উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের ছোড়া কামানের গোলা আঘাত হেনেছে মার্কিন বাহিনীর একটি পর্যবেক্ষণ ঘাঁটির কাছে৷ ওয়াশিংটনের অবরোধ আরোপের হুমকি সত্ত্বেও দেশটিতে হামলার তীব্রতা বাড়িয়ে যাচ্ছে আঙ্কারা৷
বিজ্ঞাপন
সিরিয়ার কুর্দি বিদ্রোহীদের দমনে দেশটির উত্তর পূর্বাঞ্চলে অতর্কিত হামলা চালাচ্ছে তুরস্ক৷ এমনকি তাদের কামানের গোলা এসে পড়েছে কোবেন শহরের বাইরে মার্কিন বাহিনীর একটি পর্যবেক্ষণ ঘাঁটির কাছে৷ শুক্রবার শেষ রাতের দিকে এই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছে পেন্টাগন৷ তাদের দাবি তুরস্ক জেনেশুনেই এই হামলা চালিয়েছে৷
যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ব্রুক ডি ওয়াল্ট বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সদস্যদের অবস্থান আছে তা জানা থাকা সত্ত্বেও কয়েকশো মিটারের মধ্যে তারা এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে৷‘‘ তবে এই ঘটনায় কেউ আহত হয়নি বলেও নিশ্চিত করেছেন তিনি৷
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এরইমধ্যে সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্ত থেকে নিজেদের মোতায়েনকৃত সৈন্যের বড় একটি অংশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বাহিনীর এখনও অবস্থান রয়েছে৷
সিরিয়ায় কে, কার বিরুদ্ধে লড়ছে?
২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে৷ মাঝে আইএস-এর কারণে সেই যুদ্ধে বিদেশি শক্তিও ঢুকে পড়েছে৷ কে আসলে কার বিরুদ্ধে লড়ছে?
ছবি: picture alliance/abaca/A. Al-Bushy
যুদ্ধ যেন শেষই হচ্ছে না
২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ লেগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল৷ সেই সময় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে দেশের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ হারান৷ এরপর সেই যুদ্ধে একসময় বিদেশি শক্তিও ঢুকে পড়ে৷
ছবি: picture alliance/abaca/A. Al-Bushy
আসাদের সমর্থক
সিরিয়ার সেনাবাহিনী ‘সিরিয়ান আরব আর্মি’ বা এসএএ পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ আসাদের কাছে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে৷ এছাড়াও ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স’সহ আসাদের সমর্থক কয়েকটি বাহিনী এবং রাশিয়া ও ইরান আসাদকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Syrian Presidency
তুরস্কের ভূমিকা
ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী দেশ ছিল তুরস্ক৷ এছাড়া আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদেরও সমর্থন দিয়ে আসছে দেশটি৷ তবে কুর্দিদের সহায়তা করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, কারণ সিরিয়ার কুর্দিদের সঙ্গে তুরস্কের ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’ পিকেকে-র সম্পর্ক রয়েছে বলে তুরস্কের অভিযোগ৷ ১৯৮৪ সাল থেকে তুর্কি সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে আছে পিকেক৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/L. Pitarakis
রাশিয়ার ভূমিকা
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে রাশিয়া৷ অবশ্য তারও আগে থেকে সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছিল দেশটি৷ রাশিয়ার আকাশ হামলায় সিরিয়ার বহু সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভিযোগ রয়েছে৷ রাশিয়ার কারণে যুদ্ধের ঢেউ এখন আসাদের অনুকূলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Tass/M. Metzel
আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ
২০১৪ সালের শেষ দিকে আইএস-সব অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনকে লক্ষ্য করে আকাশ হামলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট৷ জার্মানিসহ প্রায় ৫০টি দেশ রয়েছে সেই জোটে৷ আইএসবিরোধী এই জোটের কারণে সিরিয়ায় আইএস-এর পরাজয় হয়েছে৷ জোটকে সহায়তা করেছে কুর্দি ও আরব মিলিশিয়াদের সমন্বয়ে গঠিত ‘সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস’ এসডিএফ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/A.Brandon
বিদ্রোহীদের কথা
‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’র মতো নন-জিহাদি গোষ্ঠীগুলো আসাদের পদত্যাগ চাইছে৷ এরপর একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনেরও দাবি আছে তাদের৷ তবে বেশ কয়েকটি পরাজয়ের পর এই সংগঠনের অনেক সদস্য কট্টরপন্থি জঙ্গি সংগঠনগুলোতে যোগ দিয়েছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: Reuters
ইরানের সমর্থন
গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দামেস্ককে কৌশলগত ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে ইরান৷ ইরানের সমর্থনপ্রাপ্ত লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী হেজবোল্লাহও আসাদ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে৷
ছবি: Atta Kenare/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
তুরস্কের অস্বীকার
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালানোর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে তুরস্ক৷ এক বিবৃতিতে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ ঘাঁটির ১ কিলোমিটার দূর থেকে তুরস্কের উপর হামলা চালিয়েছিল কুর্দিরা৷ তার জবাবেই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির অবস্থান লক্ষ্য করে তারা হামলা চালিয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা যোগাযোগের পর গোলাগুলি বন্ধ করা হয়েছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়৷
অন্যদিকে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আক্রমণ শুরুর পর তাদের বাহিনী সেই অবস্থান ছেড়ে চলে যায়৷
শহর দখল নাকি প্রস্থান
তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তবর্তী শহর রাস-আল আইন এর নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়েছে বলে শনিবার ঘোষণা দিয়েছে তুরস্কের সামরিক বাহিনী৷ দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীও এ বিষয়ে টুইট করে বলেছেন. ‘‘ ইউফ্রতিসের পূর্বে অবস্থিত রাসুলাইন শহর নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়েছে৷‘‘
তবে কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমক্রেটিক ফোর্স এসডিএফ তুরস্কের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তাদের যোদ্ধারা সেখানকার একটি জায়গা থেকে কৌশলগতভাবে পিছু হটেছে৷ তবে দুই পক্ষের মধ্যে এখনও সংঘর্ষ চলমান আছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটোরি ফর হিউম্যান রাইটস৷ তাদের তথ্য অনুযায়ী তুরস্কের হামলায় এখন পর্যন্ত সীমান্ত অঞ্চলে ১০ বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে৷ অন্যদিকে শুক্র্রবার নিজেদের ২৩ যোদ্ধা নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে এসডিএফ৷
জাতিসংঘের হিসাবে, তুরস্কের হামলার কারণে এক লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন৷ যার কারণে এই অঞ্চলে নতুন করে মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম৷
এদিকে তুরস্ক হামলা বন্ধ না করলে দেশটির কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ করা হতে পারে বলে হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ তবে এমন কিছু করা হলে তার পাল্টা জবাব দেয়া হবে বলে উল্টো সতর্ক করে দিয়েছে তুরস্ক৷
এফএস/এআই (এপি, এএফপি, রয়টার্স)
সৌদি আরব, ইরান, ইসরায়েল কার শক্তি কেমন?
সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলার পর অস্থির হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি৷ হুতি বিদ্রোহীরা এর দায় নিলেও ইরানকে দায়ী মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব৷ এ নিয়ে চলছে হুমকি-পাল্টা হুমকি৷ কিন্তু সামরিক শক্তিমত্তা কার বেশি?
ছবি: picture-alliance/EPA/TSGT
আকাশে সৌদি আরব
সামরিক খাতে সৌদি আরব ২০১৮ সালে ৬ হাজার ৭৬০ কোটি ডলার খরচ করেছে৷ ব্যয়ের দিক থেকে তাদের অবস্থান গোটা বিশ্বে তৃতীয় আর উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে৷ বিশ্বের সামরিক যন্ত্রপাতির সবচেয়ে বড় ক্রেতাও তারা৷ বর্তমানে সৌদির মোট সামরিক সদস্য ২ লাখ ৩০ হাজার৷ আছে ৮৪৮ টি যুদ্ধবিমান, ২৫৪ টি হেলিকপ্টার, ১০৬২ টি ট্যাংক ও ৫৫ টি যুদ্ধ জাহাজ৷ তবে নেই কোনো সাবমেরিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সমুদ্র আর সৈন্যে ইরান
সামরিক খাতে গত বছর ইরানের ব্যয় ছিল ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলার, যা ২০১৭ সালের তুলনায় সাড়ে নয় ভাগ কম৷ অবরোধ আর অর্থনৈতিক মন্দায় গত এক দশকে দেশটির অস্ত্র আমদানির পরিমাণও কমেছে৷ ২০০৯-১৮ সালের মধ্যে তা্দের আমদানিকৃত অস্ত্রের পরিমাণ সৌদি আরবের মাত্র সাড়ে তিনভাগ৷ বর্তমানে দেশটির সামরিক সদস্য আট লাখ ৭৩ হাজার৷ ৫০৯ টি যুদ্ধ বিমান, ১৫৬ টি হেলিকপ্টার, ১৬৩৪ টি ট্যাংক, ৩৯৮ টি নৌযান, ৩৪ টি সাবমেরিনের মালিক তারা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Noroozi
ইসরায়েল নিজেই অস্ত্র তৈরি করে
২০১৮ সালে সামরিক খাতে এক হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার ব্যয় করেছে ইসরায়েল৷ দেশটি নিজেই সামরিক অস্ত্র তৈরি করে, তাই তেমন একটা আমদানি করতে হয় না৷ গত বছর সর্বসাকুল্যে ১০৩ কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছে যুক্তরাষ্ট্র আর জার্মানির কাছ থেকে৷ দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬ লাখ ১৫ হাজার৷ তাদের বহরে আছে ৫৯৫ টি যুদ্ধবিমান, ১৪৬ টি হেলিকপ্টার, ২৭৬০ টি ট্যাংক, ৬ টি সাবমেরিন৷
ছবি: Reuters
প্রতাপশালী তুরস্ক
২০১৮ সালে তুরস্কের সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৯৭ কোটি ডলার৷ এর মধ্যে ১১১ কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন, ইতালিসহ ৬টি দেশের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয়ে৷ তুরস্কের সামরিক বাহিনীর সদস্য ৭ লাখ ৩৫ হাজার৷ যুদ্ধবিমান আছে ১০৬৭ টি৷ আছে ৪৯২ টি হেলিকপ্টার, ৩২০০ ট্যাংক, ১৯৪ টি যুদ্ধজাহাজ, ১২ টি সাবমেরিন৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
উপসাগরের ছোট শক্তি কাতার
কাতারের সবশেষ সামরিক ব্যয়ের হিসাবটি ২০১০ সালের৷ সে বছর তাদের বাজেট ছিল ২১৭ কোটি ডলারের৷ দেশটির সামরিক সদস্য সংখ্যা ১২ হাজার৷ আছে ১০০ টি এয়ারক্রাফট, ৪২ টি হেলিকপ্টার, ৯৫ টি ট্যাংক, ৮০ টি যুদ্ধজাহাজ৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Jaafar
পড়ন্ত শক্তির ইরাক
গেল বছর সামরিক বাহিনীর পেছনে প্রায় ৬৩২ কোটি ডলার খরচ করেছে ইরাক৷ এর মধ্যে ১৫৬ কোটি ডলার ব্যয় করেছে অস্ত্র ক্রয়ে৷ তাদের আছে ১ লাখ ৬৫ হাজার সৈন্য, ৩২৭ টি যুদ্ধবিমান, ১৭৯ টি হেলিকপ্টার, ৩০৯ টি ট্যাংক, ৬০ টি যুদ্ধজাহাজ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Abdul Hassan
এবং যুক্তরাষ্ট্র
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট ছিল ৬৪ হাজার ৮৮০ কোটি ডলারের৷ প্রায় সাড়ে ২১ লাখ সামরিক সদস্যের বিশাল বাহিনী তাদের৷ ১৩,৩৯৮ টি যুদ্ধবিমান, ৫৭৬০টি হেলিকপ্টার, ৬২৮৭টি ট্যাংক, ৪১৫টি যুদ্ধজাহাজ, ৬৮টি সাবমেরিন আছে এই পরাশক্তির বহরে৷