ট্রাম্প প্রশাসনের উপর রাশিয়ার প্রভাব নিয়ে যখন চারিদিকে জল্পনাকল্পনা তুঙ্গে, তখন ওয়াশিংটন পোস্ট দাবি করলো যে, সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সহায়তা বন্ধ করছে অ্যামেরিকা৷ ফলে আসাদের উপর চাপ কিছুটা কমে গেল৷
বিজ্ঞাপন
ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রের সূত্র অনুযায়ী, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের জন্য সাহায্য বন্ধ করে দিচ্ছে৷ তারা এতকাল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিল৷ প্রায় ৪ বছর ধরে গোপন এক অভিযানে সিআইএ বিদ্রোহীদের নানাভাবে সাহায্য করে আসছিল৷ কিন্তু তার ফলে সীমিত সাফল্যের কারণে সিআইএ এই কর্মসূচি বন্ধ করতে চলেছে৷ তাছাড়া ২০১৫ সাল থেকে রাশিয়ার বাহিনী সরাসরি আসাদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসার ফলেও পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ আসাদ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বিদ্রোহীরা অনেক জমি হারিয়েছে৷
ওয়াশিংটন পোস্ট আরও দাবি করছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় এক মাস আগে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ তবে হোয়াইট হাউস ও সিআইএ এখনো এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করছে না৷ ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিদ্রোহীদের সাহায্য করার কর্মসূচির অনুমোদন দিয়েছিলেন৷ এর আওতায় হাজার হাজার বিদ্রোহীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়৷
অ্যামেরিকার সিরিয়া নীতির ক্ষেত্রে এত বড় পরিবর্তনের কারণ কী? প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিরিয়ায় শান্তি আনতে ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী৷ ফলে সিরিয়ায় সীমিত প্রভাব ও আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার ইচ্ছার অভাব কার্যত মেনে নিচ্ছে ওয়াশিংটন৷ উল্লেখ্য, রাশিয়া ও অ্যামেরিকা আগেই আলোচনার মাধ্যমে সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এক অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করেছে৷
ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত যদি সত্য প্রমাণিত হয়, সে ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের উপর রাশিয়ার প্রভাব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে৷ নির্বাচনি প্রচারের সময় থেকে ট্রাম্প টিমের উপর রাশিয়ার প্রভাব নিয়ে একাধিক তদন্ত চলছে৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা এপি-র কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন৷ এমনকি প্রশাসনের মধ্যেও রাশিয়ার প্রশ্নে গভীর বিভাজন রয়েছে বলে তাঁরা দাবি করেছেন৷ বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল এইচ আর ম্যাককাস্টার মনে করেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের উপর ভরসা করা যায় না৷ এমনকি ট্রাম্প-পুটিন সরকারি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন, যা অত্যন্ত অস্বাভাবিক ঘটনা৷ এই অবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের রাশিয়া-নীতি এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে৷
সিরিয়ায় আসলে কারা, কাদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ২০১১ সালের সেই আরব বসন্তের জেরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়৷ গত ছয় বছরে সেই সংঘাতের বিস্তৃতি অনেক বেড়েছে, যোগ হয়েছে নতুন মিত্র, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো শত্রুতা৷
আসাদের প্রতি অনুগতরা
সিরিয়ার সেনাবাহিনী, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ান আরব আর্মি (এসএএ) হিসেবে পরিচিত, ২০১১ সালের শরতে তারা বড় এক জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়৷ সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করে আসাদ বিরোধী ‘অ্যান্টি-আসাদ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷ তবে এসএএকে ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সসহ আসাদপন্থি বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ সমর্থন দিচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/V. Sharifulin
মডারেট দল
আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ সহিংস রূপ নিলে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়৷ জিহাদি নয়, এমন বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে মিলে তারা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে লড়াই করছে৷ উদ্দেশ্য হচ্ছে, সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক পথে সরকার গঠন করা৷ তবে বেশ কয়েকটি লড়াইয়ে হারার পর সেই দলের অনেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে চলে যায়৷
ছবি: Reuters
সন্ত্রাসের নতুন রূপ
সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সে দেশ এবং ইরাকের একটা বড় অংশ দখল করে নিজেদের তথাকথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস)’৷ নিজের কালো পতাকাতলে ইসলামের উগ্রতম রূপ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসংখ্য মানুষকে অত্যাচর এবং হত্যা করেছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷ রাকা শহরে গোষ্ঠীটি শক্ত অবস্থান গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এক পুরনো জিহাদ
তবে আইএসই সিরিয়ায় অবস্থান নেয়া একমাত্র জঙ্গি গোষ্ঠী নয়৷ আল-কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত আল-নুসরা ফ্রন্টসহ আরো কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী সিরিয়ায় লড়ছে৷ আল-নুসরা ফ্রন্ট নিজেদের মধ্যে লড়াই ছাড়াও আসাদ এবং মডারেট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে৷ সম্প্রতি জঙ্গি গোষ্ঠীটি সমমনা আরো কয়েকটি গোষ্ঠীকে নিয়ে জোট গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Nusra Front on Twitter
আসাদের এক শক্তিশালী মিত্র
প্রেসিডেন্ট আসাদের শক্তিশালী মিত্র ক্রেমলিন৷ সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে কয়েকবছর ধরে রসদ সরবরাহের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়া সংঘাতে যোগ দেয় রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী৷ তবে রাশিয়ার বিমান হামলায় অনেক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে মাঝেমাঝেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়ে মস্কো৷
ছবি: picture-alliance/AP/Russian Defense Ministry
অনাগ্রহী পশ্চিম
আসাদের সমালোচনা এবং নীরবে মডারেট বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন জানালেও তাদের হয়ে আসাদের বিরুদ্ধে লড়তে পদাতিক বাহিনী পাঠাতে আগ্রহী নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো ন্যাটোভুক্ত দেশ৷ তবে ২০১৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রায় ষাটটি দেশের মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক জোট সে দেশে ইসলামিক স্টেট এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর আস্তানায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images/John Macdougall
সীমান্তে নিরাপত্তা
সিরিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলো নিজেদের সীমান্ত রক্ষার স্বার্থেই এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে৷ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী জোটে থাকা তুরস্কও আসাদবিরোধী জোটকে সহায়তা করছে৷ তবে কুর্দি যোদ্ধাদের মার্কিনিদের সহায়তা নিয়ে সে দেশের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে তুরস্কের, কেননা কুর্দরা নিজেদের রাষ্ট্র চায়, যা তুরস্ক সমর্থন করে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/S. Suna
প্রক্সি ওয়ার
সিরিয়ার সংঘাতে কার্যত এক প্রক্সি লড়াইও চলছে, যেখানে একদিকে রয়েছে রাশিয়া এবং ইরান, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক৷ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায় ইরান৷ ফলে রাশিয়ার পাশাপাশি সে দেশও কৌশলগত সহায়তা, সামরিক প্রশিক্ষণ, এবং পদাতিক সেনা দিয়ে দামেস্ককে সহায়তা করছে৷
ছবি: Atta Kenare/AFP/Getty Images
যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই
ছয় বছর হয়ে গেলেও সিরিয়ায় বহুমুখী লড়াই বন্ধের কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না৷ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তৈরি বিভিন্ন শান্তি চুক্তি করা হলেও তা তেমন একটা সফল হয়নি৷ ফলে প্রতিদিন সে দেশে নানা হামলায় মারা যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে শিশু, নারীসহ অনেক বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন৷