে যাওয়ায় এখন তাঁরা লেখাপড়া শেখা থেকে শুরু করে অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে জড়িত হতে পারছেন৷ প্রকল্পের আওতায় তাঁদের শিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে৷
ছবি: Ane Nordentoft/Transterra Media
কাজের স্বীকৃতি
প্রকল্পটিকে সম্প্রতি জাতিসংঘের ক্লাইমেট চেঞ্জ পুরস্কার দেয়া হয়েছে৷ কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের এটিই সবচেয়ে বড় প্রকল্প বলে ধারণা করা হয়৷ জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফসিসির মুখপাত্র নিক নাটাল বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এ ধরনের অভিনব পরিকল্পনা সত্যিই এক দারুণ ব্যাপার৷’’