রাশিয়া সিরিয়ায় সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে, এক নয়, একাধিক কারণে৷ কিন্তু সব মিলিয়ে ক্রেমলিন এ অঞ্চলে নিজের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকেই নিশ্চিত করছে বলে মনে করেন ডয়চে ভেলের রুশ ও ইউরোপীয় ভাষা বিভাগের প্রধান ইঙ্গো মানটয়ফেল৷
বিজ্ঞাপন
রাশিয়া যে সিরিয়ায় তার সদ্যসৃষ্ট সামরিক ঘাঁটিতে জঙ্গিজেট, জঙ্গি হেলিকপ্টার ও অপরাপর সামরিক সরঞ্জাম স্থাপন করছে, ইউরোপের উদ্বাস্তু সংকট তার কারণ নয়৷ ক্রেমলিন সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ অভিমুখে উদ্বাস্তুর স্রোতকে একটি আন্তঃ-ইউরোপীয় সমস্যা বলে বাতিল করেছে৷ বলতে কি, নৈতিক মূল্যবোধ কোনোকালেই রাশিয়ার বিদেশনীতিতে কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখেনি৷
জাতীয় স্বার্থই বড় কথা
মস্কো শুধু বিভিন্ন দেশের ভূরাজনৈতিক স্বার্থই বিবেচনা করে থাকে৷ কাজেই সিরিয়ার রক্তপাতে রাশিয়ার স্বকীয় দায়িত্বের নীতিগত প্রশ্ন থেকে অব্যাহতি পেয়ে রুশ পররাষ্ট্রনীতি নির্দ্বিধায় আসাদ প্রশাসনকে কূটনৈতিক ও সামরিক সমর্থন দিয়ে গেছে৷ মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার পরিশিষ্ট সহযোগী হলেন এই আসাদ – রাশিয়ার ক্ষমতার রাজনীতিতে শুধুমাত্র এই বাস্তব সত্যটির গুরুত্ব আছে৷
কিন্তু এবার ক্রেমলিন দৃশ্যত চিন্তায় পড়েছে যে, আসাদ-এর গুরুত্ব কমতে চলেছে৷ ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে বৈরিতা কমার লক্ষণ দেখা দিয়েছে৷ ওদিকে ইরান বস্তুত আসাদ-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী৷ অপরদিকে সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের ক্রমবর্ধমান সামরিক হস্তক্ষেপ প্রাথমিকভাবে ইসলামিক স্টেট-এর বিরুদ্ধে হলেও, শেষ অবধি তা আসাদ-এর কর্তিত প্রশাসনের পক্ষেও বিপদ হয়ে উঠতে পারে বৈকি৷
সেই কারণেই পুটিন দৃশ্যত সক্রিয় হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ পশ্চিমি বিশ্ব যখন আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত, তখন তার সুযোগ নিয়ে বিগত কয়েক সপ্তাহে একটি ঝটিতি অভিযানে সিরিয়ার উপকূলে একটি রুশ সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়েছে৷ পুটিন যখন এ মাসের শেষে জাতিসংঘের সাধারণ সম্মেলনে বক্তৃতা দেবেন, তখন তিনি নিশ্চয় এই নতুন সামরিক ঘাঁটিকে আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়ার অবদান বলে চালাবার চেষ্টা করবেন৷
রাশিয়া কী চায়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমি শক্তি যদি এই ব্যাখ্যা মেনে নেয়, তাহলে পুটিন তাঁর সর্বোচ্চ লক্ষ্য সাধিত হয়েছে, বলে গণ্য করতে পারবেন: ক্রাইমিয়া দখল ও পূর্ব ইউক্রেনে যুদ্ধের ফলে রাশিয়া যে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তার অন্ত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে; রাশিয়া আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমপর্যায়ের পরাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে৷ সেই সঙ্গে আসাদ প্রশাসনও অন্তত কিছুদিনের জন্য রেহাই পাবে – যা রাশিয়ার শক্তিমত্তার আরেক প্রমাণ হিসেব গণ্য হবে৷
যুক্তরাষ্ট্র যদি আইএস বিরোধী একটি যৌথ অভিযানে সম্মত না-ও হয়, সেক্ষেত্রেও ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার নতুন সামরিক ঘাঁটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না – গৃহযুদ্ধে সিরিয়া খণ্ডখণ্ড হয়ে গেলেও নয়৷ রাশিয়ার সেটাই লাভ৷ এই লাকাকিয়া অঞ্চল আসাদ পরিবারের বাসভূমি৷ ইতিহাস বলে, আলাওয়াইটরা এখানেই প্রথম বসতি গড়েছিল৷ আসাদ-পরবর্তী পর্যায়ে যে এখানে ছোটখাটো একটি আলাওয়াইট রাজ্য গড়ে উঠতে পারে না, এমন নয় – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাস্তবিক যা ঘটেছিল৷ সামরিক ঘাঁটি থাকায় রাশিয়া সেই নতুন রাষ্ট্রটির স্থায়ী রক্ষাকর্তা হয়ে উঠতে পারে৷ কাজেই সিরিয়ায় পুটিন-এর জয় সর্বক্ষেত্রে ও সব পরিবেশে৷
সিরিয়া থেকে জার্মানি: শরণার্থীদের বিপৎসংকুল যাত্রা
যুদ্ধের ভয়াবহতা, মৃত্যু এড়াতে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই সিরিয়া ছাড়ছে অসংখ্য মানুষ৷ সব বাধা পেরিয়ে সবাই চাইছেন জার্মানি আসতে৷ জানেন কি, কত কঠিন তাঁদের জীবন? কতটা বন্ধুর মৃত্যুর বিভীষিকা ছেড়ে জীবনের পথ ধরা? দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/A. Beier
নিজের দেশ যখন ‘দোজখ’
২০১১ সাল থেকে যুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়৷ এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ মারা গেছে৷ সিরিয়া না ছাড়লে মৃতদের কাতারে কখন যে নাম লেখাতে হবে কে জানে! দেশ ছেড়ে কোথায় যাওয়া যায়? কোন জায়গাটা জীবন-জীবিকার জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ? ইউরোপ৷ তাই অনেকেই আসছেন ইউরোপে৷ ছবিতে দামেস্কের এক আবাসিক এলাকায় প্রেসিডেন্ট বাশারের অনুগত বাহিনীর হামলার পর ধ্বংসস্তূপের মাঝে এখনো কেউ বেঁচে আছেন কিনা দেখছেন সিরীয়রা৷
ছবি: picture-alliance/A.A./M. Rashed
প্রথম গন্তব্য তুরস্ক
ইউরোপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে তুরস্কে যায় সিরীয়রা৷ ইজমিরের কোনো হোটেলে উঠেই তাঁরা শুরু করেন মানবপাচারকারীদের মাধ্যমে সমুদ্রপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা৷ যাঁদের হোটেলে ওঠার সাধ্য নেই তাঁরা রাস্তার পাশে কিংবা পার্কে তাঁবু তৈরি করে দু-এক রাত কাটিয়ে নেন৷ ছবির এই মেয়েটির মতো ইউরোপে আসার আগে অনেক সিরীয়কেই ঘুমাতে হয় তুরস্কের রাস্তায়৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Atalay
গ্রিসের দিকে যাত্রা
তুরস্ক থেকে প্রায় সবাই ছোটেন গ্রিসের দিকে৷ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এই দেশটিতে শুধু ইউরোপে প্রবেশের জন্যই আসা৷ আসল লক্ষ্য পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলো৷ ছবিতে ডিঙ্গি নৌকায় তুরস্ক থেকে গ্রিসের কস দ্বীপের দিকে যাত্রা শুরু করা কয়েকজন সিরীয়৷
ছবি: Reuters/A. Konstantinidis
মানুষের নীচে মানুষ
কস দ্বীপ থেকে গ্রিসের মূল ভূখণ্ডের দিকে যাচ্ছে একটি ফেরি৷ ১০ ঘণ্টার যাত্রাপথ৷ কোনো জায়গা না পেয়ে যাত্রীদের আসনের নিচেই ঘুমিয়ে নিচ্ছে এক সিরীয় কিশোরী৷
ছবি: Getty Images//W. McNamee
রুদ্ধ সীমান্ত
কস দ্বীপ থেকে মেসিডোনিয়া হয়ে ইডোমেনি শহরে যান অনেকে৷ ‘বলকান রুট’ ব্যবহার করে অনেকে বাধ্য হয়ে সার্বিয়ার দিকেও যান৷ গত মাসে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করে শরণার্থীদের ঠেকাতে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোরও ঘোষণা দেয় মেসিডোনিয়া৷ সহজে সীমান্ত পার হওয়া যাবে ভেবে শুরু হয় সার্বিয়ার দিকে যাত্রা৷ ছবির এই ট্রেনের মতো অনেক ট্রেনই গিয়েছে এমন মানুষবোঝাই হয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Licovski
বেলগ্রেডে বিশ্রাম
ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড যেন শুধুই বিশ্রামাগার৷ এ শহরে বিশ্রাম নিয়েই সবাই পা বাড়ান প্রকৃত গন্তব্যের দিকে৷ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের প্রথম ৬ মাসে সিরিয়া থেকে অন্তত ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ গিয়েছেন বেলগ্রেডে৷ এখানে বেলগ্রেডের এক পার্কে বিশ্রাম নিচ্ছেন কয়েকজন সিরীয় শরণার্থী৷
ছবি: picture alliance/dpa/T. Brey
হাঙ্গেরিতে মানুষের ঢল
সার্বিয়া থেকে শরণার্থীরা যাচ্ছেন হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে৷ বুদাপেস্টও ‘বিশ্রামালয়’৷ তবে হাঙ্গেরি অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে৷হাঙ্গেরি সরকার চায় যাঁরা এসেছেন তাঁরা সেখানেই নাম নথিভূক্ত করাক৷ তা করলে হাঙ্গেরিতেই থাকতে হবে৷ কিন্তু অভিবাসন প্রত্যাশীরা চান জার্মানি যেতে৷ ছবিতে এক কিশোরীর হাতে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের ছবি৷
ছবি: Reuters/B. Szabo
উষ্ণ অভ্যর্থনা
হাঙ্গেরি থেকে কয়েক হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী চলে এসেছেন অস্ট্রিয়া এবং জার্মানিতে৷ নতুন ঠিকানায় এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন অনেকেই৷ অভিবাসনবিরোধী ডানপন্থি দলের শাসনাধীন দেশ হাঙ্গেরি থেকে বেরিয়ে আসতে পারাই তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় স্বস্তি৷ জার্মানিতে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্যরকম৷ মিউনিখে শরণার্থীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে বরণ করে নিয়েছেন জার্মানরা!
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Armer
তারপর.....?
মিউনিখের কেন্দ্রীয় রেল স্টেশনে এক সিরীয় নারী অভিবাসনপ্রত্যাশীর কোলে সন্তানকে তুলে দিচ্ছেন এক জার্মান পুলিশ৷ সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বরণ করে নিয়েছে৷ কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়ে গেছে অভিবাসন ইস্যু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা৷ এত বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর আগমন অনেক ধরণের সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা৷