ঢাকা-কলকাতাসহ বিশ্বের বড় শহরগুলিতে জনসংখ্যার চাপে মানুষের বাসস্থান সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে৷ বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়িতে হাজার হাজার মানুষ কম জায়গায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন৷ সিঙ্গাপুরে একটি ভবনে প্রায় আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ৷ কিন্তু তার আয়তন সুইজারল্যান্ডের গ্লারুস জেলার মতো৷ এই দ্বীপরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলির মধ্যে অন্যতম৷ ফলে এই শহর বিশ্বের জনসংখ্যার ভবিষ্যৎ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার আদর্শ গবেষণাগার হয়ে উঠেছে৷ এখনই বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শহরাঞ্চলেই বসবাস করে৷
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দুই স্থাপত্যের প্রোফেসরের নেতৃত্বে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে ‘ফিউচার সিটিস ল্যাব’ নামের এক গবেষণাগার চালাচ্ছে৷ তাঁদেরই একজন সাখা মেনৎস৷ তিনি বলেন, ‘‘সুইজারল্যান্ডের তুলনায় এখানে নির্মাণের ঘনত্ব প্রায় ৩, ৫ বা ৬ গুণ বেশি৷ ফলে ভবিষ্যতে মানুষ এত কম জায়গায় কীভাবে বসবাস করবে, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হবে৷’’
কেন সিঙ্গাপুরে ঘুরতে যাবেন?
পরিচ্ছন্ন রাস্তা, অপূর্ব সুউচ্চ ভবন এবং আন্তর্জাতিক স্ট্রিট ফুড৷ ছবিঘরে দেখে নিন সিঙ্গাপুরে ঘুরতে যাওয়ার কিছু কারণ৷
ছবি: picture-alliance/Global Travel Images
মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেল
সিঙ্গাপুরের এই স্থাপত্যটির নিমার্ণশৈলী অপূর্ব এবং অসাধারণ৷ মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলকে সংক্ষেপে এমবিএস বলা হয়৷ এটি বর্তমানে সিঙ্গাপুরের নতুন ল্যান্ডমার্কে পরিণত হয়েছে৷ এটির উচ্চতা ২০০ মিটার, উপরে রয়েছে অসাধারণ একটি ছাদ৷ আর সেখানে আছে স্কাই পার্ক৷
ছবি: DW/A. Termèche
সিঙ্গাপুরের মাইলফলক
এই সিংহটি সিঙ্গাপুরের প্রতীকী প্রাণী৷ সংস্কৃতে ‘সিঙ্গা’ অর্থ সিংহ৷ বন্দরনগরীটি এশিয়ার মডেল নগরী হিসেবে গড়ে উঠেছে৷ এই মার্লিওন ভাস্কর্যটি একটি সিংহ, যার লেজটি মাছের মতো৷ এটি শহরের একটি ল্যান্ডমার্ক৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/G. Hellier
মেরিনা বে
‘স্টপ ওভার’ গন্তব্য হিসেবে সিঙ্গাপুর ভীষণ জনপ্রিয়৷ শহরটির বেশিরভাগ এলাকা হেঁটেই দেখা যায়৷ অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য হলো ‘মেরিনা বে’ বা মেরিনা উপসাগর৷ ছবির ডানদিকে পুরোনো ঔপনিবেশিক ভবনগুলো সুউচ্চ ভবনগুলোর সাথে পাল্লা দিতে পারেনি৷ বাঁ পাশে গড়ে উঠছে নতুন সিঙ্গাপুর, আছে মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেল, বিশাল শপিং মল এবং পদ্মফুলের আকৃতিতে আর্টসায়েন্স জাদুঘর৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/G. Hellier
আকাশছোঁয়া ছাদ
এমবিএ’র সবচেয়ে লোভনীয় বস্তুটি হলো এর অসাধারণ সুইমিং পুল৷ ৫৭ তলায় অবস্থিত এই পুলে যখন সাঁতার কাটবেন, মনে হবে পুরো সিঙ্গাপুর আপনার পায়ের নীচে৷ তবে এমবিএ-তে যদি একটি রুম বুক করে থাকেন, তবেই এখানে প্রবেশের সুযোগ মিলবে৷ আর এজন্য কেবল একটি সিঙ্গেল রুমের জন্যই আপনাকে কমপক্ষে গুণতে হবে ৩০০ ইউরো!
ছবি: picture alliance/robertharding
বাগানের শহর
সিঙ্গাপুরে অন্তত ৬০ লাখ মানুষের বাস৷ এশিয়ার সবুজতম শহর বলা হয় এটিকে৷ উপসাগরের পাশে বাগানগুলো শহরের সবুজ প্রকল্পের অংশ৷ স্কাইওয়ে বা এরিয়াল ওয়াকওয়েতে হাঁটলে উপর থেকে ১০১ হেক্টর কমপ্লেক্সের অসাধারণ সৌন্দর্য চোখে পড়বে৷ তবে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় রাতের বেলায়, যখন সুউচ্চ কৃত্রিম গাছগুলো আলোয় ঝলমল করে ওঠে৷
ছবি: DW/A. Termèche
বে সাউথ গার্ডেন
এখানকার পার্কে রয়েছে বিশাল দু’টি গ্রিন হাউস৷ বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ কাঁচের গ্রিন হাউস হিসেবে ফ্লাওয়ার ডোম গ্রিনহাউসটি বিশ্ব রেকর্ডের গিনেস বুকে স্থান করে নিয়েছে৷ ছোটটির নাম ‘ক্লাউড ফরেস্ট’৷
ছবি: DW/A. Termèche
সাগর তীরে এসপ্লানেড থিয়েটার
সিঙ্গাপুরে যেসব ভবন নির্মিত হয়েছে, সবগুলোতেই প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ এমনকি থিয়েটার বানানোর ক্ষেত্রেও৷ থিয়েটারটিতে ২০০০ আসন রয়েছে, একটি কনসার্ট হল রয়েছে ১৬শ আসনের এবং আছে একটি শপিং মল৷ এর আকৃতি ডুরিয়ান (বাংলাদেশের কাঁঠালের মতো) ফলের মতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H.-P. Lochmann
অরচার্ড রোড
সিঙ্গাপুরে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ কেনাকাটা৷ শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অভিজাত আর ঝলমলে শপিংমল৷ সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে এগুলো৷ সপ্তাহের সাতদিনই খোলা৷ এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় শপিং এলাকা হলো অরচার্ড রোড৷
ছবি: picture-alliance/dpa/How Hwee Young
চীনা নববর্ষ উদযাপন
সিঙ্গাপুরে বৌদ্ধ, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান সব ধর্মাবলম্বী শান্তিতে বসবাস করেন৷ তাই চায়না টাউন, লিটল ইন্ডিয়া বা আরব স্ট্রিট অবশ্যই ঘুরে দেখা উচিত৷ বিশেষ করে যখন চীনা নববর্ষ উদযাপন হয়, তখন এসব সড়ক জমজমাট হয়ে ওঠে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Morrison
ঐতিহ্য
বিশ্বের অন্যতম ধনী শহরহুলোর একটি হলো সিঙ্গাপুর৷ তবে শহরের যত চাকচিক্যই থাকুক না কেন, এখানকার মানুষ নিজেদের ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেননি৷ হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির, মসজিদ এবং চার্চগুলো এখানকার সংস্কৃতি আর প্রথার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/prisma
খাবারের দোকান
সিঙ্গাপুরের অধিবাসীরা খেতে ভালোবাসেন৷ যাঁরা বিভিন্ন অফিসে কাজ করেন, দুপুরের খাবারের সময় তাঁদের অনেকেই রাস্তায় খাবারের দোকানগুলো থেকে নানা ধরনের খাবার খেয়ে থাকেন৷ এখানকার স্ট্রিটফুড খুবই জনপ্রিয়৷
ছবি: Kyle Malinda-White/dpa/picture-alliance
11 ছবি1 | 11
সিঙ্গাপুরে নির্মাণের এমন ঘনত্ব সত্ত্বেও বিস্ময়কর মাত্রায় সবুজের সমারোহ দেখা যায়৷ দূরদর্শী নগর পরিকল্পনার কল্যাণেই এত গাছপালা রয়েছে৷ নিয়ম অনুযায়ী জমিতে নির্মাণকাজ চালালে কমপক্ষে তার প্রায় সমান এলাকা সবুজ করে তুলতে হবে৷
ঘনবসতির জবাব হিসেবে সিঙ্গাপুরে এমন সবুজ হাইরাইজ অট্টালিকা গড়ে তোলা হচ্ছে৷ জুরিখ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এমন বসতিতে মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে৷ তারা কি তাদের প্রতিবেশীদের চেনে? শহরের পরিবেশের উপর এমন সবুজ এলাকার প্রভাব কী? জীবনযাত্রার মানই বা কেমন?
‘ফিউচার সিটিস ল্যাব’-এর গবেষকদলের প্রধান টোমাস শ্র্যোপফার সপরিবারে এমনই এক ভবনে বসবাস করেন৷ ২০১৩ সালে ‘ইন্টারলেস’ নামের এই ভবনটি গড়ে তোলা হয়েছিল৷
এমন হাইরাইজ অট্টালিকা মোটেই আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে না, বরং ধাপে ধাপে গড়ে তোলা হয়েছে৷ বিভিন্ন স্তরে বাসিন্দাদের সব প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা হয়েছে৷ কমিউনিটি হল, সুইমিং পুল, বড় বড় উঠান গোটা ভবন জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে৷ গবেষকদলের প্রধান হিসেবে টোমাস শ্র্যোপফার বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে স্থপতিদের একাধিক দায়িত্ব রয়েছে৷ ঘনবসতি সত্ত্বেও কীভাবে বাসযোগ্য স্পেস সৃষ্টি করা সম্ভব? এত ঘন নির্মাণের নেতিবাচক প্রভাব ছাড়াই উচ্চ মানের জীবনযাত্রা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, আমার মতে ‘ইন্টারলেস’ তার এক দারুণ দৃষ্টান্ত৷ এক বিশাল ভবনের কাঠামোকে কীভাবে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করা যায়, ‘ইন্টারলেস’ ভবন থেকে তা শেখা যায়৷ প্রায় ৩,০০০ মানুষ বসবাস করা সত্ত্বেও সেখানে মানবিক মানদণ্ড অনুযায়ী বেশ মনোরম পরিবেশ রয়েছে৷ সবাই সেখানে নিজেকে সমাজ ও পাড়ার অংশ মনে করে৷ ইন্টারলেসে এই সব বিষয়গুলি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যায়৷’’
তবে সব ক্ষেত্রে যে এমন ভবনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখা যায়, এমনটা দাবি করা যায় না৷ সিঙ্গাপুরেই এর অনেক ব্যতিক্রম রয়েছে৷
মাইলি জেন/এসবি
সুন্দর নকশায় গড়ে তোলা কয়েকটি নগরী
বাসিন্দাদের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে নগর পরিকল্পনাবিদরা একটি শহরকে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করেন৷ এমন কয়েকটি সুন্দর নকশার শহরের কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Fotolia/asab974
সিঙ্গাপুর
সফল নগর পরিকল্পনার উদাহরণের কথা আসলে সিঙ্গাপুর সিটির কথা আসবেই৷ সেই ১৮১৯ সাল থেকে পরিকল্পনামাফিক সিঙ্গাপুরকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে৷ ব্যবহারযোগ্য নয় এমন জলাশয় এলাকায় শহর রাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছে৷ শহরের বিভিন্ন অংশকে এমন স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে, কোনো কাজে বাসিন্দাদের সেন্টারে যেতে হয় না৷ ঘনবসতিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পরিকল্পনা করে সেখানে সবুজের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ছবি: Fotolia/asab974
চন্ডিগড়
ব্রিটিশ শাসনামল শেষ হওয়ার পর ভারতে যতগুলো শহর পরিকল্পনা করে গড়ে তোলা হয় তার মধ্যে চন্ডিগড় একটি৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সবুজ শহর হিসেবে এর নাম রয়েছে৷ বিখ্যাত ফরাসি স্থপতি লে কোরবুজিয়ে শহরের পরিকল্পনা করেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Nanu
সৌল
১৩ শতকে সৌলকে রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল৷ সেটি এখনও চলছে৷ সম্প্রতি ‘২০৩০ সৌল প্ল্যান’ নামে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে৷ নাগরিকরা এর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/E. Jones
আমস্টারডাম
শহরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে বেশ কিছু খাল৷ বাসিন্দাদের চলাফেরার একটি অংশ এই খাল দিয়েই হয়৷ ১৬১৩ থেকে ১৬৫৬ সালের মধ্যে এ সব খাল তৈরি করা হয়৷ বর্তমানে শহরের মধ্যে গাড়ি চলাচলকে অনুৎসাহিত করা হয়৷ তাই সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে সুপরিকল্পিত গণপরিবহণ ব্যবস্থা৷ আছে সাইকেল চলাচলের জন্য বিশেষ রাস্তা৷
ছবি: picture-alliance/DUMONT Bildarchiv/T. Linkel
জুরিখ
গণপরিবহণের ক্ষেত্রে অনেকসময় বিশ্বের সবচেয়ে ভালো শহর বলে মনে করা হয় জুরিখকে৷ সেখানে বাস, ট্রেন, ট্রাম আর ফেরি এত সংখ্যায় এবং এত সময় মেনে চলে যে, গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না৷ শহরের নগর আর বিনোদনের এলাকা পৃথক রাখার চেষ্টা করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা৷
ছবি: Reuters
কোপেনহেগেন
২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হতে চায় শহরটি৷ তাই বায়ু বিদ্যুৎ, বায়োমাস জ্বালানি সহ অন্যান্য বিকল্প জ্বালানির সাহায্য নিচ্ছে শহর কর্তৃপক্ষ৷ এছাড়া শহরের সুয়েজ ট্রিটমেন্ট ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিরও উন্নতি করা হয়েছে৷ সাইকেল ও পায়ে হাঁটার পথ গড়ে তোলা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/Hans Ringhofe
ড্যুসেলডর্ফ
জার্মানির এই শহরটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকখানি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল৷ পরে দ্রুতগতিতে শহরকে পুনরায় গড়ে তোলা হয়েছে – যা এনেছে অর্থনৈতিক উন্নতি৷
ছবি: picture alliance/Blickwinkel/S
প্যারিস
ভালোবাসার শহর বলে পরিচিত ফ্রান্সের রাজধানীর নগর পরিকল্পনাও সবার কাছে শিক্ষণীয়৷ অবশ্য ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আগে পরিস্থিতিটা তেমন ছিল না৷ পরে ব্যারন হাউসমানের পরিকল্পনায় প্যারিসকে সাজানোর চেষ্টা করা হয়৷ এর আওতায় জনবসতিপূর্ণ এলাকা ভেঙে সেখানে প্রশস্ত রাস্তা, পার্ক, চত্বর ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়৷ আর বসবাসের জন্য শহরের পরিধি বাড়িয়ে সেখানে ভবন গড়ে তোলা হয়েছে৷