আফরিন শহরে সিরিয়ায় যুদ্ধরত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ করে দিচ্ছে তুরস্কের সেনাবাহিনী৷ এমন অভিযোগ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের৷ লুটপাট, নির্যাতন ও গুম করার অভিযোগ এসেছে সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে৷
বিজ্ঞাপন
বিদ্রোহীদের সহায়তায় সিরিয়ার উত্তরে অবস্থিত এই শহরটি গত মার্চ মাসে দখলে নেয় তুর্কি বাহিনী৷ এর আগে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি যোদ্ধাদের সংগঠন কুর্দি পিপলস প্রটেকশন ইউনিট- ওয়াইপিজির দখলে ছিল শহরটি৷ তুরস্ক ওয়াইপিজিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে মনে করে৷
এরপর পালিয়ে যাওয়া অনেকেই আবার নিজেদের বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন৷ কিন্তু অ্যামনেস্টি বলছে, ফিরে এসে আবার নির্যাতনের মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের৷
অ্যামনেস্টি যা বলছে
আফরিনে আগে বাস করতেন এবং এখন বাস করেন, এমন মিলিয়ে মোট ৩২ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে অ্যামনেস্টি৷ এ বছরের মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে নেয়া হয়েছে এসব সাক্ষাৎকার৷
তাঁরা সবাই বলছেন, আফরিনের অধিবাসীদের ‘আটক করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে, চাইলেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও লুট' করা হচ্ছে৷ তাঁরা বলছেন, নির্যাতনকারীরা বিভিন্ন ‘বিদ্রোহী গ্রুপ' যাদেরকে ‘অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ' দিয়েছে তুরস্ক৷
কোনো কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী তুর্কি বাহিনীর সহায়তায় ‘স্কুল দখলে নিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে'৷ অ্যামনেস্টি বলছে, ‘আফরিন বিশ্ববিদ্যালয় লুট করে ধ্বংস করে দেয়ার পর তা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷
ওয়াইপিজির সাথে সম্পর্ক আছে, এমন অভিযোগ তুলে অনেক নিরীহ নাগরিককে জমি বাজেয়াপ্ত করে শাস্তি দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ অ্যামনেস্টির৷
তুরস্ক যা বলছে
তুরস্ক অবশ্য এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ ‘প্রোপাগান্ডা', দাবি দেশটির৷ তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান আগের মতোই আবারো বলছেন, সিরিয়ার কোনো অংশ দখল করে থাকার ইচ্ছা তাঁর নেই, বরং সঠিক মালিকের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতেই চান তিনি৷
অ্যামনেস্টি বলছে, তদন্তে প্রাপ্ত প্রাথমিক তথ্য তুর্কি সরকারের কাছে পাঠিয়েছে সংস্থাটি৷ অ্যামনেস্টির ‘নিরপেক্ষতা' নিয়ে দেশটি প্রশ্ন তুললেও অভিযোগের বিষয়ে ‘যথাযথ কোনো উত্তর' তুরস্ক দেয়নি বলেও জানিয়েছে অ্যামনেস্টি৷
এডিকে/ডিজি (এএফপি,রয়টার্স)
আফরিনে তুর্কি অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
দিয়ারবাকির হলো তুরস্কের বৃহত্তম কুর্দি অধ্যুষিত শহর৷ সেখানে এ বছরের নওরোজ উৎসবে আফরিনে আংকারার সামরিক অভিযানে রোষ ও যুগপৎ আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসমাজের নিষ্ক্রিয়তায় হতাশা ব্যক্ত হয়েছে৷
ছবি: DW/D. Cupolo
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের নওরোজ
কুর্দি তথা ইরানিদের নববর্ষ নওরোজ সাধারণত আনন্দোচ্ছ্বল একটি উৎসব৷ কিন্তু এ বছর সীমান্তের অপর পারে সিরিয়ার আফরিনে তুর্কি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে নওরোজে তুরস্কের কুর্দি অধিবাসীদের রোষ আর হতাশাই প্রতিফলিত হয়েছে৷
ছবি: DW/D. Cupolo
একদিকে গর্ব, অন্যদিকে হতাশা
২০শে জানুয়ারির পর থেকে আংকারার সমর্থনপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীরা আফরিনে ওয়াইপিজি ও ওয়াইপিজে প্রমুখ কুর্দি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে৷ নওরোজের মাত্র ক’দিন আগে খবর আসে যে, তারা শহরটি দখল করেছে, অর্থাৎ কুর্দি জঙ্গিরা উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া থেকে মোটামুটি বিতাড়িত হয়েছে৷ ঘটনাবলীতে তুরস্কের কুর্দিরা বিমর্ষ হলেও, নওরোজে দিয়ারবাকিরে ধ্বনি তোলেন, ‘‘আফরিনের প্রতিরোধ চলছে-চলবে’’৷
ছবি: DW/D. Cupolo
‘শুধু উৎসব নয়, বরং প্রতিরোধ’
তুরস্কের কুর্দি নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক দল বা এইচডিপি-র পরিষদের সদস্য আইনুর হাসান বলেন, এই নওরোজ অনুষ্ঠানে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা একটি বার্তা পাঠাতে চাইছেন৷ তাদের উপস্থিতি ‘‘মুক্ত কুর্দি এলাকাগুলির প্রতি অভিবাদনও বটে, আবার যারা কুর্দিদের জন্য আশা পরিত্যাগ করেছেন, তাদের প্রতি একটি বার্তাও বটে৷ এটা শুধু উৎসব নয়, এ প্রতিরোধ৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
‘বর্বরতা ও লুটতরাজ’
এইচডিপি দলের নতুন যুগ্ম সভাপতি পরভিন বুলদান দিয়ারবাকিরে জনতার প্রতি তাঁর ভাষণে আফরিনে তুর্কি অভিযানের সমালোচনা করেন৷ ‘‘ওরা আফরিনে বর্বরতা আর লুটতরাজ ছাড়া আর কিছু আনেনি,’’ বলেন তিনি৷ ‘‘কুর্দিদের রাজ্যাঞ্চল জয় বরদাস্ত করতে না পেরে, ওরা আফরিন আক্রমণ করেছে৷’’ বুলদান আরো বলেন যে, আংকারা তুরস্ক ও সিরিয়ার কুর্দিদের মধ্যে বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না৷
ছবি: DW/D. Cupolo
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা
যেসব মহিলা চলতি সংঘাতে সন্তান হারিয়েছেন, তাঁরা ‘শান্তির মা’ নামের একটি গোষ্ঠী গঠন করেছেন৷ নওরোজের স্বল্প আগে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মিলিত হন ও প্রশ্ন তোলেন, ‘‘আমরা যখন পশ্চিমে যাই, তখন আমরা স্কুল-কলেজ আর কলকারখানা দেখি৷ আর আপনারা এখানে এলে কারাগার, পুলিশ আর সাঁজোয়া গাড়ি ছাড়া আর কিছু দেখেন কি? আপনারা এর্দোয়ানকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
জরুরি অবস্থা চলেছে...
...কাজেই তুরস্কে রাজনৈতিক সমাবেশ নিষিদ্ধ৷ এছাড়া আফরিনে সামরিক অভিযান চলাকালীন দিয়ারবাকিরে ২৪ ঘণ্টার কারফিউ জারি রয়েছে৷ তা সত্ত্বেও বুধবারের নওরোজ উৎসব প্রতিবাদের রূপ ধারণ করে৷
ছবি: DW/D. Cupolo
মানুষজন ভীত, শঙ্কিত
২০১৫-১৬ সালে দিয়ারবাকিরে প্রায় যুদ্ধের পরিস্থিতি বিরাজ করছিল৷ সেই থেকে বাসিন্দারা নওরোজের মতো গণউৎসবে যোগ দিতে দ্বিধা করেন৷ তাই এবার শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে স্থানীয় কুর্দ গোষ্ঠীগুলির সদস্যরা রীতিমতো নওরোজের আমন্ত্রণপত্র বিলি করেছেন৷
ছবি: DW/D. Cupolo
‘চাপ যতই বাড়ুক না কেন’
স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা কর্মীদের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য সেলমা আটাবাই জানিয়েছেন যে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর যে দমন অভিযান শুরু হয়, তাতে তাঁর সংগঠনের ৪,৩০০ সদস্য চাকুরি হারিয়েছেন৷ তা সত্ত্বেও তাদের অনেকে নওরোজে এসেছেন বলে সেলমা জানান৷ ‘‘নওরোজে এখানকার কুর্দিরা তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে পারেন৷ চাপ যতই বাড়ুক না কেন তারা নওরোজ উদযাপন করবেন৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
অকালে উৎসবের সমাপ্তি
দিয়ারবাকিরের নওরোজ অকালে শেষ হয়, কেননা, কিছু তরুণ অতিথি নিরাপত্তার বেড়া টপকে মঞ্চে গিয়ে ওঠেন৷ অতঃপর পুলিশ উৎসব বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও, আরো কিছু সময় ধরে গানবাজনা ও নাচ চলে৷ ‘‘ওরা সবসময়ই আগে বন্ধ করে দেয়, কিন্তু আমরা যতটা পারি উপভোগ করে নিই,’’ বললেন নুরেত্তিন৷