সিনাগগের ধ্বনি
৬ আগস্ট ২০১৩৩০ বছর আগে অর্গানবাদক ও সংগীত বিজ্ঞানী আন্দোর হাঙ্গেরি ছেড়ে পশ্চীমে পাড়ি জমান৷ তাঁর আশা ছিল জার্মানিতে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সিনাগগ সংগীত খুঁজে পাবেন৷ কিন্তু তাঁকে নিরাশ হতে হয়৷ মনে হয়, অর্গানে সঙ্গ দেয়া অসাধারণ বৃন্দসংগীতের অস্তিত্ব এ দেশে যেন কোনোদিনই ছিল না৷ কারণ ১৯৩৮ সালে নাৎসিরা সিনাগগ বা ইহুদি উপাশনালয়গুলি পুড়িয়ে ফেললে, তার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায় অধিকাংশ অর্গান ও স্বরলিপি৷
আন্দোর ইশাকের জন্ম ১৯৪৪ সালে, বুদাপেস্টের এক ইহুদি পরিবারে৷ ছোটবেলা থেকেই সিনাগগ সংগীতের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন আন্দোর৷ সংগীত গবেষণার শুরু থেকেই বুদাপেস্টে তথা ইউরোপের সবচেয়ে বড় ইহুদি উপাশনালয় ‘ডোহানি সিনাগগ'-এ অর্গান বাজান তিনি৷ গঠন করেন একটি বৃন্দদল৷ জার্মান এনএস বাহিনীর পতনের পর, এটাই প্রথম ‘অন্সাম্বেল' যা হাঙ্গেরিতে সিনাগগ সংগীত পরিবেশন করে৷ ইশাকের গবেষণার লক্ষ ছিল প্রায় বিলুপ্তির পথে যেতে থাকা এই সংগীতধারাকে আবারো পুনর্জীবিত করা৷ ১৯৮৩ সালে ইউরোপ সফরে তাঁর সিনাগগ সংগীত বিরাট সাফল্য পায়৷ সেই সাথে তিনি পান বহু সমর্থক, যাঁরা সিনাগগ সংগীতের জন্য একটি গবেষণা ও তথ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার পক্ষে সাড়া দেন৷
এর জন্য অবশ্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হয় আন্দোর ইশাককে৷ বছরের পর বছর বিশ্বের বহু দেশের বহু মানুষ, বিশেষ করে হলোকস্ট বা ইহুদি নিধনযজ্ঞে বেঁচে যাওয়া মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন এই সংগীতের বহু তথ্য, স্বরলিপি ও রেকর্ড৷ ১৯৯২ সালে জার্মানির হ্যানোফার শহরে ‘মুজিক হোখশুলে' বা সংগীত কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর জিউইশ মিউজিক' বা ইহুদি সংগীতের ইউরোপীয় কেন্দ্রে – জার্মান ভাষায় যার নাম ‘অয়রোপেইশে সেন্ত্রুম ফ্যুর ইউডিশে মুজিক' (ইজেডজেএম)৷
তার পরের বছরই স্থাপিত হয় এই সংগীতের শিক্ষা বিভাগ৷ ১৯১২ সালে এই কেন্দ্র ভিলা সেলিগমানে স্থানান্তরিত হয়৷ সেলিগমান ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ইহুদি শিল্পপতি৷ বিরাট এই ভিলায় স্থান পেয়েছে অমূল্য ও বিরল সব সম্পদ৷ সিনাগগ অর্গান, অডিও, পাণ্ডুলিপি, হাতে লেখা স্বরলিপি, বিভিন্ন সময়ের নানা গ্রন্থ এবং সেই সাথে একটি কনসার্ট রুম৷ জার্মানির রাইনল্যান্ড ফালসের একটি ক্যাথলিক গির্জায় আন্দোর খুঁজে পান ১৮৯৬ সালে নির্মিত, দেশটির একমাত্র সংরক্ষিত সিনাগগ অর্গান৷ কালের ইতিহাস নিয়ে তাও শোভা পাচ্ছে এই ভবনে৷ এ সবই এক সাথে একই ছাদের নীচে পেয়ে আন্দোর ইশাক মহা খুশি৷ তাঁর স্বপ্ন পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, হয়ে উঠেছে ব্যাতিক্রমধর্মী এক জাদুঘর৷
রক্ষণশীল ইহুদি সম্প্রদায় অবশ্য আজও জেরুসালেমের বিখ্যাত মন্দিরের ধ্বংসের কথা মনে করে উপাশনালয়ে অর্গান বা সংগীত পরিবেশনার বিরোধী৷ অন্যদিকে উদারপন্থী ইহুদিদের প্রার্থনার বিধিতে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই সংগীত পরিবেশনা স্থান পেয়েছে৷
১৮১০ সাল থেকে জার্মানির প্রায় দু'শোটি উদারপন্থী সিনাগগে ধ্বনিত হয়েছে অর্গান ও বৃন্দ সংগীতের সুরের মূর্ছনা৷ তবে ১৯৩৮ সাল নাগাদ নাৎসি আমলের বিধ্বংসী মনোভাব সেই ধ্বনি স্তব্ধ করে দেয়৷ ইশাক তিক্ততার সাথে বলেন, ‘‘এনএস বাহিনীর এই কাজটি যেন চিরস্থায়ী হয়ে উঠেছে৷ কারণ বর্তমানে নবগঠিত সিনাগগে অর্গান বা সংগীতের দিকটা মোটেই বিবেচনা করা হচ্ছে না৷ সিনাগগ সংগীত যেন দ্বিতীয়বার হারিয়ে যেতে বসেছে৷''
তাই তো আন্দোর ইশাকের প্রায়ই মনে হয়, এই সংস্কৃতি সংরক্ষণের যুদ্ধে তিনিই হয়ত শেষ যোদ্ধা, শেষ ‘মহিকান'৷