এক সময় আল কায়দার অংশ ছিল এইচটিএস নামক জঙ্গি সংগঠন। তারাই নতুন করে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে।
বিজ্ঞাপন
হায়াত তাহিরির আল-শাম, সংক্ষেপে এইচটিএস। তুরস্কের মদতপুষ্ট এই সংগঠনই গত এক সপ্তাহ ধরে সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরো বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ইসলামি সংগঠন। তবে নেতৃত্ব দিচ্ছে এইচটিএস। গত শুক্রবার তারা সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখল করে নিয়েছে। আশপাশের একাধিক গ্রামও এখন তাদের দখলে। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হামা শহরটি দখলে নেওয়া।
সিরিয়ারযুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন নানার হাওয়াচ। কীভাবে গৃহযুদ্ধ শেষ করা যায়, তা নিয়েও কাজ করছেন তিনি। ডিডাব্লিউকে নানার জানিয়েছেন, রোববার হামা শহরে বাশার আসাদের সরকার বিরাট সেনা বাহিনী পাঠিয়েছে। এইচটিএস-কে তারা চাপ দিয়ে উত্তরের দিকে খানিকটা সরিয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু নানারের আশঙ্কা, এইচটিএস এতে থামবে না। আগামী কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যে আবার গোটা সিরিয়াজুড়ে প্রবল গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন এই গবেষক। তার বক্তব্য, এইচটিএস-এর পিছনে যেহেতু তুরস্কের হাত আছে, তারা যথেষ্ট শক্তি নিয়েই আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে।
সেপ্টেম্বরে লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা বিরাজ করছে। প্রাণ বাঁচাতে সিরিয়ায় আশ্রয় নিচ্ছেন লেবাননের নাগরিকরা। ইসরায়েলি হামলায় লেবাননের অন্তত ২৩০০ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন।
ছবি: Louisa Gouliamaki/REUTERS
ভোগান্তিতে বয়োজ্যেষ্ঠরা
হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। লেবানন থেকে সিরিয়ার সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় এক বয়োজ্যেষ্ঠ নারীকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন এক তরুণ।
ছবি: Louisa Gouliamaki/REUTERS
সহায়তায় রেড ক্রিসেন্ট
ইসরায়েলি হামলার পর মাসানা সীমান্ত পাড়ি দেয়া লেবাননের নাগরিকদের সহায়তা করছে সিরিয়ান আরব রেড ক্রিসেন্ট।
ছবি: Louisa Gouliamaki/REUTERS
পালাতে হচ্ছে সবাইকেই
চলতি মাসে ইসরায়েলের হামলার পর লেবাননের যোগাযোগ মন্ত্রী সেখানকার সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। মাসানা সীমান্তে রেড ক্রিসেন্টের সহয়াতায় এক পঙ্গু ব্যক্তি সীমান্ত অতিক্রম করছেন।
লেবানন আর সিরিয়ার মধ্যকার মাসানা সীমান্ত অতিক্রম করার সময় লেবাননের এক নাগরিককে যাবতীয় সরঞ্জামাদি মাথায় করে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
ছবি: Louisa Gouliamaki/REUTERS
পরবর্তী গন্তব্য
সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশের পর অবশেষে বাস ও অন্যান্য যানবাহনের দেখা পাচ্ছেন লেবাননের শরণার্থীরা। মাসানা সীমান্ত থেকে বাসে করে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে যাত্রা করছেন অনেকেই।
ছবি: Louisa Gouliamaki/REUTERS
6 ছবি1 | 6
এর আগেও হামা গৃহযুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। ২০১১ সালে গণতন্ত্রপন্থি গোষ্ঠীগুলি সিরিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল। প্রাথমিকভাবে তারা খানিকটা অগ্রসরও হতে পেরেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে হামায় আসাদ সরকার বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েন করে। শুরু হয় প্রবল গৃহযুদ্ধ। আসাদ সরকার বিদ্রোহীদের দমন করতে সমর্থ হয়। সে সময় আসাদ সরকারকে সবরকমভাবে সাহায্য করেছিল ইরান এবং রাশিয়া। তারা এখনো আসাদ সরকারের বন্ধু।
লড়াইয়ের নতুন মুখ
একসময় আল কায়দার অংশ ছিল এইচটিএস। পরবর্তীকালে তারা আলাদা হয়ে যায়। ২০১৮ সালে অ্যামেরিকা এই সংগঠনকে জঙ্গি সংগঠন বলে চিহ্নিত করে। সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল বিশেষ করে ইডলিব এলাকা এখন এইচটিএস-এর দখলে। প্রায় ৪০ লাখ উদ্বাস্তু সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইডলিবে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এইচটিএস তাদেরও ব্যবহার করার চেষ্টা করছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
তবে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে কেবল এইচটিএস লড়ছে না। তুরস্কের ছত্রছায়ায় থাকা সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এসএনএ-এর একটি অংশও লড়াইয়ে নেমে পড়েছে। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কুর্দ অধ্যুষিত অঞ্চলে তারা আক্রমণ চালাচ্ছে।
তুরস্ক বরাবরই আসাদ সরকারের বিরোধী। সিরিয়ার সঙ্গে তাদের বিরাট সীমান্ত। তবে আসাদ সরকারের পাশাপাশি কুর্দ যোদ্ধাদেরও তুরস্ক জঙ্গি সংগঠন বলে মনে করে। এবং দীর্ঘদিন ধরেই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে তুরস্ক।
সিরিয়ায় শরণার্থীদের সহায়তা কমছে, দুশ্চিন্তা বাড়ছে
তহবিল সংকটের কারণে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২৪ সাল থেকে সিরিয়ায় নিয়মিত সহায়তা প্রদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ফাতেমা এবং তার পরিবারের মতো আরও হাজার হাজার শরণার্থী এই সহায়তার উপর নির্ভরশীল৷
ছবি: Omar Albam
এগারো বছর ধরে শরণার্থী শিবিরে
ওর নাম ফাতেমা আহমেদ আল-হাসান৷ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের মাঝেই আলেপ্পোতে জন্ম হয় তার৷ তবে সেখানে মাত্র দুই বছর কাটিয়েছে ফাতেমা৷ আলেপ্পোয় একদিন বিমান হামলায় প্রাণ হারায় তার বাবা৷ এরপর ছেলেমেয়েকে নিয়ে সিরিয়ার উত্তরপশ্চিমে চলে যান ফাতেমার মা৷
ছবি: Omar Albam/DW
প্রতিকূল পরিস্থিতি
সেই ঘটনার পর থেকে আল-হাসান পরিবার সিরিয়ার ইডলিব প্রদেশের আল-খানসা শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন৷ শুধুমাত্র এই অঞ্চলটি এখনো বিদ্রোহী এবং আন্তর্জাতিক যোদ্ধাদের দখলে রয়েছে৷ শরণার্থী শিবিরটিতে ফাতেমার নিত্যদিনের জীবন সহজ নয়৷ আলেপ্পোয় বিমান হামলায় সে শুধু তার বাবাকে নয়, নিজেও মারাত্মকভাবে আহত হয়৷ তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে৷
ছবি: Omar Albam
ভবিষ্যতের দিকে নজর
গত চার বছর ধরে স্কুলে যাচ্ছে ফাতেমা৷ শরণার্থী শিবিরের বাইরে পড়তে যেতে প্রতিদিন এক কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হয় তার৷ তার মা সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের নাম প্রকাশের আগ্রহী নন৷ তিনি ফাতেমাকে হোমওয়ার্ক শেষ করতে সহায়তা করেন৷
ছবি: Omar Albam/DW
সহায়তার উপর নির্ভরশীলতা
যুদ্ধ এবং কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সিরিয়ার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের ৪৫ লাখ বাসিন্দার ৯০ শতাংশের বেশি আন্তর্জাতিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল৷ তাদের মধ্যে বিশ লাখ বিভিন্ন শিবিরে অবস্থান করছেন যেখানে বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে৷ স্যানিটারি ব্যবস্থারও করুণ দশা৷ ফাতেমা এবং তার পরিবার আরো কয়েক ডজন মানুষের সঙ্গে একটি পানির ট্যাংকি শেয়ার করেন৷
ছবি: Omar Albam/DW
মানবিক সহায়তা কমে যাচ্ছে
শিবিরের অন্যান্যদের মতো আল-হাসান পরিবারও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার উপর নির্ভরশীল৷ অতীতে তারা নিয়মিত বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি)-এর ফুড প্যাকেজ পেতেন৷ সেটা দিয়ে তারা চলতে পারতেন৷ কিন্তু তহবিল সংকটের কারণে ২০২৪ সাল থেকে সেই নিয়মিত সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে৷ ভবিষ্যত নিয়ে তাই শঙ্কিত আল-হাসান পরিবারের মতো শিবিরের আরো অনেক বাসিন্দা৷
ছবি: Omar Albam/DW
শীতকালে পরিস্থিতি আরো সঙ্গিন হয়
শীতকালে ঠান্ডা এবং কর্দমাক্ত রাস্তা ফাতেমার জীবন আরো কঠিন করে দেয়৷ এই পরিস্থিতির মধ্যেও অবশ্য এখনো টিকে আছে সে৷ তবে ভবিষ্যতে দরকার হলেও চিকিৎসা সেবা পাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত শিশুটি৷
ছবি: Omar Albam/DW
চিকিৎসক হতে চায় ফাতেমা
বড় হয়ে চিকিৎসক হয়ে তার মতো অন্যান্য বিশেষভাবে সক্ষমদের সহায়তা করতে চায় ফাতেমা৷ তার মাও তাকে চিকিৎসক হতে সহায়তা অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর৷ ‘‘পরিস্থিতি সহজ না হলেও আমি যেকোনোভাবে তাকে সহায়তা করে যাবো,’’ বলেন ফাতেমার মা৷
ছবি: Omar Albam/DW
7 ছবি1 | 7
আসাদের বন্ধু
রাশিয়া বরাবরই আসাদ সরকারের বন্ধু। এই বন্ধুত্বের অন্যতম কারণ কৌশলগত সুবিধা। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া কিছুটা সমস্যায় থাকলেও সিরিয়ার কৌশলগত অবস্থান তারা ছাড়বে না। বস্তুত, সিরিয়ায় নতুন করে গৃহযুদ্ধের আবহ তৈরি হওয়ার পর ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, ''সিরিয়া বরাবরই আমাদের সহযোগী। এক্ষেত্রেও আসাদ সরকারকে আমরা সবরকম সাহায্য করব। সিরিয়ায় স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।''
ইরানের সরকারও আসাদ সরকারের সমর্থক। 'অ্যাক্সিস অফ রেসিসটেন্স'এর অংশ আসাদ সরকার। এই গোষ্ঠী মনে করে অ্যামেরিকা এবং ইসরায়েল তাদের প্রধান শত্রু। এই গোষ্ঠীর অংশ ইরান, লেবানন-সহ একাধিক দেশ এবং বেশ কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেমন হুতি।
সিরিয়ার কিছু গোষ্ঠী দাবি করেছে, সোমবার ইরান থেকে প্রায় ২০০ জন সশস্ত্র ব্যক্তি পিক আপ ট্রাকে করে সিরিয়ায় ঢুকেছে। আলেপ্পোর কাছে সিরিয়ার সেনাকে সহায়তা করবে তারা।
সব মিলিয়ে এক নতুন গৃহযুদ্ধএর মুখোমুখি সিরিয়া। বস্তুত, ২০১১ সাল থেকে টানা গৃহযুদ্ধএর কারণে কার্যত ধসে গেছে দেশের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা। তার উপর আবার নতুন করে এই লড়াই আরো ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেবে দেশটিকে।