যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে মানবাধিকার সংস্থা হোয়াইট হেলমেটসের ৮০০ কর্মীকে উদ্ধার করে জর্ডানে পাঠিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী৷ সিরিয়া যুদ্ধে এটিই দেশটির এ ধরনের প্রথম হস্তক্ষেপ৷
বিজ্ঞাপন
উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে হোয়াইট হেলমেটস সদস্যদের অনেকের পরিবারের সদস্যও রয়েছেন৷ দক্ষিণ-পশ্চিমের বিপজ্জনক সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের আর্মি রেডিও৷
ইসরায়েল সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ‘কেবলই মানবিক দিক বিবেচনায়' এবং ‘নিশ্চিত প্রাণহানি' এড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও একাধিক ইউরোপীয় দেশের অনুরোধে এই উদ্ধার কাজ চালানো হয়েছে৷
জর্ডান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৮০০ সিরিয়ান নাগরিককে সেদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে, এবং তাঁরা পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ব্রিটেন, জার্মানি ও ক্যানাডায় চলে যাবেন৷
‘‘মানবিক কারণে এই অনুরোধ বিবেচনা করা হয়েছে'', জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহামেদ আল-কায়েদ৷
ক্যানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান ফ্রিল্যান্ড জানিয়েছেন, ‘হোয়াইট হেলমেটস ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের রক্ষায়' তাঁর দেশ ব্রিটেন ও জার্মানির সাথে কাজ করছে৷
এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, ‘‘আমরা এই সাহসী ও পরার্থপর মানুষগুলোর প্রতি অন্তর থেকে দায়িত্ব অনুভব করি৷''
সিরিয়ায় আসলে কারা, কাদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ২০১১ সালের সেই আরব বসন্তের জেরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়৷ গত ছয় বছরে সেই সংঘাতের বিস্তৃতি অনেক বেড়েছে, যোগ হয়েছে নতুন মিত্র, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো শত্রুতা৷
আসাদের প্রতি অনুগতরা
সিরিয়ার সেনাবাহিনী, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ান আরব আর্মি (এসএএ) হিসেবে পরিচিত, ২০১১ সালের শরতে তারা বড় এক জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়৷ সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করে আসাদ বিরোধী ‘অ্যান্টি-আসাদ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷ তবে এসএএকে ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সসহ আসাদপন্থি বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ সমর্থন দিচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/V. Sharifulin
মডারেট দল
আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ সহিংস রূপ নিলে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়৷ জিহাদি নয়, এমন বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে মিলে তারা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে লড়াই করছে৷ উদ্দেশ্য হচ্ছে, সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক পথে সরকার গঠন করা৷ তবে বেশ কয়েকটি লড়াইয়ে হারার পর সেই দলের অনেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে চলে যায়৷
ছবি: Reuters
সন্ত্রাসের নতুন রূপ
সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সে দেশ এবং ইরাকের একটা বড় অংশ দখল করে নিজেদের তথাকথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস)’৷ নিজের কালো পতাকাতলে ইসলামের উগ্রতম রূপ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসংখ্য মানুষকে অত্যাচর এবং হত্যা করেছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷ রাকা শহরে গোষ্ঠীটি শক্ত অবস্থান গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এক পুরনো জিহাদ
তবে আইএসই সিরিয়ায় অবস্থান নেয়া একমাত্র জঙ্গি গোষ্ঠী নয়৷ আল-কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত আল-নুসরা ফ্রন্টসহ আরো কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী সিরিয়ায় লড়ছে৷ আল-নুসরা ফ্রন্ট নিজেদের মধ্যে লড়াই ছাড়াও আসাদ এবং মডারেট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে৷ সম্প্রতি জঙ্গি গোষ্ঠীটি সমমনা আরো কয়েকটি গোষ্ঠীকে নিয়ে জোট গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Nusra Front on Twitter
আসাদের এক শক্তিশালী মিত্র
প্রেসিডেন্ট আসাদের শক্তিশালী মিত্র ক্রেমলিন৷ সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে কয়েকবছর ধরে রসদ সরবরাহের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়া সংঘাতে যোগ দেয় রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী৷ তবে রাশিয়ার বিমান হামলায় অনেক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে মাঝেমাঝেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়ে মস্কো৷
ছবি: picture-alliance/AP/Russian Defense Ministry
অনাগ্রহী পশ্চিম
আসাদের সমালোচনা এবং নীরবে মডারেট বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন জানালেও তাদের হয়ে আসাদের বিরুদ্ধে লড়তে পদাতিক বাহিনী পাঠাতে আগ্রহী নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো ন্যাটোভুক্ত দেশ৷ তবে ২০১৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রায় ষাটটি দেশের মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক জোট সে দেশে ইসলামিক স্টেট এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর আস্তানায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images/John Macdougall
সীমান্তে নিরাপত্তা
সিরিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলো নিজেদের সীমান্ত রক্ষার স্বার্থেই এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে৷ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী জোটে থাকা তুরস্কও আসাদবিরোধী জোটকে সহায়তা করছে৷ তবে কুর্দি যোদ্ধাদের মার্কিনিদের সহায়তা নিয়ে সে দেশের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে তুরস্কের, কেননা কুর্দরা নিজেদের রাষ্ট্র চায়, যা তুরস্ক সমর্থন করে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/S. Suna
প্রক্সি ওয়ার
সিরিয়ার সংঘাতে কার্যত এক প্রক্সি লড়াইও চলছে, যেখানে একদিকে রয়েছে রাশিয়া এবং ইরান, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক৷ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায় ইরান৷ ফলে রাশিয়ার পাশাপাশি সে দেশও কৌশলগত সহায়তা, সামরিক প্রশিক্ষণ, এবং পদাতিক সেনা দিয়ে দামেস্ককে সহায়তা করছে৷
ছবি: Atta Kenare/AFP/Getty Images
যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই
ছয় বছর হয়ে গেলেও সিরিয়ায় বহুমুখী লড়াই বন্ধের কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না৷ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তৈরি বিভিন্ন শান্তি চুক্তি করা হলেও তা তেমন একটা সফল হয়নি৷ ফলে প্রতিদিন সে দেশে নানা হামলায় মারা যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে শিশু, নারীসহ অনেক বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন৷
9 ছবি1 | 9
এগিয়ে যাচ্ছে আসাদ বাহিনী
রাশিয়া-সমর্থিত সরকারি বাহিনী সিরিয়ার দক্ষিণে বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকায় নতুন করে হামলা জোরদারের পর লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন৷
আসাদ বাহিনী কুনাইত্রা প্রদেশের কাছাকাছি চলে আসার পর হোয়াটস হেলমেটসের সদস্যদের সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ করা হয় ইসরায়েলকে৷ এই প্রদেশের সাথে ইসরায়েলী দখলে থাকা গোলান হাইটস, জর্ডান এবং লেবাননের সীমান্ত রয়েছে৷ মার্কিন কর্মকর্তাদের আশংকা ছিল, সরকারি বাহিনীর আক্রোশের শিকার হতে পারেন হোয়াইটস হেলমেটসের স্বেচ্ছাসেবীরা৷
আট বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে এই প্রথম কোনো সিরীয় নাগরিককে নিজেদের সীমান্ত অতিক্রম করতে দিলো ইসরায়েল৷ তবে দেশটির সেনাবাহিনী বলছে, এর ফলে সিরিয়া সংকটে ‘হস্তক্ষেপ না করার নীতি' থেকে সরে আসেনি দেশটি৷
‘‘সিরিয়া সংকটে ইসরায়েল এখনও হস্তক্ষেপ না করার নীতি বজায় রেখে চলেছে৷ পাশাপাশি ইসরায়েল এটাও মনে করে যে, সিরিয়ার মধ্যে ঘটমান সকল ঘটনার জন্য দেশটির সরকারই দায়ী'', এক বিবৃতিতে জানিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী৷
স্বেচ্ছাসেবী হোয়াইট হেলমেটস আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স নামে পরিচিত৷ ২০১৩ সাল থেকে বিদ্রোহি-অধ্যুষিত এলাকায় উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে আসছে সংস্থাটি৷ সরকারি বাহিনীর বিমান হামলার সময় হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের প্রাণ রক্ষায় ভূমিকা রেখে চলেছে হোয়াইট হেলমেটস৷