পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের জন্য সিঙ্গাপুর সরকার এবং সেদেশের শিল্পপতিদের কাছে আর্জি জানাতে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়৷ কিন্তু বৃহত্তর এক পরিকল্পনাও সম্ভবত রয়েছে তাঁর৷
বিজ্ঞাপন
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিন বছরে এই প্রথম মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিদেশ সফর এবং সেটাও লগ্নি আনার মতো একটা ‘থ্যাংকলেস' কাজের দায়িত্ব নিয়ে৷ একে রাজ্যে শিল্পায়নের মুখ চেয়ে কার্যত ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে এবং শিল্প পরিস্থিতি সম্পর্কিত তথ্য-পরিসংখ্যানের পাশাপাশি অনুনয়-বিনয়ের রাস্তাতেও তাঁকে হাঁটতে হচ্ছে৷ কিন্তু এর পরেও তিনি যদি বিনিয়োগ আনতে না পারেন, বা যথেষ্ট পরিমাণ লগ্নির সংস্থান না করতে পারেন, তা হলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিদ্রুপের নিশানা তো তাঁর সরকারকে হতে হবেই, উপরন্তু সামাজিকভাবেও তাঁকে সমালোচিত হতে হবে! ঠিক যেমনটা হতো আগে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে৷ একের পর এক মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা এমইউ সই হতো তখন, কিন্তু বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত আসত সামান্যই৷
কলকাতার হাতে টানা রিকশার একাল
কলকাতার কোনো কোনো জায়গায় এখনো হাতে টানা রিকশার চল রয়েছে৷ যদিও সংখ্যাটা দিনদিন কমছে৷ আর কতদিন থাকবে? চলুন জানার চেষ্টা করি এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
যবে থেকে শুরু
হাতে টানা রিকশার উদ্ভাবন ১৬ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, জাপানে৷ ১৯ শতকে যানটি গোটা এশিয়ায় বহুল ব্যবহৃত এক গণ-বাহন হয়ে দাঁড়ায়৷ ১৮৮০ সালে ভারতে প্রথম রিকশা চালু হয় হিমাচল প্রদেশের সিমলায়৷ সেখান থেকে হাতে টানা রিকশা চলে আসে কলকাতায়৷ ১৯১৪ সাল নাগাদ কলকাতায় ভাড়াটে রিকশার চলন হয়৷ এরপর এত বছর পরেও কলকাতার কোনো কোনো অঞ্চলে টিকে আছে এই হাতে টানা রিকশা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
প্রধান সড়ক থেকে গলিতে
কলকাতার প্রধান সড়কপথগুলোতে এখন অবশ্য আর রিকশা চলাচলের অনুমতি দেয় না পুলিশ৷ তার প্রথম কারণ রিকশার মতো ধীরগতির যানের কারণে রাস্তায় যানজট তৈরি হয়৷ তবে অন্য আর একটি কারণ হলো, আজকের দিনে রিকশার সওয়ারি হওয়া নিরাপদও নয়৷ ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই রিকশারা আশ্রয় নিয়েছে পুরনো কলকাতার গলি-ঘুঁজিতে, যেখানে ব্যস্ত ট্রাফিকের তাড়াহুড়ো নেই৷ রিকশায় চড়ে দুলকি চালে সফর করাও উত্তর কলকাতার অনেক বাসিন্দারই এখনও পছন্দসই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
এখনো ব্যবহারের কারণ
আধুনিক কোনো যন্ত্রচালিত যানের সঙ্গে গতি বা স্বাচ্ছন্দ্যে পাল্লা দিতে পারে না আদ্যিকালের রিকশা৷ তা-ও এটি কী করে কলকাতায় থেকে গেল, তার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে৷ এখনও অনেক বয়স্ক মানুষ রিকশা চড়তে পছন্দ করেন কারণ, এই যানটি তাঁদের জন্য যাকে বলে একেবারে হ্যাসল-ফ্রি৷ ঠিক একই কারণে অনেক বাড়ির বাচ্চারাও স্কুলে যাওয়ার সময় রিকশায় চড়ে যায়৷ তবে কলকাতা শহরে রিকশার সবথেকে বড় উপযোগিতা বোঝা যায় বর্ষায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
রিকশার ওয়ার্কশপ
যেহেতু শহরের রাস্তায় এখনও রিকশা চলে, মেরামতির জন্য রিকশার নিজস্ব হাসপাতালও নেই নেই করে এখনও দু-একটি টিকে আছে৷ এগুলো বিশেষভাবে হাতে টানা রিকশার মেরামতির জন্যই৷ অন্য কোনও কাজ এখানে হয় না৷ তবে আজকাল অসুবিধে হয়, কারণ রোজগার প্রতিদিনই কমছে৷ কাজ জানা লোকেরও অভাব৷ যদিও বা লোক পাওয়া গেল, তাদের দেওয়ার মতো যথেষ্ট কাজ পাওয়া যায় না৷ দোকানের মালিক শুয়ে বসেই দিন গুজরান করেন৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
কাঠ দিয়ে তৈরি চাকা
রিকশা তৈরি বা মেরামতিতে কিন্তু এখনও সেই পুরনো পদ্ধতিই বহাল৷ রিকশার চাকা যেমন এখনও কাঠ দিয়েই তৈরি হয়৷ মাঝখানের অংশটা যথারীতি লোহার, কিন্তু বাকি চাকার জন্য কারিগরদেরই জোগাড় করে আনতে হয় উঁচু মানের কাঠ যা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা শহরের খানা-খন্দে ভরা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে রিকশাকে গড়গড়িয়ে নিয়ে যাবে৷ সওয়ারিকে নিয়ে রিকশা যাতে ভেঙে না পড়ে, তার জন্য ভালো কাঠ বা লোহা যেমন দরকার, তেমনই দরকার ওস্তাদ কারিগর৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
খড় দিয়ে তৈরি বসার গদি
সওয়ারিদের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্যও রিকশাওয়ালারা সমান যত্নবান৷ যাত্রীদের বসার গদিটি যাতে ঠিকঠাক থাকে, এর জন্য নিয়মিত তার পরিচর্যা হয়৷ কাপড় আর রঙিন প্লাস্টিকের তৈরি এই গদির খোলে কী থাকে জানেন তো? না, তুলো বা ফোম নয়, নির্ভেজাল খড়৷ প্রকৃতি-বান্ধব উপাদান ব্যবহার করার এমন নমুনা কি আর কোনো শহুরে যানের ক্ষেত্রে দেখেছেন? রিকশা দূষণ ছড়ায় না, এটাও একটা খেয়াল রাখার মতো বিষয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
অমানবিক
তবু হাতে টানা রিকশা উঠে যাচ্ছে কলকাতা থেকে৷ কারণ, একজন মানুষ আর একজন মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এটা অনেকের কাছেই খুব অমানবিক মনে হয়৷ সাইকেল রিকশাতে যদিও একই ঘটনা ঘটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে চালক প্যাডেলের মাধ্যমে কিছুটা যান্ত্রিক সুবিধা পান৷ যদিও এই রিকশা নিয়ে রোমান্টিকতার কোনো শেষ নেই৷ পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির গোটা ক্লাইম্যাক্স সিনটিই গড়ে উঠেছে দুটি হাতে টানা রিকশার রেষারেষির মধ্য দিয়ে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
সময় কি বিদায় নেয়ার?
তাই দিনের শেষে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় যখন ছায়া দীর্ঘতর হয়, আর রাস্তার একধারে স্থবির হয়ে অপেক্ষায় থাকে সওয়ারি না পাওয়া একটি রিকশা, ব্যস্ত শহর তার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে তার কর্কশ কলরবে যেন বারবার মনে পড়িয়ে যায়, এবার সময় হয়েছে বিদায় নেওয়ার৷ আধুনিক সময়ের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না রিকশা৷ সে কারণেই রাজপথ থেকে সরে গিয়ে তাকে মুখ লুকোতে হয়েছে গলিতে৷ খুব শিগগিরই বোধহয় সেই আড়ালটুকুও যাবে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhayay
8 ছবি1 | 8
সম্ভবত সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধিদের একটি দলের এই সিঙ্গাপুর সফর নিয়ে খুব বেশি প্রচার সরকারের তরফ থেকে শোনা যায়নি৷ সংবাদমাধ্যমের এবং রাজনৈতিক মহলের কৌতূহল অবশ্যই ছিল, কিন্তু তাদেরও চাহিদা মেটেনি কারণ এই সফরসূচি নিয়ে বিস্তারিত খবর প্রায় কিছুই ছিল না, বরং এক ধরনের গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছিল৷ ফলে চর্চা বেড়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের নিয়ে, যেহেতু প্রতিনিধিদলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং বিভিন্ন দপ্তরের সচিবরা ছাড়াও রাজ্যের নির্বাচিত কিছু প্রথম সারির শিল্পপতির পাশাপাশি রয়েছেন বাংলা ছবির এক প্রযোজক এবং শাসকদলের নায়ক-সাংসদ দেব৷ জল্পনা তুঙ্গে ওঠে, তা হলে কি বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পে বিনিয়োগের খোঁজে বিদেশে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী!
সিঙ্গাপুরে সফরের প্রথমদিনে বিখ্যাত জুরং বার্ড পার্ক দেখতে গিয়েছিলেন মমতা৷ পার্ক দেখে দৃশ্যতই খুশি মমতা বলেন, পূর্ব কলকাতার রাজারহাটে তাঁরা যে ইকো টুরিজম পার্ক তৈরি করেছেন, সেখানে পাখির যে বিরাট খোলা খাঁচা করার পরিকল্পনা আছে, সেটি জুরং পার্কের ধাঁচেই গড়ে তোলা হবে৷ যে খবরে সমালোচনা তুঙ্গে ওঠে যে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তা হলে সিঙ্গাপুর গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷
কিন্তু সফরের দ্বিতীয় দিনেই সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুঙের সঙ্গে ৪০ মিনিট বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ সিদ্ধান্ত হয়, কলকাতায় সিঙ্গাপুর এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যৌথ উদ্যোগে একটি বিজনেস সেন্টার বা বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরি হবে৷ রাজ্যে সিঙ্গাপুর কোন কোন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত যে কোনো কাজে ওয়ান উইনডো সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে এই কেন্দ্র, জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র৷
এই কথার সূত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী৷ যদিও এখনও এই বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা শুরু হয়নি, কিন্তু রাজ্য সরকারের অভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ যে বিশ্বের বহু নামি-দামি ব্র্যান্ডের পণ্যের ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে সিঙ্গাপুরে এবং ওই সবকটি সংস্থার আঞ্চলিক সদর দপ্তর রয়েছে এখানেই৷ এমন ধরে নিলে সম্ভবত খুব ভুল হবে না যে রাজ্য সরকার ওই বিখ্যাত বহুজাতিক সংস্থাগুলির উৎপাদন কেন্দ্রের শাখা বা সহযোগী উৎপাদন কেন্দ্র যাতে পশ্চিমবঙ্গে খোলা যায়, তার জন্য উদ্যোগী হবে৷ এবং তাই যদি হয়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত কর্মসংস্থানের যে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷
এর পাশাপাশি রাজ্য সরকার নিজের বাকি হোমওয়ার্কও মন দিয়েই করেছে৷ ভারতে প্রতি বছর যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তার এক বড় অংশ আসে সিঙ্গাপুর থেকে৷ বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসকে আর্থিক দিক দিয়ে বেকায়দায় রাখার যে রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে, তাকে পাশ কাটিয়ে রাজ্যে লগ্নি টানার তাই একটাই পাল্টা কৌশল হতে পারে৷ সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগের কিছু অংশ সরাসরি পশ্চিমবঙ্গে টেনে আনা৷ নিঃসন্দেহে সেটা করতেই উদ্যোগী হয়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়৷
বুধবার সিঙ্গাপুরের চেম্বার অফ কমার্স-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের বৈঠক৷ মমতার সফরসঙ্গী শিল্পপতিরা সেই দিকেও বিপুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন৷